এগিয়ে যাচ্ছে সামুদ্রিক শৈবাল

ডেস্ক প্রতিবেদন, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: দেশে এগিয়ে যাচ্ছে সামুদ্রিক শৈবাল চাষের গবেষণা কার্ক্রম। দেশের উপকূলীয় তটরেখার দৈর্ঘ্য প্রায় ৭১০ কিলোমিটার যেখানে ২৫০০০ বর্গ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা বিস্তৃত।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট জানায়, বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট-মার্টিন্স প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া সামদ্রিক শৈবালের প্রধান আধার। প্রাপ্ত তথ্য মতে সেখানে তিনটি গ্রæপের ২১৫ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল (সীউইড) রয়েছে।

সামুদ্রিক শৈবালে প্রচুর পরিমাণে বিটা কেরোটিনযুক্ত ভিটামিন এ, ভিটামিন বি-১২, ভিটামিন সি, ডি, ই এবং কে রয়েছে। সামুদ্রিক শৈবাল মানব দেহে উচ্চ রক্তচাপ কমায় এবং স্বল্প কোলেস্টরেল বজায় রাখে ও স্ট্রোক প্রতিহত করে। সামুদ্রিক শৈবাল হতে এগার, কেরাগিনান এবং এলগিনেট আহরণ হয় যা খাবার শিল্প কারখানায় এবং ওষুধ শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

বিশ্বের বহুদেশে এই সামুদ্রিক শৈবাল মানুষের খাদ্যে পুষ্টি বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের দেশেও এই সামুদ্রিক শৈবাল চাষাবাদ করে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর সরেজমিন গবেষণা বিভাগ কেজিএফ এর অর্থায়নে এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সমন্বয়ে জানুয়ারি ২০১৬ সালে Capacity Building for Conducting Adaptive Trials on Seaweed Cultivation in Coastal Areas শীর্ষক একটি প্রকল্প স্বল্প পরিসরে (জানুয়ারি ২০১৬-ডিসেম্বর ২০১৭) কক্সবাজারে বাস্তবায়ন করছে।

এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের উপযোগি সামুদ্রিক শৈবালসমূহ চিহ্নিতকরণ, খাবার হিসেবে এবং শিল্পে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সামুদ্রিক শৈবাল চাষের ধারণা ও প্রযুক্তিগত কলাকৌশল প্রচার ও বাজারজাতকরণ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে চাষীদের অবহিতকরণ।

এই প্রকল্পের আওতায় সেন্ট মার্টিনস্ থেকে সাতটি প্রজাতির সীউইড (Hypnea, Caulerpa, Asparagopsis, Spatoglossum, Dictyota, SargassumGes Ulva) সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে টেকনাফেএকটি চিংড়ি ঘেরে সংগৃহীত সাতটি প্রজাতি নিয়ে পরীক্ষা স্থাপন করা হয়। তিনটি প্রজাতি যেমন হিপনিয়া মাসিফরমিস, হিপনিয়া বের্জেসেী ও কলারপা রেসিমোসা সাফল্যজনকভাবে চাষ করা গেছে।

উন্মুক্ত সমুদ্রে সামুদ্রিক শৈবাল চাষের জন্য কক্সবাজারে নুনিয়ারছড়াকে নির্বাচন করা হয়। উন্মুক্ত সমুদ্রে সামুদ্রিক শৈবাল চাষের জন্য যে সকল পরিবেশ থাকা দরকার তা কক্সবাজারের নুনিয়ারছড়ায় বিদ্যমান যেমন- অপেক্ষাকৃত সমতল তটরেখা এবং অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত পরিষ্কার স্বচ্ছ লবণাক্ত পানি (লবণাক্ততা ৩০-৩২ পিপিটি), কম ঢেউ ও রাতে এবং সহনীয় তাপমাত্রা (২৫-৩২ ডিগ্রী সেলসিয়াস) থাকা। তাই ২০১৬ সালে অক্টোবর মাস থেকে নুনিয়ারছড়া, কক্সবাজারে খোলা সমুদ্রে সংগৃহীত সাতটি প্রজাতি নিয়ে পরীক্ষা স্থাপন করা হয়।

পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো ফলন পাওয়া যায় হিপনিয়া মাসিফরমিস প্রজাতি থেকে। নুনিয়ারছড়া, কক্সবাজারে উন্মুক্ত সমুদ্রে হিপনিয়া প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেচাষ করা হয় যেমন- একক রশি ও দ্বৈত রশি পদ্ধতি। দুই প্রান্তে দুইটি বাঁশ দিয়ে মাঝখানে রশিতে প্রায় ১৫ সেমি পর পর শৈবালের অংশবিশেষ আটকিয়ে সমুদ্র উপকুলে ফ্লোট দিয়ে সমুদ্রের পানিতে ভাসিয়ে রেখে জন্মানো হয়।

