ছবি: আপাং গাছ, ছবিটি তুলেছেন রাজশাহী কলেজ শিক্ষার্থী ইব্রাহীম হোসেন
ইব্রাহীম হোসেন, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: আপাং একটি একবর্ষজীবী উদ্ভিদ। আপাং, চিরচিরে,সিসা গন্ধ, রক্ত আপাং, উপুতলেংগাসহ এটি বেশ কয়েকটি নামে পরিচিত।এটি সাধারণত ২ রঙের হয়ে থাকে সাদা ও লাল।
আপাং উদ্ভিদটি সারাদেশেই জন্মে।হার্ব জাতীয় উদ্ভিদ।এ উদ্ভিদটি ১ মিটারের মতো উঁচু হয়।শাখা প্রশাখা চারদিকে ছড়ানো থাকে।মূলে ভেষজ গুন বিদ্যমান।কান্ডের অগ্রভাগে বড় বাঁকানো কাটাময় ফুল ফোটে। পাতা,বীজ ও কান্ডে ভেষজ গুন রয়েছে।
“আপাং” এর বৈশিষ্ট্য:
১। শাখা প্রশাখা চারদিকে ছড়ানো থাকে।
২।মূলে ভেষজ গুন বিদ্যমান।
৩।কান্ডের অগ্রভাগে বড় বাঁকানো কাটাময় ফুল ফোটে।
৪।ফুলগুলি ক্ষুদ্র হয়ে থাকে।
৫। আপাং ছোট বিরুত জাতীয় উদ্ভিদ।
“আপাং” যে যে চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ঃ
১। অর্শ রোগঃ
আপাং-এর বীজ ৩ গ্রাম নিয়ে তা আতপ চাল ধোয়া পানি দিয়ে ভালভাবে বেটে সকালে একবার করে নিয়মিত ৩-৪ দিন খেলে অর্শের যন্ত্রণা এবং রক্তপড়া বন্ধ হয়।
২। অকাল প্রসবেঃ
অকালপ্রসবের সম্ভাবনা দেখা দিলে আপাং গাছের ফুল অর্থাৎ মঞ্জরী হয়নি এমন চারাগাছ গোড়া থেকে মুলসহ তুলে গর্ভবতীর কটিদেশে বেঁধে দিলে আল্লাহর রহমতে অকালপ্রসবের ভয় থাকেনা।
৩। ফোঁড়ার পূঁজ বের করতেঃ
আপাং গাছের টাটকা পাতার রস ৮ঁ-১০ টি এবং আতপ চাল ৪ গ্রাম নিয়ে উভয়কে ঠান্ডা পানি দিয়ে বেটে ফোঁড়ার চারপাশে প্রলেপ দিলে ভেতর থেকে পূঁজ ও দূষিত রক্ত বের হয়ে আসে।তবে দিনে ২-৩বার প্রলেপ দেয়া দরকার।
৪। দাদ রোগেঃ
আপাং গাছের শুকনা ডাঁটা আগুনে পুড়িয়ে ক্ষার তৈ্রী করে নিতে হবে।৮ গ্রাম সেই ক্ষার এবং জলপাই তিল তেল দিয়ে মেখে দাদের উপর ঘষে ঘষে লাগাতে হবে।ইনশা আল্লাহ ৪-৫ দিনের মধ্যে উপকার পাবেন।
৫। কাটা ও রক্তপাতেঃ
আঘাত লেগে কেটে গেলে অথবা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে কাটলেে এবং রক্ত বের হলে আপাং এর টাটকা রস কাটা স্থানে দিলে সাথে সাথে রক্ত পড়া বন্ধ হবে।তবে রসটা পরিমানে একটু বেশী হতে হবে।
৬। চুল পাকা রোধেঃ
আপাং এর টাটকা শিকড় পরিমান মত নিয়ে বেটে তা দুপুরে গোসল করতে যাওয়ার ২-৩ ঘন্টা আগে সারা মাথায় ব্যবহার করতে হবে।কিছুদিন নিয়মিত ব্যবহার করলে একদিকে চুলের রঙ যেমন কালো হবে,তেমনি নতুন চুল ও গজাবে। এসব ছাড়াও আপাং গ্রহনী রোগে,কলেরা রোগে,বিষাক্ত ক্ষতে,বাগী রোগে কাজ করে
৭। প্রসাবের সমস্যায়
আপাং এর ক্বাথ (decoction) ৩০ থেকে ৫৮ গ্রাম মাত্রায় দিনে তিনবার সেবন করলে মূত্রকষ্ট দূর হয় এবং প্রচুর পরিমাণে প্রসাব হয়। মূত্রবৃদ্ধি করে বলে শোথ রোগে এর বহুল ব্যবহার আছে। ৫৮ গ্রাম আপাং চূর্ণ ১১৬ গ্রাম পানিতে ১৫ মিনিট সিদ্ধ করলে যে ক্বাথ পাওয়া যায় তা থেকে ৩০ গ্রাম হতে ৫৮ গ্রাম মাত্রায় দিনে তিনবার সেবন করলে প্রচুর প্রস্রাব হয় এবং শোথ রোগ কমে যায়।
৮। প্রসব সমস্যায়
