নারিকেল গাছ বিরাট উঁচু আকারের হয় এবং এর কোনো ডালপালা গজায় না । কচি নারিকেলকে ডাব বলে । নারিকেলের উপর যে স্তর থাকে তাকে ছোবড়া বলে। ছোবড়ার পরে একটি কঠিন খোলা বা খোলস থাকে । এই কঠিন খোলার ভিতরে সাদা রঙের শাঁস ও পানি থাকে।আসুন জেনে নিই নারিকেল পরিচিতি ও চাষ পদ্ধতি। লেখাটি লিখেছেন এম এনামুল হক, মহাপরিচালক (অব.), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

নারিকেল বাংলাদেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল। এটা এমন এক বৃক্ষ যার প্রতিটি অঙ্গ জনজীবনে কোনো না কোনোভাবে কাজে আসে। এ গাছের পাতা, ফুল, ফল, কাণ্ড, শিকড় সব কিছুই বিভিন্ন ছোট-বড় শিল্পের কাঁচা মাল, হরেকরকম মুখরোচক নানা পদের সুস্বাদু খাবার তৈরির উপকরণ, পুষ্টিতে সমৃদ্ধ, সুস্বাদু পানীয়, রোগীর পথ্য এসব গুণে গুণাম্বিত এটি পৃথিবীর অপূর্ব গাছ, তথা ‘স্বর্গীয় গাছ’ হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত ও সুপরিচিত।

উৎপত্তিস্থান ও বিস্তার : নারিকেলের আদিস্থান প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ। এসব স্থান থেকেই পরবর্তীতে শ্রীলংকা, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, চীন, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাপুয়া গিনি, ওশেনিয়া, আফ্রিকা, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, ঘানাসহ পৃথিবীর প্রায় ৯৩টা দেশে এর বিস্তার ঘটে। তবে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনস এবং ভারত নারিকেল উৎপাদনে অতি অগ্রগামী।

পুষ্টিমান ও গুণাগুণ : ডাব ও নারিকেলের সব অংশই আহার উপযোগী, শাঁস (Copra/Carnel) অতি পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। এতে প্রচুর পরিমাণ চর্বি, আমিষ, শর্করা, ক্যালসিয়াম, ভিটামিনস ও খনিজ লবণে ভরপুর। এতগুলো খাদ্য উপাদান একত্রে কোনো ফলে প্রাপ্তি একটা বিরল দৃষ্টান্ত। কিছু অসুখে ডাবের পানি রোগীদের অন্যতম পথ্য। এর মধ্যে ডায়রিয়া, কলেরা, জন্ডিস, পাতলা দাস্ত, পানিশূন্যতা পূরণে ডাবের পানির অবদান অন্যন্য। ঘন ঘন বমি ও পাতলা পায়খানার কারণে শরীর দুর্বল হয়ে পড়লে এ সময় স্যালাইনের বিকল্প হিসেবে ডাক্তার/কবিরাজরা ডাবের পানি পান অব্যাহত রাখতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অনেক ভিনদেশি, যারা এ দেশের মিনারেল পানি পানে সন্ধিহান হয়, সেখানে অবাধে তারা ডাবের পানি পেলে পরম তৃপ্তিতে তা পান করে।

নারিকেল এ দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল। এটি এমন একটি বৃক্ষ যার মূল, কাণ্ড, ফুল, ফল, পাতা সব অংশই জনজীবনে নানা কাজে ব্যবহার হয়। যা অন্য কোনো গাছ থেকে এ ধরনের সুবিধা পাওয়া যায় না। নারিকেল কেশতেল, ভোজ্যতেল, কোকো মিল্ক, শাঁস (Copra/Carnel) দিয়ে তৈরি মোরব্বা, পাঁপড়ি, মোয়া, নানাভাবে তৈরি পিঠা, পায়েশ, হালুয়া, কোকো মিল্ক দিয়ে নানা পদের সুস্বাদু খাবার সবাইকে আকৃষ্ট করে।

