মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: আমের কথা ভাবতেই রাজশাহী কিংবা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার কথা মনে ভেসে উঠে। কিন্তু গত এক দশকে আম চাষে পাল্টে গেছে উত্তরের আরেক জনপদ নওগাঁ। যা আমের নতুন রাজধানী হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে ইতোমধ্যেই। উঁচু ও শুকনো অঞ্চল হিসেবে পরিচিত পত্নীতলা, পোরশা, নিয়ামতপুর, সাপাহার উপজেলাসহ জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে গড়ে উঠছে ছোট ছোট আমের রাজত্ব।

জেলার আম চাষিদের দাবি, নওগাঁ জেলা পরিচিতির কারণ পোরশা- সাপাহারের ধান আর আম। তারা বলছেন, ধানের জন্য বিখ্যাত ছিল নওগাঁ। যেদিকে চোখ যায় দেখা যেত শুধু ধানক্ষেত। কিন্ত ২০০৯ সাল থেকে শুরু হয়েছে আমের বিল্পব। আনাচে-কানাচে গড়ে উঠছে আমবাগান। কৌশলে ধানের জমিতে বাড়তি ফসল হিসেবে আমের চাষ হয়ে উঠছে জনপ্রিয়।

কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সারাদেশে মোট আমের উৎপাদন ছিলো প্রায় ২৩ লাখ ৭২ হাজার টনের কিছু বেশি। এর মধ্য নওগাঁ থেকে আসে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৪৮৬ টন আম। যেখানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে এসেছে ২ লাখ ৭৫ হাজার টন এবং রাজশাহী থেকে এসেছে ২ লাখ ১৩ হাজার ৪২৬ টন। চলতি মৌসুমেও আম উৎপাদনে রাজশাহী কিংবা চাঁপাইনবাবগঞ্জকে ছাড়িয়ে যেতে পারে নওগাঁ।

পোরশা উপজেলার আমচাষি হাসিবুল এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, জেলায় এখন অনেক আম উৎপাদন হয়। আমার বাড়িতে একটা বাগান ছিল। ভাবলাম আম চাষের জন্য আরেকটা লিজ নিই। এখন দুই বাগানে আম আছে। তবে, এবার করোনায় কি হয় বলা যাচ্ছে না। আর আম সংরক্ষণের উপায় না থাকায় সমস্যা। তার আগেই আম বিক্রি হয়ে যায়।

এই আম চাষি বলেন, আল্লাহর রহমতে এবার গাছে অনেক আম। গত বছর ২৫’শ থেকে ৩ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। এবারও ভালো দামে বিক্রি হবে আশা করছি। বরাবরই ধানের চেয়ে আমের দাম বেশি। ৯’শ টাকা মণের ধানের চাইতে ৩ হাজার টাকা মণের আম চাষ বুদ্ধিমানের।

কয়েক উপজেলার আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জেলায় প্রায় ছোট-বড় ২৫০টি আমের আড়ৎ রয়েছে। প্রতি বছর এই আড়তগুলোর অধীনে কাজ করছেন প্রায় ১০ হাজার মৌসুমি শ্রমিক। আম নামানো থেকে শুরু করে পরিবহনে দিনরাত কাজ করেন তারা। এসব শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৬’শ থেকে ৮’শ টাকা। আবার মৌসুমের পুরোটাই কাজের জন্য অনেককে কিনে নেওয়া হয়। বাগান দেখাশুনা করা আর আম নামানোই তাদের কাজ।

আম চাষ বিষয়ে জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন এগ্রিকেয়ার ২৪.কমকে বলেন, বর্তমানে আম চাষে এগিয়েছে নওগাঁ। জেলায় অন্তত ৪৬ হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষের সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে নওগাঁয় দেশের সবচেয়ে বড় আমের বাজার গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। খাদ্য উদ্বৃত্ত এলাকা হলেও নওগাঁয় আম চাষ হচ্ছে বেশি। জেলায় আম্রপলি বা বারি-৩ জাতের আমের ফলন বেশি হচ্ছে। যে হারে নওগাঁয় আম চাষের আবাদ বাড়ছে, উৎপাদনের ধারা বৃদ্ধি রাখলে দেশের অর্থনীতিতে আম বিশেষ অবদান রাখবে।

জানা গেছে, জেলার সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদন হয় সাপাহারে ১ লাখ ১৯ হাজার ১৬০ টন, পোরশায় ১ লাখ ১৫ হাজার ১৯৯ টন, পত্নীতলায় ১ লাখ ১১ হাজার টন। চলতি মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে সম্ভাব্য ২৫০০ কোটি টাকার আম বিক্রি হবে।

আম রফতানিকারক ‘ফ্রুটস নওগাঁ’ স্বত্বাধিকারী এনামুল হক এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে জানান, এবার আমের বিষয়ে সন্দেহ আছে। পরিবহন চালু করা দরকার। গত পাঁচ বছর থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে জেলার ব্র্যান্ড আম্রপালি আম পাঠিয়েছি। তবে সাপাহারে যোগাযোগব্যবস্থা ও আম প্যাকিং ব্যবস্থা আরও উন্নত করা হলে এ জেলা আম কৃষি পণ্য রফতানির জন্য শীর্ষ অবস্থানে থাকবে।

সাপাহার আম আড়ৎ মালিক সমিতির আহ্বায়ক গোলাম মোস্তফা এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, এবার করোনায় শঙ্কা বাড়ছে। আর গত ১০ বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন সারাদেশের পাইকাররা আম কিনতে নওগাঁয় আসে। বাজার ব্যবস্থাপনা খুব ভালো হওয়ায় তারা আগ্রহ দেখায়।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক সামছুল ওদাদুদ এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, পোরশা, সাপাহার ও পত্নীতলা উপজেলায় বেশি আম উৎপাদন হয়। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বরেন্দ্র এলাকায় মাটির বৈশিষ্ট্যের কারণেই প্রচুর ফলন হয় আমের।

তিনি বলেন,এ বছর এ অঞ্চলে ধান ভালো হয়েছে। আমও ভালো হবে। এ আশা নওগাঁ পেরিয়ে আমের আরেক বড় রাজত্ব চাঁপাইনবাবগঞ্জেও রয়েছে। জেলায় এবার গতবারের চেয়ে ভালো ফলন হয়েছে। গত বছর জেলায় আম উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৭২ হাজার মেট্রিক টন তার তুলনায় চলতি বছর ৩ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন আম বাজারজাত হবে।

নওগাঁর প্রধান আম হচ্ছে আম্রপালি। এই আমের ওপর ভিত্তি করেই নওগাঁ ব্যান্ডিং হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আম্রপালি নামটি হাইব্রিড জাতের আম। উত্তর ভারতের হার্টথ্রব আম দুশেহেরি হলো এই আম্রপালির মা, আর দক্ষিণ ভারতের সুপার স্টার হিরো নিলম জাতের আম হলো এই আমের পিতা।

নওগাঁ জেলা প্রশাসক হারুন-অর রশিদ বলেন, নওগাঁয় দিন দিন বাড়ছে আমের ফলন। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে আম যাচ্ছে। তাছাড়া ২০২০ সাল থেকে বারি আম-৩ বা আম্রপালি বিখ্যাত কোম্পানি ওয়ালমার্টের চাহিদার তালিকায় রয়েছে। রফতানিযোগ্য আমের উৎপাদন বৃদ্ধিতে জেলা প্রশাসন সব ব্যবস্থা ইতোমধ্য শেষ করেছে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