নিজস্ব প্রতিবেদক: সাতক্ষীরার তালা উপজেলার জিয়ালা গ্রামের বাসিন্দারা দুই প্রজন্মের বেশি সময় ধরে গাভি পালন ও দুগ্ধ উৎপাদন করে আসছেন। বর্তমানে গ্রামটিতে দুগ্ধ খামার আছে দেড় শতাধিক।

গ্রামের ঘোষপাড়ায় দেড় শতাধিক খামারির এখন এক হাজারের বেশি গাভি রয়েছে। এসব গাভি থেকে সকাল-বিকেল দুই বেলায় দুগ্ধ আহরণ করা হয়। তাতে দৈনিক ১৫ হাজার লিটারের বেশি দুধ পাওয়া যায়। প্রতি লিটার দুধ বিক্রি হয় ৪২ থেকে ৫৫ টাকায়। জিয়ালার দেখাদেখি তালা উপজেলার মহান্দী, হরিশ্চন্দ্রকাঠি, আটারইসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম এবং সাতক্ষীরা সদর, কালীগঞ্জ ও কলারোয়া উপজেলার অনেক গ্রামে গরু পালন, দুগ্ধ উৎপাদন ও বিপণনের নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে।

সব মিলিয়ে পুরো জেলায় দৈনিক পৌনে ৬ লাখ লিটার দুধ উৎপাদিত হয়। খামারিদের কাছ থেকে প্রাণ ডেইরি মিল্ক, আড়ং, মিল্ক ভিটাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দুধ সংগ্রহ করে থাকে।

জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ সাতক্ষীরা জেলায় এখন বিপুল পরিমাণ দুগ্ধ উৎপাদনের পাশাপাশি প্রতিবছর কয়েক লাখ টন বর্জ্যও পাওয়া যায়। একসময় সঠিক উপায়ে গোবর ও মূত্র ব্যবস্থাপনার অভাবে এসব এলাকার মাটি, পানি ও বাতাস মারাত্মকভাবে দূষিত হতো। সুষ্ঠু খামার ব্যবস্থাপনার অভাবে কৃষকেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। এ রকম অবস্থায় পরিবেশসম্মত টেকসই পরিবর্তনের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়।

২০১৯ সাল থেকে বিশ্বব্যাংক ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহযোগিতায় গ্রামের একটি অংশে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিবেশসম্মত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শুরু হয়।

এতে খামারিরা যুক্ত হন। আরেকটি ভালো খবর হলো, এই গ্রাম থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে তা থেকে ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার ও ট্রাইকো কম্পোস্ট সার তৈরি করছেন আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের অর্ধশত উদ্যোক্তা। দুটো কাজই চলছে সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ প্রজেক্টের (এসইপি) আওতায় নেওয়া ডেইরি ফার্ম প্রকল্পের মাধ্যমে।

সম্প্রতি পিকেএসএফের আয়োজনে ঢাকা থেকে একদল সাংবাদিক প্রকল্পটি সরেজমিন পরিদর্শন করেন। সেখানে খামারি ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে গ্রামে আর্থসামাজিক পরিবর্তনের নানা গল্প জানা যায়।

বিশ্বব্যাংক ও পিকেএসএফ যৌথভাবে ১৩ কোটি মার্কিন ডলারের এসইপি প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পটির অধীনে সারা দেশে ৬৪টি উপপ্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে তালা উপজেলায় এসইপির ডেইরি ফার্ম প্রকল্প একটি। পিকেএসএফের সহায়তায় এক হাজার উদ্যোক্তার জন্য ডেইরি ফার্ম প্রকল্পটি মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করছে উন্নয়ন প্রচেষ্টা নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

পিকেএসএফ ও উন্নয়ন প্রচেষ্টার কর্মকর্তারা জানান, ডেইরি ফার্ম প্রকল্পের উদ্দেশ্য জিয়ালায় বিদ্যমান দুগ্ধ খামারগুলোকে পরিবেশসম্মত ও টেকসই বাণিজ্যিক খামারে পরিণত করা। এ জন্য তারা পরিবেশসম্মতভাবে গরু পালন পদ্ধতি প্রচলনের পাশাপাশি গোবর দিয়ে জৈব সার তৈরির উদ্যোক্তাও তৈরি করা হয়েছে।

এসইপি ডেইরি ফার্ম প্রকল্পের আওতায় ঋণসহায়তা ও এককালীন দিয়ে জিয়ালা গ্রামে কেন্দ্রীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হয়। এ জন্য গ্রামের বড় অংশজুড়ে একটি নালা তৈরি করা হয়। নালাটির মাধ্যমে গরুর মূত্র ও গোসলের পানি কয়েকটি ধাপে পরিস্রবণ হয়ে পার্শ্ববর্তী খালে গিয়ে পড়ছে। অথচ আগে সরাসরি সব বর্জ্য খালটিতে পড়ায় ব্যাপক হারে পরিবেশদূষণ হতো।