জাত : পূর্বে নারিকেল চাষ সম্প্রসারণে মাতৃগাছ নির্বাচন করে সেগুলো থেকে উন্নত জাতগুলোর (Open pollinated) বিস্তার ঘটানো হতো। পরবর্তীতে নারিকেল চাষে অগ্রগামী দেশগুলো (শ্রীলংকা, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, পাপুয়ানিউগিনি)সঙ্করায়ণ/ক্রসিংয়ের (Hybridization) মাধ্যমে উন্নত জাত সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করে। এগুলো মূলত খাটো জাত (D X D), আংশিক খাটো (DXT) এবং লম্বা (Tall) এসব উদ্ভাবিত জাত বিভিন্ন চাহিদা বিবেচনায় এনে (ডাবের পানির জন্য, নারিকেলের ভেতরের আহার্য্য অংশের (Carnel/copra) প্রয়োজনে, নারিকেলভিত্তিক বিভিন্ন শিল্পকারখানার চাহিদা পূরণ ও এলাকার সৌন্দর্য আহরণের দিকগুলো বিবেচনায় এনে, নানা ধরন/আকারের, রঙ বেরঙের খাটো ও আংশিক খাটো জাতের নারিকেল উদ্ভাবন কাজ অব্যাহত রয়েছে এবং তা দ্রুত সর্বত্র বিস্তার ঘটছে।

বারী উদ্ভাবিত নারিকেল : বারী নারিকেল-১ এবং বারী নারিকেল-২ নামে তারা দুটা নারিকেলের জাত অবমুক্ত করেছে। জাত দুটাই ওপি (Open pollinated) লম্বা জাত (D×T) । এ জাত দুটো উপকূলীয় এলাকার ভেতরের অংশে সম্প্রসারণ যোগ্য।

গোত্র ও গাছের বিবরণ : নারিকেল, পাম (Palmae) পরিবারভুক্ত। তাল, খেজুর, সুপারি, পামঅয়েল, এগুলো সবই এ গোত্রীয়। এর রোপণ, পরিচর্যা, খাদ্যাভ্যাসে প্রচুর মিল। নারিকেলের বৈজ্ঞানিক নাম Cocos nucifera  এ পরিবারভুক্ত গাছের ডাল, শাখা, প্রশাখা নেই। কেবল কাণ্ডকে আকড়ে ধরে তা থেকে সরাসরি বের হওয়া লম্বা পাতাগুলোই জীবনধারণের জন্য এ গাছের একমাত্র অবলম্বন। একটা সুস্থ নারিকেল গাছের পাতা লম্বায় জাতভেদে ২.৫-৩.৫ মিটার হতে পারে। সুস্থ, সবল একটা গাছের পাতার সংখ্যা ৩০-৪০টা।

পাতাগুলো যত উপরমুখী হবে এবং সংখ্যায় তা যত বেশি হবে, গাছ সাধারণত তত বেশি ফুল-ফল দানে সক্ষম হবে। ভালো যত্ন ও সঠিক ব্যবস্থাপনায় কাণ্ড থেকে প্রতি মাসে একটা করে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে পাতা বের হয় এবং সে পাতার গোড়ালি থেকে বয়স্ক গাছে ফুল-ফলের কাঁদি বের হয়। গাছের কচি পাতা বের হয় আকাশমুখী হয়ে, একবারে খাঁড়াভাবে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাতাগুলো নিচের দিকে হেলে পড়তে থাকে। পাতা গজানো থেকে আরম্ভ করে পরে তা একেবারে নিচে হেলে পড়ে গাছের কাণ্ডকে স্পর্শ করে। এ পথ পাড়ি দিতে একটা পাতার সময় লাগে প্রায় ৩ বছর। ঘন, সবুজ গজানো পাতাটা শেষ বয়সে হলুদ রঙ ধারণ করে, পরে তা শুকিয়ে যাওয়ার পূর্ব ঘোষণা দেয়।