জোয়ার ভাটার লবণাক্ত পানিতে প্রতিদিন ৪.০ সেমি লম্বা হয় এই শৈবাল। একক রশি পদ্ধতিতে ৩০ দিনে প্রতি বর্গমিটারে গড়ে ৩.১৭ কেজি এবং দ্বৈত রশি পদ্ধতিতে ২.৮৯ কেজি ফলন পাওয়া যায়।

এভাবে অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত ৬ মাসে ৬ বার সীউইড সংগ্রহ করে একক রশি পদ্ধতিতে প্রতি হেক্টরে প্রায় ১৯.০ মেট্রিক টন ও দ্বৈত রশি পদ্ধতিতে প্রায় ১৭.৩৪ টন ফলন পাওয়া সম্ভব হয়েছে। ফলন নির্ভর করে সমুদ্রের পানির স্বচ্ছতা ও লবণাক্ততার উপর। লবণাক্ততা এবং পানির স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফলনও বৃদ্ধি পায়।

এই পরিবেশ পাওয়া যায় অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত। পরবর্তীতে বৃষ্টি আরম্ভ হলে লবণাক্ততা হ্রাস পায় এবং ফলনও কমে যায়।

২০১৭ সালের মার্চ মাসে হাতে কলমে প্রশিক্ষণের পর ৫০ কৃষককে উপকরণ সহায়তা (বীজ, বাঁশ, রশি) প্রদান করা হয়েছে। তারা প্রায় প্রত্যেকেই প্রকল্প এলাকায় সাফল্যজনকভাবে হিপনিয়া মাসিফরমিস সামুদ্রিক শৈবাল চাষ করতে সক্ষম হয়েছেন। মার্চ মাসে চাষ করে ৩০ দিনের চাষে ফলন পাওয়া যায় হেক্টরপ্রতি ২.৫০-৩.০০ টন।

এতে করে কক্সবাজারে এই প্রযুক্তি স¤প্রসারিত হয়েছে এবং বর্তমানে কৃষকেরা সীউইড চাষাবাদ করতে আগ্রহী হয়েছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে প্রায় ১০০ জন কৃষক উন্মুক্ত সমুদ্রে সীউইড চাষের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন।

এখন তারা বুঝতে পেরেছেন যে, প্রাকৃতিকভাবে প্রদত্ত সামুদ্রিক শৈবাল সবসময় পাওয়া যায় না বলে এ থেকে আয়ের নিশ্চয়তা নেই এবং তা পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর। স্থানীয় বাজারে এক কেজি হিপনিয়া প্রজাতির সীউইড এর দাম ৩০-৩৫ টাকা। স্থানীয় রাখাইন এবং উপজাতিরা এ সীউইড খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।

এগিয়ে যাচ্ছে সামুদ্রিক শৈবাল চাষের গবেষণা উল্লেখ করে বারি জানায়, উৎপাদিত হিপনিয়াপ্রজাতির সীউইডের গুণাগুণ ল্যাবরেটরিতে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতি ১০০ গ্রামে এন্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে ১৮৮০.৮৪ মিলিগ্রাম যা যে কোন মাঠ ফসলে প্রাপ্ত এন্টিঅক্সিডেন্ট থেকে অনেকগুণ বেশি।

এছাড়াও এ শৈবালে প্রতি ১০০ গ্রামে ১৩৫৮.২০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম, ১৩৭.৩১ মিলিগ্রাম লৌহ, ৮২.৬০ মিলিগ্রাম আয়োডিন, ৭৪.৪২ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম এবং ০.৪৪ মিলিগ্রাম জিঙ্ক রয়েছে যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

২০১৫ সালের পর থেকে জাতিসংঘ যে টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে তার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ব্লু ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতি। অপার সম্ভাবনাময় সমুদ্র সম্পদ ব্যবহার করে ব্লু ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতিতে অবদান বাড়াতে হবে।

উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশের বিশাল ও বিস্তৃত উপকূলীয় অগভীর সমুদ্র অঞ্চল সামুদ্রিক শৈবাল চাষের আওতায় আনতে পারলে তা ব্লু ইকোনমি বা সুমদ্র অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখতে সক্ষম হবে।

কক্সবাজারের নুনিয়ারছড়া এবং তার পাশ্ববর্তী সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় হিপনিয়া প্রজাতি ব্যাপকভাবে চাষ করা সম্ভব। ফলে সাগর সবজি চাষের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি যেমন সমৃদ্ধ হবে তেমনি মানুষের প্রয়োজনীয় পুষ্টির যোগানও বৃদ্ধি পাবে। এগিয়ে যাচ্ছে সামুদ্রিক শৈবাল চাষের গবেষণা শিরোনামের সংবাদটির তথ্য কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট নিশ্চিত করেছে।