এটা মৃদু জোলাপের কাজ করে। বৃহৎ মাত্রায় সেবন করলে প্রসব বেদনা ত্বরান্বিত হয় তাই গর্ভপাত ঘটানোর জন্য অনেক সময় এর ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আপাং এর ছাই এ প্রচুর পরিমাণ পটাশ আছে তাই এর ছাই অ্যান্টাসিড হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
৯। বক্ষব্যধিতে আপাং
সামান্য কারণেই যাদের বুক ধড়ফড়ানি শুরু হয় তাঁরা যেন প্রত্যহ সকালে ঠাণ্ডা পানি সহ এক চা-চামচ আপাং এর তাজা রস কিছুদিন নিয়মিত খান। তা হলে হৃদযন্ত্র সবল হবে।
১০। ক্ষুদা সমস্যায় আপাং
যাদের ক্ষিদে হয় না জোর করে খেলে হজম হয় না তাঁরা ৮ ভাগ আপাং-এর শিকড় এবং ১ ভাগ গোলমরিচ বেঁটে ছোট ছোট বড়ি তৈরি করবেন এবং বড়িগুলি ছায়াতে শুকিয়ে প্রত্যহ সকাল-বিকাল খাবারের পর পানিসহ একটি করে বড়ি খাবেন। এতে করে স্বাভাবিক ক্ষুধা তৈরি হবে।
১১। বিষ নষ্ট ও পাগল চিকিৎসায় আপাং
আপাং-এর ক্বাথ সেবন করলে নিদ্রাহীনতা দূর হয়। আপাং এর মূল ২৩ গ্রাম এবং শ্বেত বেড়েলার মূলের ছাল ৮২ গ্রাম একত্রে চূর্ণ বা মণ্ড করতে হবে। এর সাথে দেড় লিটার পানি ও আড়াই পোয়া গরুর দুধ মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে ৫৮ গ্রাম ক্বাথ প্রস্তুত করতে হবে। এই ক্বাথ প্রত্যহ সকালে উন্মাদ রোগীকে সেবন করতে দিলে উন্মাদ রোগ ভাল হয়। আপাং এর তাজা পাতা পিষ্ট করে বিষাক্ত কীট-পতঙ্গের দংশিত স্থানে লেপন করলে বিষ নষ্ট হয়ে যায়। আপাং-এর পুস্প চূর্ণ অল্প চিনির সাথে খেলে পাগলা কুকুরের বিষ নষ্ট হয়।
১২। বিভিন্ন রোগে আপাং
চোখের সমস্যায়- চোখের মণির অস্বচ্ছতা ও চোখ প্রদাহে মূলের মণ্ড ব্যবহৃত হয়।
রক্ত বন্ধ করতে- আপাং এর শিকড়ের নির্যাস রক্তপাত বন্ধ করে। কাটাস্থানে আপাং পাতাঁর রস দিলে সাথে সাথে রক্ত পড়া বন্ধ হয়।
১৩। ফোঁড়ার জন্য- আপাং
পাতা আতপ চালের সাথে বেঁটে ফোঁড়ার মুখ ছাড়া চারদিকে ঘিরিয়া প্রলেপ দিলে ফোঁড়া সহজে ফাটে।
১৪। শূল বেদনায়- শূল বেদনায় আপাং-
এর ছাই মধুর সাথে মিশিয়ে সেবন করা হয়। কাশি এবং হাঁপানিতে- কাশি এবং হাঁপানিতেও এটা ভাল কাজ করে থাকে।
১৫। জ্বর উঠলে আপাং
একদিন পর পর জ্বর উঠলে আপাং গাছের মূল ছেঁচে রস করে দিনে দু’ বার খেলে জ্বর ভাল হয়।
১৬। হাত,পা কেটে গেলে কচি পাতার রস দিলে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যায়।
১৭। রক্তক্ষরণ
বাহ্যিক রক্তক্ষরণে আক্রান্ত স্থানে আপাং পাতা পরিষ্কার করে ধুয়ে রস করে লাগালে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়।
১৮। শোথ
পাঁচ থেকে সাত গ্রাম আপাংগাছের সঙ্গে সমপরিমাণ কালোমেঘ মিশিয়ে দুই কাপ পানিতে জ্বাল করে এক কাপ হলে ছেঁকে নির্যাসটুকু নিন। এটা দিনে দুই থেকে তিনবার সেবন করলে উপকার পাওয়া যায়।
১৯। দ্রুত বীর্যপাত সমস্যার সমাধান।
শিঘ্র পতন, দ্রুত বীর্যপাত, দ্রুত বীর্য পাত না হওয়ার উপায়, বীর্য পাতলা, বীর্য তরল, বীর্য গাঢ় করার উপায়, বীর্য ধরে রাখার উপায় সহজে বীর্য পাত না হওয়ার উপায়, বীর্য স্তম্ভন, শুক্র স্তম্ভন, বীর্য স্তম্ভন করার উপায়, শুক্র স্তম্ভন করার উপায়।