এ পাতা হলুদ হয়ে শুকানোর আগ পর্যন্ত কোনো মতেই কেটে ফেলা যাবে না। এ গাছ ঠিক কলা গাছের মতো ‘রুয়ে কলা না কেটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত’ খনার বচনটা এ গাছের জন্য একেবারে প্রযোজ্য। যেহেতু একটা সুস্থ গাছে প্রতি মাসে একটা করে পাতা বের হয় এবং তা প্রায় তিন বছরের মতো বাঁচে সে হিসাব করলে একটা ফলন্ত, সুস্থ, সবল গাছে ৩৫-৪০টা পাতা থাকার কথা। গাছে এ সংখ্যা ২৫টার নিচে থাকলে ধরে নিতে হবে গাছটা খাবার ও যত্নের অভাবে বড় কষ্টে আছে। পাতার সংখ্যা ২০টার নিচে নেমে গেলে গাছে ফুল ফল ধরা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে চলে যাবে।

জলবায়ু ও মাটি : ট্রপিক্যাল ও সাব ট্রপিক্যাল অংশে অবস্থিত দেশগুলোতে মূলত নারিকেল ভালো জন্মে। এ গাছের জন্য উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া অতি উপযোগী। নারিকেলের জন্য বার্ষিক গড় ২৭০ সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেশি উপযোগী। তবে দিবা-রাত্রির তাপমাত্রার পার্থক্য ৬-৭০ সেলসিয়াস হলে নারিকেল গাছের জন্য ভালো হয়। বছরে কি পরিমাণ বৃষ্টিপাত হলো তা বড় কথা নয়, সারা বছর ধরে কিছু না কিছু বৃষ্টির পানি নারিকেল গাছ পেল তা-ই আসল কথা। বছরে ১০০-৩০০ সেমি. বৃষ্টিপাত নারিকেলের জন্য যথেষ্ট। বিশেষ করে উপকূলীয় উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়া নারিকেল চাষে অতি উপযোগী। অর্থাৎ সফলভাবে নারিকেল চাষ সম্প্রসারণের জন্য যেসব অনুকূল জলবায়ু দরকার তা সবই দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল কোস্টাল বেল্টে বিরাজ করছে। প্রাকৃতিক এ অবদানকে কাজে লাগিয়ে এ অঞ্চলে নারিকেল চাষ ব্যাপক সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া আমাদের সবারই কর্তব্য।

মাটি : নারিকেল যে কোনো ধরনের মাটিতে ফলানো যায়। শিলা, কাঁকরময়, লাভা, পিট, বালুময় স্থানেও বিশেষ ব্যবস্থায় নারিকেল চাষ উপযোগী করতে তেমন অসুবিধা নেই। যেহেতু, বয়স্ক নারিকেল গাছের শিকড় ৪ মিটার চওড়া এবং এক মিটার গভীরতায় সীমাবদ্ধ থাকে, সেহেতু তেমন প্রয়োজন পড়লে অনাকাক্ষিত এ পরিমাণ অংশের মাটি ও তাতে অন্যান্য বিদ্যমান পদার্থ অপসারণ (১.২মি.×১.২মি. ×১.২মি.) করে তাতে নারিকেল চারা লাগানো উত্তম হবে। এ গর্তের নিম্ন অংশে দু’টি স্তর/সারি নারিকেল ছোবড়া দিয়ে (সমান অংশ নিচে ও ছোবড়ার অসমতল অংশ উপরে রেখে) ভালোভাবে সাজিয়ে তার উপরিভাগে এক ভাগ বেলে দোঁ-আশ মাটি, (Top lose soil) এক ভাগ পচা গোবরের গুঁড়া, এক ভাগ ছাই এবং এক ভাগ কোকো ডাস্ট (নারিকেলের ছোবড়া থেকে প্রাপ্ত গুঁড়া) মিশ্রণ দিয়ে ৬০ সেমি. পর্যন্ত গর্তের তলার অংশ ভালোভাবে ভরাট করতে হবে।

