জীবিকায় কৃষি ডেস্ক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: স্বামী কোন কিছু না বলে রাতারাতি সন্তানসহ নিলুফা বেগমকে ফেলে চলে যায়। স্বামী ছাড়া সন্তান নিয়ে চলতে গিয়ে তার দু’চোখে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। কোন উপায় না পেয়ে জীবন বাঁচাতে তিনি অন্যের বাড়িতে কাজ শুরু করেন। এরই মধ্যে তিনি স্বপ্ন দেখেন নিজ উদ্যোগে কিছু করার। অন্যের বাড়িতে কাজের জমানো ১৫শ’ টাকায় একটি ছাগল কিনে লালন পালন শুরু করেন। ওই কেনা একটি ছাগলই তার সফলতার স্বর্ণশিখরে পৌঁছায়।
২০১৪ সালে একটি ছাগল দিয়ে তার যাত্রা শুরু হলে ও দেখতে দেখতে কয়েক বছরের মধ্যে তিনি এ বাজিমাত করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। আর ছাগল পালনে ফিরে এসেছে তার এই সচ্ছলতা। চোখেমুখে ফুটেছে হাসির ফোয়ারা।
সাদা, কালো, হাল্কা লালসহ রয়েছে অসংখ্য ছাগল। পাশাপাশি আছে গরু ও কবুতর। সময় করে খাবার দেয়াসহ করছেন পরিচর্যা। আছে পশুর স্বাস্থ্যের প্রতি বাড়তি নজরও। নিয়মিত দেখানো হলো পশু চিকিৎসকও। সন্তানের ন্যায় ওইসব পশুকে পালন করে ব্যস্ত সময় পার করছেন নিলুফা বেগম নামে এক নারী।
ছাগল, গরু আর কবুতর পালন করে তিনি তার ভাগ্য বদল করেছেন। এখন তিনি হয়েছেন লাখোপতি। নিলুফা বেগম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌর শহরের দুর্গাপুর এলাকার শিরু মিয়ার মেয়ে। মাত্র একটি ছাগল দিয়ে প্রায় শতাধিক ছাগলের মালিক তিনি।
ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা তার এই খামারে বাণিজ্যিকভাবে ব্লাক বেঙ্গলসহ দেশী-বিদেশী উন্নত জাতের ছাগল পালন করে এলাকায় তিনি বাজিমাত করেছেন। বর্তমানে ওই খামার থেকে প্রতি মাসে তার আয় হচ্ছে ৬০ হাজার টাকার ওপর। তার সফলতা দেখে অনেকেই ছাগলের খামার করতে তার কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছেন।
এগ্রিকেয়ার২৪.কমের আরোও নিউজ পড়তে পারেন:
৪ পদ্ধতিতে ছাগল পালনে অল্প খরচে দ্বিগুণ লাভ
ভারতীয় জাত বিটল ছাগল পালনে আগ্রহী হচ্ছে মানুষ
৫১ বছর ধরে ছাগল পালন, অভাবনীয় এক সাফল্য
জেনে নিন দেশি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালনে সুবিধা
নিলুফা বেগম বলেন, জীবন মানেই কঠিন সংগ্রাম। পদে পদে বাধা আর নানা লাঞ্ছনা-বঞ্চনার শিকার হতে হয় তাকে। জীবনযুদ্ধে নেমে উদ্যম আর সাহস নিয়ে কাজ করলে জয়ী হওয়া যায়। আমি শুধু সেই চেষ্টা করছি। তার এই সফলতা দেখে অনেকেই খামার করে ছাগল পালনে উৎসাহিত হচ্ছেন।
বর্তমানে তার গড়ে ওঠা খামারে শতাধিক নানা প্রজাতির ছাগল আছে। রয়েছে ২৬টি গরু, শতাধিক কবুতর। মাত্র একটি ছাগল দিয়ে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন তিনি এ বিশাল আকারের খামার। সংসারে এনে দিয়েছে সচ্ছলতা আর সম্মান।
এদিকে সদ্য হয়ে যাওয়া কোরবানির ঈদে তিনি ২০টি ছাগল ও ৮টি গরু বিক্রি করেন। এক একটি গরু নিচে ১ লাখ থেকে উপরে দেড় লাখ টাকার ওপর বিক্রি করেন। আর ছাগল ১২ হাজার থেকে ওপরে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। প্রতি মাসে যাবতীয় খরচ বাদে এই খামার থেকে ৬০ হাজার টাকার ওপর তার আয় হয়। নিলুফা বেগম আরও বলেন, এখন তার সংসারে কোন অভাব-অনটন নেই। এক সময় অন্যের বাড়িতে থাকতেন।
