যুগ যুগ ধরে অবহেলিত

জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস, কৃষিবিজ্ঞানের ফেরিওয়ালা, ব্রি’র সাবেক মহাপরিচালক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: যুগ যুগ ধরে অবহেলিত কৃষকের হয়ে খুব কম মানুষই কথা বলেছে। তারা ধানের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। কোনো ফসলেই সে ন্যায্য দাম পায় না। কারণ তাদের হয়ে খুব কম মানুষই কথা বলেছে।

প্রাসঙ্গিক কথন

ঋগ্বেদে কৃষি-সংস্কৃতি নিয়ে বহু উধৃতি আছে। এগুলির সবই ভালো ফসল, সুস্থ গাভী, গোরক্ষা, ভুমি আবাদ, বৃষ্টিপাত এমনকি জলসেচের জন্য দেবতার কাছে স্তুতি মাত্র। সবচেয়ে পুরোনো এই বেদে আরও বলা হয়েছে; চাষই সবচেয়ে ভালো জীবিকা।

এতে মনে হয় সে সময় আর্যদের ধর্মকর্ম সবই ছিল কৃষি-ভিত্তিক। যজু ও অথর্ব বেদের যুগ পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত ছিল বলে মনে হয়। যজুর্বেদে সুশস্যা কৃষি ও ওষধির কথা বলা হয়েছে। তখনই ভূমি কর্ষণ, পোকামাকড় দমন, ফসল তোলা ইত্যাদি ব্যাপারে গবেষণা হয়েছে; পাশাপাশি প্রার্থনা মন্ত্রও উচ্চারিত হয়েছে।

যেমন শুনং বাহাঃ , শুনং নরঃ, শুনং রুষতু লাঙ্গলম। অর্থাৎ হলকর্ষণের সময় লাঙল, গরু, কৃষক সবই যেন তাড়াতাড়ি কাজ করে। সব শেষের বেদ অথর্ব বেদে জনৈক “বৈন্য”নামে এক চাষবাষের আবিষ্কারকের নাম পাওয়া যায়। তার দেখাদেখি নাকি অন্য মানুষেরা চাষবাস শুরু করে- তাং পৃথী বৈন্যোঅধোগ্, তাং কৃষিং সস্যং চাধোক। তে কৃষিং চ সস্যংচ মনুষ্যা উপজীবন্তি।

বেদের পরে উপনিষদ ইত্যাদির কথায় যদি আসি। শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে, ক্ষুধার অপর নাম তমিস্রা, যাকে অতিক্রম করার জন্য মানুষের চেষ্টার অন্ত নেই। তৈত্তিরীয় উপনিষদ বলছে, অন্নং ব্রহ্মোতি ব্যাজানাৎ অর্থাৎ অন্নই ব্রহ্ম। আর অন্ন আসছে মাটি থেকে।

তাই মাটির পৃথিবীকে মাতৃজ্ঞানে নমো মাত্রে পৃথিব্যৈ সম্বোধন করতেও কুণ্ঠা নেই সে যুগের দার্শনিকদের। এসব থেকে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বৈদিক সভ্যতা এবং তারপরেও বেশ কিছুকাল ধরে সমাজে কৃষির বেশ গুরুত্ব ছিল। কৃষি সার্বজনিন পেশা হিসাবে স্বীকৃত ছিল।

কিন্তু বর্ণাশ্রম প্রথা পাকাপোক্ত হওয়ার সাথে সাথে জীবন ধারণের আদিমতম পেশাটি আর সার্বজনীন রইলো না। এমনকি কৃষিকে বিদ্যা হিসাবে গণ্য করার বৈদিক চেতনাও লোপ পেতে শুরু করলো। মুক উপনিষদে উল্লেখিত বিদ্যাসমূহের তালিকায় কৃষি-প্রসঙ্গ নেই।



ছান্দোগ্য উপনিষদে ঋষি সনৎ কুমারকে নারদ যে বিদ্যার তালিকা শোনাচ্ছেন সেখানে কৃষি নেই। মনুর ভাষ্যে কৃষি হিংসা প্রায়ং পরাধীনাং কৃষি যত্নে বর্জয়েৎ। বাহ্মণ, ক্ষত্রিয় আপদের সময় কৃষি করুক, দোষ নেই।