এ অংশে ৭০-৮০ গ্রাম ফুরাডান/বাসুডিন-১০জি বা অন্য কোনো উঁইপোকা নিধন করা কীটনাশক মিশানো ভালো হবে। এছাড়া মাটি এসিডিক (অম্ল) হলে ৫০০ গ্রাম ডলোচুন এবং তলার মাটি বেশি শক্ত হলে ৫০০ গ্রাম লবণ মিশাতে হবে।

স্বাভাবিক মাটির ক্ষেত্রে গর্তের সাইজ ১ মি.× ১ মি.×১ মি. হবে। তলার অংশ ৬০ সেমি. এর পরিবর্তে তা হবে ৫০ সেমি. এবং একইভাবে এ অংশ ভরাট করতে হবে। এরপর গর্তের অবশিষ্ট অংশ দো-আঁশ/বেলে দোঁ-আশ মাটিসহ সার দিয়ে ভরাট করে তথায় চারা লাগালে গাছ ভালোভাবে বাড়বে এবং তা থেকে আগাম ফুল-ফল ধরবে।

বংশবিস্তার : বীজ থেকে চারা উৎপাদন করে সব ধরনের পাম বৃক্ষের বংশবিস্তার করা হয়। তবে টিস্যু কালচার করেও একেক দফায় নারিকেলের কোটি কোটি চারা উৎপাদন করা সম্ভব। এভাবে চারা উৎপাদন করে বড় করে লাগানোর উপযোগী করতে ৩-৪ বছর সময় নিবে। এ প্রক্রিয়ায় চারা তৈরি কেবল গবেষণা কাজে ব্যবহার হয়। তাই পরিপক্ব বীজ নারিকেল থেকে চারা (Sexual propagation) উৎপাদন করা একমাত্র সহজ ও প্রচলিত জনপ্রিয় উপায়।

চারা উৎপাদন পদ্ধতি : নারিকেল চারা তৈরির জন্য যেখান সেখান থেকে বীজ নারিকেল সংগ্রহ করা উচিত হবে না। অজানা উৎস থেকে সংগৃহীত নারিকেল বীজ থেকে উৎপাদিত চারায় গাছ থেকে যে ডাব/নারিকেলের ফলন হবে তা নিম্ন মানের। যে গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা হবে তার মাতৃ গুণাগুণ (Genetical potenciality) জেনেই উন্নত মানের ও জাতের গাছ থেকে সুস্থ, ভালো মানের বীজ নারিকেল সংগ্রহ করে তা চারা উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা যাবে। যেহেতু নারিকেল চারা উৎপাদন কাজটি অতি সহজ, তাই নিজে ভালো জাতের বীজ লাগিয়ে চাহিদা মতো চারা তৈরি করে নেয়া ভালো। এলাকার পাড়া-পড়শীর কারও না কারও নারিকেল গাছে প্রচুর ফল দেয়, এমন সুলক্ষণা কিছুসংখ্যক মাতৃগাছ নির্বাচন করে তা থেকে পাকা বীজ নারিকেল কিনে, বেঁলেমাটিতে রেখে মাঝে মাঝে পানি দিলে কিছু দিনের মধ্যই চারা গজাবে। এ গজানো চারাগুলো ৮-৯ মাস পরেই লাগানোর উপযোগী হবে।