ছিল না কোন জায়গা-জমি। এই খামার দিয়ে ১৬ শতক জায়গা ক্রয় করেছেন বাড়ি। এর মধ্যে বড় আকারের ৩টি ঘরে ছাগল, গরু রেখে পালন করছেন। ১টি ঘরে পরিবারের লোকজনরা থাকছেন। তা ছাড়া এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। সন্তানকে দিয়েছেন দোকান করে। এখন তার খামারে নিচে ৩৫ লাখ টাকার ওপর ছাগল, গরু রয়েছে।
প্রবল ইচ্ছা শক্তি আর মনোবল থাকলে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন করা যায় তার প্রমাণ দিয়েছেন তিনি। দেশে ছাগলের মাংসের যেমন চাহিদা রয়েছে, তেমনি দামও সন্তোষজনক হওয়ায় ছাগলের খামার গড়ে তিনি এ সাফল্য পেয়েছেন।
নিলুফা বলেন, দেশী জাতের ছাগল বছরে দুবার বাচ্চা দেয়। একটি ছাগল সর্বোচ্চ চারটি বাচ্চা দেয়। এক বছর বয়সী একটি ছাগল বিক্রি হয় দশ থেকে বারো হাজার টাকায়। আর গরু দেয় ১ বছর পর পর। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তার অনেক ছাগল হয়ে যায়। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে গরুর সংখ্যাও।
ভিটামিন বা অন্য কোন ওষুধ ছাড়াই শুধু ঘাস, ভুসি ও পানি খাইয়ে দেশীয় পদ্ধতিতে তিনি ছাগল ও গরু লালন পালন করছেন। তিনি বলেন, সন্তানের চেয়ে পশুগুলো আমার কাছে বড়। আমি সন্তানের চেয়ে পশুগুলোকে বেশি ভালবাসি। আমি সবকিছু সহ্য করতে পারব কিন্তু তাদের আদর যত্ন, আর পরিচর্যায় কোন ঘাতটি হোক তা কষ্ট সহ্য করতে পারব না।
প্রাণিসম্পদ বিভাগ তাকে নিয়মিত সহযোগিতা করছেন বলে তিনি জানান। সেখান থেকে সরকারীভাবে বিনামূল্যে কৃমিনাশক ওষুধ, পিপিআর রোগের ভ্যাকসিন নিয়মিত দেয়া হচ্ছে। ছাগল-গরুর পাশাপাশি আছে শতাধিক কবুতরও।
তিনি আরও বলেন, প্রতি মাসে অন্তত ৫-৭টি ছাগল বিক্রি হয়। এক একটি ছাগল ১০-১৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তা ছাড়া বছরে ১০-১৫টি গরু বিক্রি হয়। ওইসব বিক্রি করে বছরে খরচ বাদে ৭ লক্ষাধিক টাকার ওপর। প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে এ পর্যন্ত উপজেলা পর্যায়ে বেশ কয়েকটি পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন বলে জানান।
প্রতিবেশী ফিরোজা বেগম বলেন, নিলুফা বেগম খুবই কর্মঠ একজন নারী। দিনরাত পরিশ্রম করে খেয়ে না খেয়ে এই খামারটি গড়ে তুলেছেন। একটি ছাগল দিয়ে এই জায়গায় আসা খুবই দুষ্কর ব্যাপার। তিনি শুধু নিজের ভাগ্য বদল করে থেমে থাকেননি। প্রতিবেশী ও আশপাশের অভাবগ্রস্ত নারীদেরও পথ দেখিয়েছেন।
ইয়াসমিন আক্তার বলেন, তিনি অবহেলিত নারীদের পথ পদর্শক। তিনি আমাদের চোখ খোলে দিয়েছেন। তার দেখাদেখি গত ১ বছর ধরে তিনিও ছাগল পালন শুরু করেছেন বলে জানান।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ জুয়েল মজুমদার বলেন, ছাগলের খামার দিয়ে নিলুফা বেগম আসলেই এলাকায় দৃষ্টান্ত স্থান করেছেন। নিজের প্রচেষ্টায় খামার করে তিনি বেশ সফল হয়েছেন। পশু পালনের ক্ষেত্রে সকলকেই উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে বিনামূল্যে কৃমিনাশক ওষুধ, সরকারী মূল্যে ভ্যাকসিন, প্রশিক্ষণ ও চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়ে থাকে।
তিনি আরও বলেন, এখন অনেকেই ছাগলসহ গরুর খামার গড়ে তুলতে পরামর্শের জন্য আমাদের কাছে আসছেন। তাদের সব ধরনের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। ছাগল পালনে বাজিমাত নিলুফার সংবাদের তথ্য জনকন্ঠ থেকে নেওয়া হয়েছে।
এগ্রিকেয়ার/এমএইচ