পাশাপাশি গ্রামটিতে একটি মডেল গোবর সংগ্রহ কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে, যেখানে পৃথক চেম্বারে গ্রামের ১২ জন খামারি তাঁদের গোবর সংরক্ষণ করেন। গ্রামের অন্য খামারিরাও উন্নয়ন প্রচেষ্টার সহযোগিতায় ও নিজস্ব উদ্যোগে গোবর সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। তাঁরা ভার্মি কম্পোস্ট প্রস্তুতকারকদের কাছে গোবর ১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। এ ছাড়া খামারিরা গরু কেনার জন্য ঋণও পাচ্ছেন প্রকল্পটি থেকে।

এসইপি ডেইরি ফার্ম প্রকল্পের পরিচালক মো. গিয়াস উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি তাঁরা খামারিদের মধ্যে লবণাক্ততা সহনশীল ঘাস চাষ, গবাদিপশুর চিকিৎসায় সহায়তা, পণ্যের বাজার সংযোগ বৃদ্ধি, পশ্চাৎ ও সম্মুখ সংযোগ ব্যবসায়িক উদ্যোগ, বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সনদ প্রাপ্তি, প্রশিক্ষণ প্রদান এবং শিশুশ্রম বন্ধের মতো কাজে সহযোগিতা করছেন। যেমন পরিবেশসম্মত উপায়ে গাভি পালনের কারণে ইতিমধ্যে ১৫ জন খামারি পরিবেশ ছাড়পত্র পেয়েছেন।

তালা উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সঞ্জয় বিশ্বাস বলেন, জিয়ালা গ্রামে নালা তৈরির পর ময়লা ও দুর্গন্ধের পরিমাণ আগের তুলনায় অনেক কমেছে। তবে পুরোপুরি পরিবেশবান্ধব করতে হলে সেখানকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আরও আধুনিক করা প্রয়োজন। পাশাপাশি জেলার অন্যান্য এলাকাতেও এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

এসইপি ডেইরি প্রকল্পের আওতায় ঋণসহায়তা দিয়ে ভার্মি কম্পোস্ট (কেঁচো সার) ও ট্রাইকো কম্পোস্ট সার তৈরির বেশ কিছু উদ্যোক্তা তৈরি করা হয়েছে। এসব উদ্যোক্তা জিয়ালাসহ আশপাশের গ্রাম থেকে গোবর নিয়ে সার তৈরি করেন। এ জন্য একটি টেকসই ভ্যালু চেইন গড়ে তুলেছে উন্নয়ন প্রচেষ্টা।

তেমনই একজন উদ্যোক্তা তালা উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আবদুল আজিজ বিশ্বাস। তিনি এই প্রকল্প থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করেন। বর্তমানে তিনি মাসে ২০ টন সার উৎপাদন করেন, যা বিক্রি করে ৬০ হাজার টাকার বেশি মুনাফা হয়। জৈব সার বিক্রি করে তিনি ইতিমধ্যে গরুর খামারও করেছেন।

উন্নয়ন প্রচেষ্টার কর্মকর্তারা জানান, তাঁদের উদ্যোগে সাতক্ষীরা জেলায় কেঁচো সার ও ট্রাইকো কম্পোস্ট সার তৈরির ১৮০ জন উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। তাঁরা বছরে মোট ২০০ টন জৈব সার উৎপাদন করেন।

পিকেএসএফের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল কাদের বলেন, ‘প্রকল্পটির মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ের পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য খুব ভালো ব্যবসায়িক সমাধান তৈরি হয়েছে। আমরা উদ্যোক্তাদের শিখিয়েছি, এখন তাঁরা এটা ধরে রাখবেন। তাই প্রকল্পটি শেষ হলেও টেকসই সমাধান হিসেবে এটির প্রভাব অব্যাহত থাকবে বলে আশা করছি।’

সব খামারির নিজস্ব জমি না থাকায় তাঁরা নিজেদের প্রয়োজনীয় ঘাস উৎপাদন করতে পারেন না। ফলে বর্তমানে গোখাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাঁরা অসুবিধায় পড়েছেন। জিয়ালার উদ্যোক্তা চায়না ঘোষ জানান, গোখাদ্যের দাম বাড়ার কারণে তাঁদের আয় অর্ধেকে নেমে এসেছে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ/২০২৩