জমি নির্বাচন ও চারা রোপণ
পানি জমে থাকে বা জমি স্যাঁতসেঁতে ভাব থাকে এমন স্থানে নারিকেল চারা রোপণ করা ঠিক হবে না। তবে এ ধরনের নিচু জমিতে (৬ মি.×৭ মি.) দূরত্বে চারা লাগানোর জন্য ‘লে আউট প্লান’ করে নিতে হবে। এরপর দুই সারির মাঝে ৩ মিটার চওড়া এবং ৩০-৬০ সে. মিটার গভীর নালা কেটে নালার মাটি দুই ধারে উঠিয়ে উঁচু করে ৩ মিটার চওড়া উঁচু আইলে চারা রোপণের জন্য উপযোগী হবে। দুই সারির মাঝখানে অগভীর নালায় পানিতে জন্মে (কচুরলতি, পানিকচু, চিবিয়ে খাওয়া আখ) এমন ফসল আবাদ করা যাবে। এধরনের অগভীর জলভূমিতে বিদেশে (বিশেষ করে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া) এভাবে তৈরি উঁচু চওড়া আইলে বিভিন্ন ধরনের ফল চাষ এবং মধ্যভাগের নালায় মাছ চাষ ও জলজ ফসল আবাদ পদ্ধতি অতি জনপ্রিয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে বিশেষ করে বরিশাল এলাকায় এ পদ্ধতিতে চাষ প্রচলন আছে যা সর্জন পদ্ধতি নামে সুপরিচিত। বর্ষার পানি জমে না থাকলে উঁচু বা মাঝারি উঁচু, বন্যামুক্ত জমিতে নারিকেল লাগানোর জন্য অন্যান্য ফল বাগানের মতো আগেই একটা ‘লে আউট প্লান’ করে নিয়ে চারা রোপণের পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে হবে।

মাদা তৈরি : প্রকৃত খাটো জাতের জন্য (৬ মি.×৬ মি.) দূরত্ব, আংশিক খাটো জাতের (৬ মি. ×৭ মি.), এবং লম্বা বা আমাদের দেশি উন্নত জাতের ক্ষেত্রে (৭ মি.×৭ মি.) দূরত্বে নারিকেল চারা লাগানো ভালো। চারা রোপণের ২-৩ সপ্তাহ আগে ‘লে আউট প্লান’ অনুসরণ করে নির্ধারিত স্থানে গর্ত তৈরি করে নিয়ে তাতে সার প্রয়োগ করে নেয়া উত্তম হবে।

চারা রোপণ  
নির্বাচিত চারা বীজতলা থেকে খোন্তা বা শাবল দিয়ে সাবধানে যত্ন সহকারে উঠিয়ে নিতে হবে। কোনো মতেই চারা গাছ ধরে টেনে উঠানো যাবে না। চারা উঠানোর পর যতদূর সম্ভব এক সপ্তাহের মধ্যেই তা রোপণ কাজ শেষ করতে হবে। নারিকেল চারা গর্তে বসানোর পূর্বে খেয়াল রাখতে হবে যেন সরেজমিন থেকে চারাটা ২০-২৫ সেমি. নিচে বসানো হয় এবং নারিকেলের অংশটা মাটিতে সম্পূর্ণ না পুঁতে নারিকেলের উপরের অংশ কিছুটা (৩-৫ সেমি.) দেখা যায়। এ অবস্থায় সরেজমিন থেকে নিচে লাগানোর ফলে বর্ষাকালে বাইরের পানি এসে গাছের গোড়ায় বাইরের পানি এসে যেন জমতে না পারে এজন্য গাছের গোড়া থেকে ৪০-৫০ সেমি. দূরে বৃত্তাকারে ভালোভাবে সরেজমিন থেকে ১০-১৫ সেমি. উঁচু করে বাঁধ দিতে হবে। সচরাচর দেখা যায় ফলন্ত নারিকেল গাছের গোড়ার অংশ অস্বাভাবিকভাবে মোটা হয় এবং সেখান থেকে প্রচুর শিকড় ভেসে থাকে যা দৃষ্টিকটু।