আপাং সধারনত ২ রংয়ের সাদা ও লাল বা রক্ত আপাং বলে। রক্ত আপাং, এর শিকড় সমবার দিন তুলে সংগ্রহ করতে হবে এবং পরের দিন মঙ্গল বারে কোমরে ধারন করবেন। যে কোন সুত বা যেকোন কিছু দিয়ে ধারন করতে পারবেন। তারপর আস্তে আস্তে দ্রুত বীর্য পাত বন্ধ হয়ে উপকার পেতে শুরু করবেন।
২০। খোসপাঁচড়া ও চুলকানি
পাঁচ গ্রাম আপাংগাছ দুই কাপ পানিতে জ্বাল দিয়ে এক কাপ করে ছেঁকে পানিটুকুু দিনে দুই থেকে তিনবার পান করতে হবে। ১০ থেকে ১৫ দিন নিয়মিত পান করলে উপকার পাওয়া যাবে।
২১। মূত্রসংক্রমণ
দুই থেকে তিন চা চামচ পাতার রস এক গ্লাস ডাবের পানিতে মিশিয়ে প্রতিদিন দুই থেকে তিনবার পান করলে উপকার পাবেন। এটা সাত থেকে ১০ দিন নিয়মিত পান করতে হবে।
২২। বুক ধড়ফড়ানি
বিভিন্ন কারণে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। আপাংগাছ মূলসহ ছেঁচে রস করে ফ্রিজে রেখে প্রতিদিন সকালে এক চা চামচ কিছু না খেয়ে খালি পেটে পান করলে কমে যাবে। তবে এটা ১০ থেকে ১৫ দিন পান করতে হবে।
২৩। দাঁতের ব্যথায়
দাঁতের ব্যথায় ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায়। আপাংগাছের শুকনো গুঁড়া কুষ্ঠরোগ চিকিৎসায় ব্যবহার হয়। আপাংগাছের পাতা গনোরিয়া ও শ্বাসকষ্ট ভালো করে। পাতার রস পোকার কামড়ের প্রতিষেধক হিসেবে, শ্বাসকষ্ট, কান ও চোখের সমস্যায় ব্যবহৃত হয়। বীজের গুঁড়া মাখন ও দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে পিত্তে পাথর হয় না।
২৪। শোথ / হাত-পা ফোলা রোগে
আপাংগাছ আধা ছেচে ৭ গ্রাম পরিমাণ নিয়ে এর সঙ্গে সমপরিমাণ কালমেঘ মিশিয়ে দুই কাপ পানিতে জ্বাল দিয়ে এক কাপ করতে হবে। এরপর ছেঁকে ওই পানি পান করলে শোথ (হাত-পা ফোলা রোগে উপকার পাওয়া যাবে। নিয়মিত এক সপ্তাহ দিনে দু-তিনবার পান করলে পুরোপুরি ভালো হয়ে যাবে।
২৫। খোসপাঁচড়া ও চুলকানিতে
খোসপাঁচড়া ও চুলকানিতে পুরো গাছ আধা ছেচা করে ৭ গ্রাম পরিমাণ নিয়ে সঙ্গে সমপরিমাণ চিরতা ও নিম ছাল মিশিয়ে দুই কাপ পানিতে জ্বাল দিয়ে এক কাপ করতে হবে। এরপর ওই পানি ছেঁকে নিয়ে নির্যাসটুকু সেবন করতে হবে। ২০ থেকে ২৫ দিন নিয়মিত দিনে ২ বার পান করতে হবে।
২৬। মূত্র সংক্রমণ
আপাংগাছের সম্পূর্ণ অংশ মিহি গুঁড়া করে ৫ থেকে ৭ গ্রাম এক গ্লাস ডাবের পানির সঙ্গে মিশিয়ে দিনে দু-তিনবার পান করলে মূত্র সংক্রমণ ভালো হবে। এ ক্ষেত্রে ৭ থেকে ১০ দিন নিয়মিত সেবন করতে হবে।
২৭। পাকস্থলীর গোলযোগ নিরাময় করে, চর্মরোগ, বাতরোগ, সিফিলিস এবং ফুসফুসীয় রোগ ভাল করে।
২৮। ক্বাথ উদরাময়, আমাশয়, অতিরজ, অর্শ, বাত, অভ্যন্তরীণ অঙ্গ প্রদাহ, চর্মরোগ প্রভৃতি রোগে ব্যবহৃত হয়।
আগে এই গাছটি রাস্তার পাশে, পরিত্যক্ত জমিতে দেখা গেলেও সচারচার আর দেখা যায়না। প্রায় বিলুপ্তির পথে এই অতি মূল্যবান ঔষধি গুণ সম্পন্ন গাছটি। আপাং এর গাছ আমাদের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এর ঔষধি গুণাগুণ অনেক। আমাদের উচিত এর যথার্থ ব্যবহার করা।
আপাং গাছের ২৮ উপকারিতা ও ভেষজ গুণাবলী শিরোনামে লেখাটি লিখেছেন রাজশাহী কলেজ উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মোঃ ইব্রাহীম হোসেন।