তবে কৃষি কাজ পারতপক্ষে না করাই ভালো। অর্থাৎ উচ্চ বর্ণের চোখে কৃষি ইতোমধ্যেই ঘৃণার বিষয় হয়ে গেছে। নইলে কি কেউ বলে, লাঙলের ফলা দিয়ে চাষে নামলে জমির পোকা মাকড় সহ কতসব জীবকে মারতে হয়। মনুসংহিতায় বর্ণিত বিভিন্ন পেশার মধ্যে কৃষিই সবচেয়ে শ্রমনির্ভর পেশা। সে পেশা ব্রাহ্মণ-বৈশ্য পেরিয়ে এক সময় শূদ্রের ঘাড়ে পড়বে এটাই যেন নিয়তি ছিল্।

তাই জীবহত্যা করতে হবে বলে আজগুবি এক অজুহাত দিয়ে শূদ্রের ঘাড়ে সব দায় চাপানো হয়েছে। তবে তাকে (শূদ্র) ভূমির অধিকার দেয়া হয়নি। সে কথাও মনুর বিধানে আছে। যেমন তিনি বলেছেন, “ন হি তস্যাস্তি কিঞ্চিৎ স্বং-শূদ্রের আবার সম্পত্তি কিসের।

দাসত্ব করার জন্যই প্রজাপতি শূদ্রদের সৃষ্টি করেছেন। সেই যে কৃষির প্রতি বৈষম্য-ভাবনার শুরু, এখনও তার শেষ হয়নি। মুখে সংস্কৃতির ধারক-বাহক অনেকে বলেন “কৃষি বিনে গতি নেই’।

অথচ অন্তরে ভিন্ন ভাব। আমি শুধু তথাকথিত কিছু পণ্ডিতদের কথা বলছি। তাই কিছু ব্যতীক্রম ছাড়া দেশের সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্বদের কেউই কৃষি নিয়ে ভাবেন বলে মনে হয় না। যদিও কৃষি এবং কৃষ্টি একই মূদ্রার এপিঠ ওপিঠ। তারপরেও কেন জানি এসব ব্যাক্তিত্বদের আলোচনায় কৃষি এখনও অপাংক্তেয় হয়ে আছে।

প্রাচীন যুগের সুধীজনেরা কৃষিকে একসময় (বর্ণাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে) অবহেলার বিষয় মনে করলেও চাণক্য বা কৌটিল্য ছিলেন ব্যাতিক্রম। একই কথা প্রযোজ্য কৃষি পরাশর এবং খনার বেলায়। হয়তো আরও অনেকে ছিলেন যাদের নাম ইতিহাস জানতে পারিনি।

এযুগেও এ ধরনের জ্ঞানীগুণী মানুষের অভাব নেই। তাই আমার বিশ্বাস আমাদের হাজার বছরের এ পেশাটিকে নতুন ভাবে মূল্যায়নের ভারটি তারাই নিবেন। কৃষিতে চাণক্যের ভূমিকা নিয়ে কিছু বলা যায়। চাণক্য ছিলেন মৌর্য্য সম্যাজ্যেও প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যরে শিক্ষক, মন্ত্রণাদাতা এবং প্রধানমন্ত্রী।

আফগানিস্তান থেকে চট্টগ্রাম ব্যাপী আজকের ভারতবর্ষের অধিকাংশ এলাকা জুড়ে তার সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। ঐ সময়ের সুপার পাওয়ার বলতে যা বুঝায় তাই। পাশাপাশি অর্থনৈতি দিক দিয়েও যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল।

অর্থনীতিতে কৃষির একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল। কৃষকদের সমাজে একটা বিশেষ ভূমিকা জায়গা ছিল বলে মনে হয়। তবে আবাদিকার্যক্রম ছোট ছোট জমিদারদের অধীনে নিয়ন্ত্রীত হতো।