সমতল ভূমি থেকে ২০-২৫ সেমি. নিচে চারা লাগানো হলে এভাবে গোড়ার অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে গাছকে রক্ষা করা যাবে। তবে পুকুরপাড়, বাঁধের ধার ও ঢালুতে নারিকেল চারা লাগানোর প্রয়োজনে সমতল থেকে ২০ সেমি. স্তরের পরিবর্তে তা বাড়িয়ে ৩০ সেমি. নিচে চারা লাগাতে হবে।

সার প্রয়োগ : অন্যান্য গাছের তুলনায় নারিকেল গাছে সার ও পানি সেচ, নিষ্কাশন ব্যবস্থা ঠিকমতো হলে গাছের বাড়-বাড়ন্ত খুব বেশি বৃদ্ধি পায়। অন্য খাদ্যের তুলনায় এ গাছে পটাশ জাতীয় খাবারের চাহিদা তুলনামূলক বেশি (Potash loving plant) সাধারণত সুপারিশকৃত সার বছরে দু’বার (বর্ষার আগে ও পরে) সার প্রয়োগ প্রচলন আছে।

ক্রঃ নং আইটেম ১ম বছর ২য় বছর ৩য় বছর ৪থ বছর ও ঊর্ধে
পচা গোবর/আবজনা পচা সার (কেজি) ৪০ ২৫ ২৫ ৩০
ছাই (কেজি) ১০ ১০ ১০ ১০
মুরগি লিটার পচা (কেজি) ১৬ ১৬ ১৬ ১৬
হাড়ের গুঁড়া/শুটকি মাছের গুঁড়া (কেজি)
ইউরিয়া (গ্রাম) ৬০০ ১২০০ ১৪০০ ১৬০০
টিএসপি (গ্রাম) ৩০০ ৪০০ ৬০০ ৮০০
এমওপি (গ্রাম) ৪০০ ৬০০ ১০০০ ১৫০০
ম্যাগনেশিয়াম সালফেট (গ্রাম) ১০০ ১৫০ ১৫০ ১৫০
বোরন গ্রাম ৫০ ১০০ ১০০ ১০০

চারা রোপণের ৩ মাস পর লাগানো চারার গোড়া থেকে ২০ সেমি. দূরে ২০ সেমি. চওড়া ও ১০ সেমি. গভীর করে যেসব সার প্রয়োগ করতে হবে তা হলো পচা গোবর বা আবর্জনা পচাসার  ১০ কেজি, ইউরিয়া ১২৫ গ্রাম,

টিএসপি : ১০০ গ্রাম এবং এমওপি সার ২৫০ গ্রাম। এ সারগুলো ৩ মাসের ব্যবধানে আরও দুইবার প্রয়োগ করতে হবে। তবে পরের প্রতিবার গাছের গোড়া থেকে কিছু দূরে (৫-৭) সেমি. গাছের গোড়ার চারদিকে নালা তৈরি করে একইভাবে প্রয়োগ ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিবার সার প্রয়োগ শেষে ২ বালতি পানি দিয়ে গোড়া ভালোভাবে ভেজাতে হবে। খাটো গাছের নারিকেল সঠিক মাত্রায় সার প্রয়োগ, পানি সেচ, পানি নিকাশ ও পরিচর্যা গ্রহণ করলে চারা রোপণের ৩-৪ বছর থেকেই ফুল-ফল ধরা আরম্ভ করবে। চতুর্থ বছরে জন্য যে সার সুপারিশ করা গেল তা পরবর্তী বছরগুলোতে প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে। চারা রোপণের পর থেকে চার বছর পর্যন্ত বছর বছর যে পরিমাণ সার ব্যবহার করতে হবে তা নিম্নরূপ :
ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ও বোরন ৬ মাসের ব্যবধানে বছরে দুইবার প্রয়োগ যোগ্য।

