মৎস্য ডেস্ক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: গাজীপুরের কালীগঞ্জে প্রতি বছরের মতো এ বছরও উপজেলার বিনিরাইল (কাপাইস) গ্রামের জামাইদের পৌষ সংক্রান্ত মিলনমেলা হয়েছে। প্রায় আড়াইশ বছর ধরে আয়োজন করা হচ্ছে এমন মাছের মেলা। মাছের মেলাটি এখন রূপ নিয়েছে ওই এলাকার ঐতিহ্যে। এই দিনে দুই শতাধিক মাছ ব্যবসায়ী বড় বড় বাহারি মাছের সারি নিয়ে বসে বিক্রির জন্য।

রোববার সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এখানে চলে নানারকম আনন্দ-উৎসব। দিনটির জন্য সারাটি বছর অপেক্ষায় থাকেন উপজেলাবাসীসহ বিভিন্ন জেলার লোকজন। বিনিরাইল, কাপাইস, জাংগালীয়া, বক্তারপুর, মোক্তারপুর, জামালপুরের আশপাশের গ্রামসহ যারা এসব এলাকায় বিয়ে করেছেন, সেই সব জামাইরা হচ্ছেন ওই মেলার মূল ক্রেতা ও দর্শনার্থী।

মেলার আয়োজকেরা জানান, এবারের মেলায় দুই শতাধিক মাছ ব্যবসায়ী বাহারি মাছের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। মেলায় মাছ ছাড়াও আসবাব, খেলনা, মিষ্টি ইত্যাদির দোকান রয়েছে। মাছের মেলায় সামুদ্রিক চিতল, বাগাড়, আইড়, বোয়াল, কালবাউশ, পাবদা, গুলশা, গলদা চিংড়ি, বাইম, ইলিশ, কাইকলা, রুপচাঁদা মাছের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে হরেক রকমের দেশি মাছ। কেউ মাছ কিনেছেন, কেউবা দেখছেন আর ছবি তুলছেন। মেলায় কোনো কোনো মাছের ওজন ২০ থেকে ৫০ কেজি।

মাছের ক্রেতা কালীগঞ্জ উপজেলার জামালপুর গ্রামের জামাই আশরাফুল ইসলাম বলেন, মেলা উপলক্ষে প্রতিবছর শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে আসেন। মেলা থেকে বড় আকারের মাছ কেনার চেষ্টা করেন। এবার ৪০ কেজি ওজনের কাতলাসহ ৫৫ হাজার টাকার মাছ কেনা হয়েছে।

উপজেলা সদর বাজারের মাছ ব্যবসায়ী বীরেন্দ্র চন্দ্র দাস। তিনি ২৫ বছর ধরে মাছের মেলায় মাছ বিক্রি করছেন। এবার তিনি ৫০ কেজি ওজনের একটি বাগাড় মাছ নিয়ে এসেছেন। মাছটির দাম চাইছেন ১ লাখ ১২ হাজার টাকা। ক্রেতাদের মধ্যে একজন মাছটির দাম বলছেন ৫০ হাজার টাকা। এ নিয়ে চলে বেশ দর–কষাকষি। মাছটির জন্য ক্রেতাদের চাইতে দেখতে আসা মানুষের ভিড় ছিল বেশি।

ঘোড়াশাল থেকে প্রায় পাঁচ লাখ টাকার মাছ নিয়ে এসেছেন মাছ ব্যবসায়ী সজীব চন্দ্র দাস। তাঁর কাছে ছিল ৪০ কেজি ওজনের একটি কাতলা মাছ। মাছটির জন্য ১ হাজার টাকা কেজি দরে ৪০ হাজার টাকা হেঁকেছেন। পরে তিনি মাছটি ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন।

মূলত এটা জামাই মেলা হলেও সবার কাছে এর পরিচিতি মাছের মেলা হিসেবে। মেলা ঘিরে কয়েক জেলার মানুষের সমাগম হয় এখানে। আর দিনটির জন্য বছরজুড়ে অপেক্ষায় থাকেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এদিন এলাকার প্রতিটি বাড়িতে থাকে নতুন–পুরোনো অতিথি দিয়ে ভরা।

ভৈরব থেকে আসা মাছ ব্যবসায়ী অজিত চন্দ্র দাস বলেন, ২৫-৩০ বছর এই মেলায় মাছ নিয়ে আসি। এতে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে তৈরি হয়েছে ভালো সম্পর্ক। অনেক ক্রেতার সঙ্গে পরিচিতি হয়ে গেছে। আগে মানুষ বেশি মাছ কিনত আর স্থানীয় মানুষ বেশি থাকত, কিন্তু এখন বিভিন্ন জেলার মানুষ আসে, ছবি তুলে ও ভিডিও করে নিয়ে যায়।

গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার জামাই আলমগীর হোসেন বলেন, মেলার কথা খালি শুনে এসেছি, এবার এই প্রথম মাছের মেলায় এসেছি। বোয়াল, কাতলাসহ প্রায় এক লাখ টাকার মাছ কিনেছি। এখন মাছগুলো নিয়ে রওনা হয়েছি।

মাছের মেলার আয়োজক কমিটির সভাপতি ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য কিশোর আকন্দ বলেন, এই মেলাটি প্রথম অনুষ্ঠিত হতো খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে। অগ্রহায়ণের ধান কাটা শেষে পৌষ-সংক্রান্তি ও নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। প্রায় ২৫৪ বছর যাবত মেলাটি আয়োজন হয়ে আসছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ মেলাটি একটি সর্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে।

তিনি জানান, মেলা এখন ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। এ মেলা গাজীপুর জেলার সবচেয়ে বড় মাছের মেলা হিসেবে স্বীকৃত। মেলাটি এ অঞ্চলের ঐতিহ্যের ধারক। মেলায় বেচাকেনা যতই হোক, এ মেলা আমাদের ঐতিহ্য আর কৃষ্টি-কালচারকে বহন করছে এটাই সবচেয়ে বড় কথা। শুরুতে এ মেলা শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য হলেও বর্তমানে এটা সব ধর্মের মানুষের কাছে ঐতিহ্যের উৎসবে পরিণত হয়েছে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