দাস এবং শূদ্ররা এ এ কাজে সাহায্য করতো। রাষ্ট্রের আনুকূল্যে এই জনগোষ্ঠী কিছু কিছু ভুমি চাষের কাজে পরিণত করতে পারতো। স্বাভাবিক ভাবেই রাষ্ট্রের সমস্তা জমির মালিক ছিল রাজা। ফসল উৎপাদনের সাথে জড়িতদের অর্থাৎ কৃষকের যুদ্ধে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল না।

কিন্তু তাদেরকে অবশ্যই উৎপাদিত পণ্যেও ২৫ শতাংশ করা দিতে হতো। গ্রীক ঐতিহাসিক মেগাস্থিনিস এর মতে সে সময় ভারততবর্ষে দুর্ভিক্ষ বলে কিছু ছিল না। ধান, জোয়ার-বাজরা, ফল-ফলাদি প্রচুর জন্মাতো। বছরে দুই বার ফসল হতো।

চাষবাসের বিষয়ে রাজার পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। সেচের প্রয়োজনে গুজরাটের চন্দ্রগুপ্ত হ্রদেবাঁধ দিয়ে সেচের ব্যবস্থা করা এর অন্যতম উদাহরণ। এর এই সমস্ত কার্যক্রম কৌটিল্যের মন্ত্রণা ছাড়া এসব সম্ভব হতো না।

তাজমহলের দিকে তাকালে মনে হয় মোগল আমল ফল-ফসলে বেশ সমৃদ্ধ্ ছিল। সে সময় কৃষি ভূমির মালিকানা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। সেচ ব্যবস্থার জন্য খাল, নালা পুকুর ইত্যাদি খনন করা হয়। কর-ব্যবস্থাতো একটি চিরন্তন ব্যবস্থা।

তবে বাদশাহ্ আকবরের সময় এই ব্যবস্থা বেশ সংস্কার করা হয়। তাঁর অর্থমন্ত্রী টোডরমলের নির্দেশনায় দশ বছরের ফলনের গড় উৎপাদনের তিনভাগের একভাগ করের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য পঞ্চায়েত, জমিদার-জায়গিরদার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়।

এদের থেকেই কালে-কালে অজ¯্র রাজা-মহারাজাদের সৃষ্টি হয়। কিন্তু তাদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যের পরিষেবা থেকে কৃষকরা বঞ্চিত হতে থাকে। তাদের ধারণা এমনি ছিল যে, এটা চাষাদের স্বভাবসিদ্ধ চৌদ্দ পুরুষের কাজ।

মাটিতে বীজ বুনলেই তাতে গাছ জন্মায় এবং ফুল-ফল ধরে। এতে আর কি এমন বুদ্ধি-শুদ্ধির দরকার হয়। একটু যা খেয়াল রাখার বিষয় তা হলোÑবছর শেষে খাজনাটা যেন ঠিকমত আদায় হয়। প্রয়োজনে জোর-জবরদস্তির যত কৌশল আছে তার কোনোটাই বাদ যেতো না ।

আরও পড়ুন: ধানের ব্লাস্ট রোগ কেন হয়? প্রতিকার কী?

বৃটিশ বেনিয়াদের দৃষ্টিভঙ্গির এর থেকে ভিন্ন কিছু ছিল না। ভারতবর্ষকে তারা কুক্ষীগত করেছিল শুধুমাত্র নিজের এবং নিজের দেশকে সমৃদ্ধশালী করার জন্য। তাদের বেনিয়ার তুলাদন্ড কালে কালে রাজদন্ডে পরিণত হয়। প্রজাপীড়ন এবং প্রজাশাসন সমানে চললেও কৃষিকে নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করতে তারা অনেক সময় নিয়েছিল।

‘যুগ যুগ ধরে অবহেলিত কৃষকের হয়ে খুব কম মানুষই কথা বলেছে’ শিরোনামের লেখাটির লেখক: জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস, কৃষিবিজ্ঞানের ফেরিওয়ালা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি ) এর সাবেক মহাপরিচালক, সাবেক ন্যাশনাল কনসালটেন্ট, ইরি বাংলাদেশ।