পরিচর্যা : নারিকেল বাগান বিশেষ করে গাছের গোড়ার চারধার সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে। প্রথম ২ বছর গাছের গোড়া থেকে ৬০-৭০ সেমি. দুর পর্যন্ত বৃত্তাকারে চারদিকের অংশে কচুরিপানা শুকিয়ে ছোট করে কেটে ৮-১০ সেমি. পুরু করে মালচিং দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে গাছের গোড়া ঠাণ্ডা থাকবে, আগাছা জন্মাবে না, মাটির রস সংরক্ষিত থাকবে এবং পরবর্তীতে এগুলো পচে জৈবসার হিসাবে কাজ করবে। তবে এভাবে মালচিং দেয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন তা একেবারে গাছের কা-কে স্পর্শ না করে, গাছের গোড়ার অংশ কমপক্ষে ৮-১০ সেমি. ফাঁকা রাখতে হবে। বিকল্প হিসাবে চীনাবাদামের খোসা, ধানের তুষ, আখের ছোবড়া, কাঠের গুঁড়া, নারিকেলের ছোবড়া, গাছের শুকনা পাতা, সমুদ্রের শ্যাওলা, বিভিন্ন খড়-কুটা, লতাপাতা মালচিং হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। মালচিং অবস্থায় অনেক সময় উঁই পোকাসহ অন্যান্য পোকা মালচিং ব্যবস্থাকে আবাসন হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এ জন্য সেভিন, ইমিটাপ, রিজেন্ট, ডারসবান ইত্যাদি দলীয় যে কোনো কীটনাশক দিয়ে ১০-১৫ দিন পর পর স্প্রে করা হলে পোকার আবাসন ধ্বংস হবে। গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকা অথবা মাটিতে রস কমে গেলে উভয় ক্ষেত্রেই নারিকেল গাছ অত্যন্ত কষ্ট পায়। এ জন্য বর্ষাকালে গাছ যেন কোনো মতেই জলাবদ্ধতার (Water lodging) কারণে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, এজন্য ঠিকমতো নালা কেটে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া খরা মৌসুমে নারিকেল বাগানের মাটিতে যেন পরিমিত রস থাকে এ জন্য ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে নিয়মিত সেচ দিতে হবে।

পোকামাকড় ও রোগবালাই : নারিকেল গাছে যে সব পোকামাকড়ের উপদ্রব সচরাচর দেখা যায় এগুলোর মধ্যে গণ্ডার পোকা, রেড পাম উইভিল, পাতা কাটা পোকা, কালো মাথা শুয়ো পোকা, লাল মাকড় (Red mite) ও উঁইপোকা অন্যতম। এছাড়াও এলাকা বিশেষে রয়েছে ইঁদুর ও কাঠ বিড়ালির আনাগোনা। এরা নারিকেলের কচি ফুল-ফল খায় কম, নষ্ট করে ৫-৭ গুণ বেশি। গণ্ডার পোকা ও উইভিল দমনে অর্গানো ফসফরাস দলীয় যে কোনো কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ৪-৫ গ্রাম মিশিয়ে স্প্রে করলে তা দমন করা যাবে এবং প্রতি লিটার পানিতে ১-১.৫ গ্রাম ওমাইট/ভার্টিমেক্স নামক মাকড়নাশক ব্যবহার করে রেড মাইট দমন করা যাবে।
রোগবালাই : নারিকেলে রোগের মধ্যে কুঁড়ি পচা, ফল পচা, ফলঝরা, পাতায় দাগ পড়া, ছোটপাতা, কাণ্ডে রস ঝরা ও শিকড় পচা রোগ অন্যতম। কুঁড়ি পচা, ফল পচা ও ফল ঝরা রোগ দমনে প্রতি লিটার পানিতে ম্যানকোজেব দলীয় ছত্রাকনাশক দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ২-৩ বার স্প্রে করলে এসব রোগ দমন হবে।

নারিকেল গাছে ফল ঝরা সমস্যা ও সম্ভাব্য সমাধান : অনেক সময় ছোট অবস্থায় নারিকেল ফল ঝরে পড়ে। কখনও নারিকেলের ভেতরে শাঁস কম হয়, আবার কখনও ডাবে তেমন পানি থাকে না। এ ধরনের সমস্যা ও উহার সম্ভাব্য সমাধানের প্রধান দিকগুলো নিম্নরুপ

