মাছের রাজা খয়রা কালি নদীতে ফিরেছে

এগ্রিকেয়ার২৪.কম ডেস্ক: খাবারের টেবিল মাছের তরকারি ছাড়া যেন একেবারেই বেমানান লাগে। এই মাছ আবার নদী, খাল, বিল, হাওড়-বাওড় এমন সব নির্দিষ্ট জলাশয়ের হলে তো কথাই নেই। খাবারের টেবিলে নতুন যুক্ত হতে মাছের রাজা খয়রা কালি নদীতে ফিরেছে।

ধরুন বরিশালের বা গোয়ালন্দের ইলিশ। আবার তিস্তার টেংরা। হয়তো সাগরের ভেটকি মাছ বা গড়াই কিংবা মধুমতি নদীর বেলে মাছ ও পা বড় চিংড়ি। মাছ পাগল বাঙালির কাছে মাংস, পোলাও, কোরমা, ফিরনী, জর্দ্দা এমন সব বিদেশি খাবার এখনও শৌখিন খাবার হিসেবে পরিচিত।

এখনও বাড়ীতে জামাই এলে, বিশেষ করে সে যদি হয় নতুন জামাই তাহলে বাহারি খাবারের আয়োজন চলে। এই খাবারের মধ্যে হরেক রকমের মাছের উপস্থিতি স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের বাঙালিপনাকে। বাঙালি হিসেবে আমরা ভোজন রসনায় যেমন পটু, আবার বাকপটুও কম নই। প্রতি দিনের খাবারের তালিকায় পাতে ভাতের সাথে মাছ থাকবে এটাই স্বাভাবিক বিষয়।

হয় হালদা নদীর অথবা ব্রক্ষ্মপুত্রের রুই, মেঘনার পাঙ্গাশ, পদ্মার আইড়, চাপাইগাছি বিলের জিওল, পাবদা মাছ, কালি নদীর কাতল বা জিওল-মাগুর, কই-খয়রা-টেংরা। আবার চলন বিলের বাহারি মাছ, যমুনার কিংবা এলাকাভিত্তিক জলাশয়ের মাছের কদর এভাবেই সেই আদিকাল থেকে চলে আসছে।

কালি নদী। নামটার বৈশিষ্ট্য আরো একটা কারণে। তা হলো মরমী বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই’র আবির্ভাব ঘটেছিল এই নদীতে। পদ্মা নদী থেকে উৎপত্তি এক সময়ের গৌড়ি যা এখনকার গড়াই। এই নদীর পেট থেকে জন্ম কালি নদীর। কুষ্টিয়া জেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামের কোল ঘেঁসে জন্ম নিয়েছিল এই নদী। যদিও এখন সেই নদীর যৌবন উন্মাদনার রসদ সেই নাব্যতা নেই।

স্রোত হারিয়ে স্বচ্ছল শৈল্পিকতা এখন শুধুই ইতিহাসের কথা। তবে এখনও খন্ড-বিখন্ড কালি গাঙ উৎপাদন করে চলেছে হরেক রকমের রুই বা রুই জাতীয় মাছ এবং প্রাকৃতিকভাবে আগত অনেক রকমের মাছ। এই নদীর মাছের স্বাদ অন্য যে কোনো জলাশয়ের মাছের চেয়ে একেবারে ভিন্ন।

যখন দেশের বড় বড় নদীগুলোর জলে বিষাক্ততা দেখা দিয়েছে, ঠিক তখনও এই নদীর জল রয়েছে পরিচ্ছন্ন ও পরিশুদ্ধ। ছেঁউড়িয়া থেকে শুরু করে কালি নদী গেছে বহুদূর। কেবল মাত্র কুষ্টিয়া জেলায় এই নদীর বিস্তৃতি প্রায় ৩০ কিমি. এর কাছাকাছি। জেলার প্রায় ২০ লাখ মানুষের পুষ্টি যোগানের উৎস এই নদী।

মাছের চাহিদার অনেকটাই মিটে এই কালি নদীর উৎপাদিত মাছ থেকে। আবার এই নদীর   জন্য এখনও কোনো রকমে টিকে আছে দেশীয় মাছের নানান প্রাকৃতিক জাত। এই নদীর রুই, কাতলা, মৃগেল, শোল, বোয়াল, টেংরা, পুঁটি, খয়রা, মায়া, কাকিলা, গজার, আইর, জিয়ল, মাগুর, কার্প জাতীয় মাছসহ সব মাছেরই কদর রয়েছে ভোক্তার কাছে। এই নদীতে অনেকদিন পরে একটি সুস্বাদু মাছের আবির্ভাব ঘটেছে। এই মাছের নাম খয়রা।

প্রতি বছরে পাট পচানোর কারণে মাছের মড়ক লাগে। জেলেরা বছর বছর লাখ লাখ টাকার লোকসান গুণে এই কারণে। অথচ এক সময় ছিল বাজারের অতি চাহিদার এই খয়রা মাছ বিক্রি করেই তারা কয়েক মাসের রোজগার হতো। গেল বছর মাছের মড়ক হয়ে গেলে কালিগঙ্গা বাদলবাসা মৎস্য অধিদপ্তরের বাওড়ে সুফলভোগী দলের সভাপতি হানিফ মোল্যা উত্তর অংশ হতে কয়েক কেজি খয়রা মাছের পোনা এনে দক্ষিণের বড় জলাশয়ে ছেড়ে দেয়।

তা থেকে এবারে প্রজনন ঘটিয়ে বাওড়ে হয়েছে খয়রা অর্থাৎ আবারও জলাশয়ে ফিরেছে খয়রা। বাজারে এখন রুই কাতল মাছের কেজি যখন ২০০ টাকা কেজি তখন খয়রা বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকারও ওপরে। আর এতে বেজায় খুশি জেলেরা। ইলিশ স্বাদের সাদা খয়রার শরীরের কালো তারকা খোচিত বর্ণচ্ছটা দেখতেও মোহনীয়। গেল সপ্তাহে শুধু খয়রা মাছ বিক্রি করে ৪০ জন জেলে তাদের দৈনন্দিন রোজগার করতে সক্ষম হয়েছিল। এখন খয়রা তাদেরকে টাকা এনে দিলেও শঙ্কা তাদের পেছন ছাড়ছে না। আবার পাট পচনের সময় এলে যে বাটিতে গুড় সেই বাটিতেই পড়বে বালি।

এলাকার বিস্তর পাট পচনে বাধা দেবার কেউ নেই। আবার পাটের কারণে মাছ হয় না। সুতরাং মৎস্যজীবীরা এই সমস্যা সমাধানে বিকল্প পন্থার দিকে তাকিয়ে আছে। নতুবা তাদেরকে বছর বছর এ ক্ষতি পূরণ করে বাঁচিয়ে রাখার আকুতি জানিয়েছে।

মাছের রাজা খয়রা কালি নদীতে ফিরেছে প্রসঙ্গে কুষ্টিয়া জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. শেখ শফিকুর রহমান জানান, জলের বড্ড অভাব। পাট পচন একটা সামাজিক সমস্যা। আবার এ জন্য মাছ নষ্ট হচ্ছে। অথচ এর সমাধানে মাছ বাঁচিয়ে পাট পচনের ব্যবস্থা করা দরকার। নচেৎ প্রাকৃতিক মাছের বিশেষ করে ছোট ছোট জাতগুলোকে রক্ষা করা যাবে না।