মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী: আট ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় আইনাল হক (৫৫)। সংসারের খরচ যোগাতে তিন দশক আগে শুরু করেন গরু-ছাগলের ব্যবসা; সেখান থেকে কসাই। পেশায় যেন মন টানে না আইনালের। এরপর ১৪ হাজার টাকায় শুরু করেন মাছ চাষ। দীর্ঘ দুই দশক ধরে মাছ চাষে প্রায় ৫ থেকে ৬ কোটি টাকার সম্পত্তি করেছেন। রাজশাহী নগরীর ১ নং ওয়ার্ড আমচত্তর রাইপাড়া এলাকায় জমি কিনে করেছেন পাকা বাড়ি।

গতকাল মঙ্গলবার মাছ চাষে এ অভাবনীয় সাফল্যের গল্প শোনালেন তিনি। রাজশাহী নগরীর উপশহর নিউমার্কেট কাঁচাবাজারে গরু-ছাগলের মাংস বিক্রি করেছেন ৮ বছর। এরপর ২০০০ সালে ৬ হাজার টাকায় লিজ নেন ৩ বিঘার একটি পুকুর। মাছ ছাড়েন রুই আর কাতলা। সবমিলিয়ে সে সময় খরচ হয় ১৪ হাজার টাকা। মাংস বেচে যা আয় হতো সেই টাকায় মাছের খাদ্য কিনে বাড়ি ফিরতেন আইনাল।

৭ মাস পর দুই কেজি ওজনের রুই-কাতলা বিক্রি করেন বেশ ভালো দামে। লাভ হয় প্রায় ২ লাখ টাকা। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আইনালের। এখন তিনি দেড়শ বিঘা জমিতে মাছ চাষ করেন! বছরে আয় করেন ১০ লাখ টাকার বেশি।
আইনাল বলেন, ‘মাছ চাষে লাভ কমে গেছে। খাদ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, শ্রমিকের মজুরি, মাছ ধরার জাল-জেলের খরচ সবমিলিয়ে এখন লাভের ভাগ অত্যন্ত কম। করোনায় দুই বছরে লোকসান আর লোকসান। এরবছর ৪টি পুকুর ছেড়ে দিয়েছি। এখন ১৪০ বিঘার মতো আছে। বছরে লাভের পরিমাণ কমে এখন লাখ দশেক টাকার মতো থাকে।”

মাছ চাষের কৌশল বিষয়ে জানতে চাইলে আইনাল হক এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন,‘ মাছ চাষে এখনও লাভ করা সম্ভব। হুট করে মাছ চাষ করতে নামলেই লোকসান হবে। পুকুরের পানির অবস্থা, মাছের খাবারের জন্য পকেটে কতো টাকা আছে, ভালো জাতের পোনা, ব্যবস্থাপনার জন্য দক্ষ লোকবল সবকিছুই মাছ চাষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ধরেন, ৫ কোটি টাকা আছে দুই কোটি বিনিয়োগ করলেন। পরে বাঁকি ৩ কোটি টাকা খুঁজে পাবেন না। পরিকল্পিতভাবে এ পেশায় না আসলে লোকসান হবেই, শেষে কান্না ছাড়া কিছু থাকবেনা।”

তিনি আরো বলেন, “মাছ ছাড়তে হবে এক কেজির উপরে। সার্বক্ষণিক তদারকিতে রাখতে হবে পুকুর। অতিরিক্ত তাপমাত্রা বাড়লে ডিপ টিউবওয়েল, মর্টার দিয়ে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আবহাওয়া খারাপ বা মেঘলা হলে, রোদ বের না হলে খাবার কমিয়ে দিতে হবে। সম্ভব হলে অ্যারেটর চালাতে হবে। ভালোভাবে মাছ চাষের কৌষল রপ্ত থাকলে লাভ এখনও হবে।”

ক্ষোভ প্রকাশ করে এই মৎস্য চাষি বলেন“ মৎস্য দপ্তর পরামর্শ দিয়ে পাশে থাকে কিন্তু আমরা ঋণ পাইনা। ব্যাংকে গেলে পুকুরের জমির দলিল চায়। আমরা যারা লিজ নিয়ে মাছ চাষ করি তারা তো জমির দলিল পাইনা। দপ্তরের উচিত মাঠ পর্যায়ে তদরকি করে উপযুক্ত চাষির জন্য ঋণের ব্যবস্থা করা। খাদ্যের দাম কমানো। তাছাড়া আমরা চাষিরা এভাবেই যুগের পর যুগ ধুকে ধুকে মরব। সরকারের এই দিকে নজর দেওয়া উচিত।”

এলাকার আরেক মাছ চাষি আইনালের বিষয়ে বলেন, “আগে তেমন টাকা পয়সা ছিলনা। অনেকদিন ধরে মাছ চাষ করছেন আইনাল। গাড়ি বাড়ি সব করেছেন। ভাই-বোনদের খরচ, বিয়ে দেওয়া সবকিছু করেছেন। এই এলাকায় অনেক বড় বড় মাছ চাষি আছে। সবচেয়ে বড় চাষি মশিউরউদ্দিন হাজী, মেজো, ইব্রাহিম, ইয়াকুবসহ আরো কয়েকজন। প্রত্যেকের কোটি টাকার ব্যবসা।”

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অলক কুমার সাহা এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন,“ মাছ চাষে মশিউরউদ্দিন হাজী, মেজো, আইনাল হক, ইব্রাহিম সহ অনেক রয়েছেন যারা মাছ চাষে আইকন বলা চলে। মাছ চাষকে তাঁরা এমন এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তা ভাবলে অবাক হতে হয়। রাজশাহীর বেশিরভাগ চাষি আছেন যারা মাছের পরিচর্যা বিষয়ে বেশ জ্ঞান রাখেন। যেন কোন দূর্ঘটনা না ঘটে সেজন্য কম ঘনত্বে মাছ চাষ করতে বলা হয়।

চাষিদের সরকারি সহযোগিতা দেওয়ার বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, “সরকার ৪ শতাংশ সুদে ঋণের ব্যবস্থা করেছেন। রাজশাহীতে ১৩০ জন চাষি এই ঋণ পেয়েছেন। এছাড়াও রাজশাহী বিভাগে মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প, জলাশয় সংস্কারের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পসহ মোট ৪ টি প্রকল্প চালু রয়েছে। আমরা সবসময় চাষিদের পরামর্শ দিয়ে পাশে থাকার চেষ্টা করি।”

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