গাছ লাগানোর ৫-৭ বছর পর থেকেই গাছে ফুল-ফল ধরা আরম্ভ করে। প্রথম ২-৩ বছর গাছে ফুল-ফল ধরা ক্ষমতা অপূর্ণ থাকে। ফলে এ সময় ফুল-ফল বেশি ঝরে পড়া তেমন কোনো অস্বাভাবিকতা নয়।

নারিকেল গাছের কাছাকাছি অন্য কোনো ফলন্ত নারিকেল গাছ থাকলে প্রয়োজনীয় পরাগ রেণু প্রাপ্তি সম্ভাবনা বেশি থাকে। এজন্য আশপাশে ফলন্ত নারিকেল গাছ থাকা ভালো। অনেক সময় কচি ফলের প্রাথমিক অবস্থায় ভ্রুণ নষ্ট (Abortion)) হওয়ার কারণেও নারিকেল গাছে ফল ধরা ব্যাহত হয়।

শুকনা মৌসুমে অনেক দিন পর হঠাৎ বৃষ্টি হলে এবং এ বর্ষণ ৫-৭ দিন ধরে চলতে থাকলে ফুলে ফল ধরার জন্য পরাগায়ন সমস্যা হয়। এ সমস্যা দুইভাবে হতে পারে

প্রথমত : পুরুষ ফুলের পরাগ রেণু ধুয়ে পড়ে যাওয়া এবং স্ত্রী ফুলের আগায় পরাগ রেণু পড়ে তা পরাগায়ন সুবিধার জন্য যে মধু বা নেকটার থাকে তা ধুয়ে গেলে পরাগায়ন ক্ষমতা হারায়।

দ্বিতীয়ত : দীর্ঘ সময় অনাবৃষ্টি ও শুকনা হাওয়ার পর হঠাৎ বৃষ্টিপাতের ফলে তাপমাত্রার অনেক ব্যবধান (দীর্ঘ কাল গরমের পর হঠাৎ ঠাণ্ডা পড়া) সৃষ্টি হয়, যা ফুল থেকে ফল ধরতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। বেশি সময় ধরে শুকনা ঝড়ো বাতাসের প্রভাবেও নারিকেল গাছের পরাগ রেণু ঝরে পড়ে, মৌমাছির তৎপরতা এ ধরনের প্রতিকূল আবহাওয়ায় প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। যা পরাগায়নে প্রতিকূল প্রভাব পড়ে।

অনেক সময় দেখা যায় নারিকেল গাছের লাগানো জাতটা নিম্ন মানের, স্ত্রী-পুরুষ উভয় ফুল-ফল ধরার ক্ষমতা কম থাকে, যা জাতগত (Genetical)  কারণে হয়ে থাকে।
ফুল-ফল ধরাকালে নারিকেল গাছে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণের প্রভাব গাছে ফুল-ফল ঝরার অন্যতম কারণ। এজন্য নারিকেল গাছ যেন সব সময় রোগবালাইমুক্ত থাকে সে ব্যবস্থা অবশ্যই নিতে হবে।

সর্বোপরি গাছে প্রয়োজনীয় খাবারের অভাব দেখা দিলে, বিশেষ করে পটাশ, বোরন ও ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি ও অন্যান্য অনু খাদ্যের ঘাটতি দেখা দিলে বয়স্ক গাছে ফল ধরার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়ে। এত গুণে গুণান্বিত এ উপকারী বৃক্ষ সম্প্রসারণে সবাই এগিয়ে আসবেন এবং আগে রোপিত গাছকে পরিচর্যা ও নিয়মিত খাবার পরিবেশন করে সুফল ভোগ করুন এটাই কাম্য।