নিজস্ব প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) বাস্তবায়নাধীন ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম ও চাঁদপুর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়মের কারনে কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। জুলাইয়ে চালু এ প্রকল্প চাঁদপুরে কয়েকজন কৃষি উপসহকারী কর্মকর্তার যোগসাজসে হয়েছে বলে অভিযোগ কৃষকদের।

প্রকল্পের মাধ্যমে প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে খামারের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রমাণিত প্রযুক্তির সম্প্রসারণ, পতিত জমি চাষের আওতায় আনা, একক ও বহু ফসলের আবাদ বৃদ্ধি, শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণের মাধ্যমে প্রকল্প এলাকায় কৃষি উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নেয়া হয়।

এছাড়া মাঠপর্যায়ে কার্যকরী সম্প্রসারণ সেবা দিতে কৃষি ও কৃষকের দক্ষতা বাড়ানো, কৃষি উৎপাদন কার্যক্রমে নারীদের সক্ষমতা বাড়ানোর কথা থাকলেও কৃষি উপ-সহকারী কর্মকর্তাদের নানা অনিয়মের কারণে প্রকল্পের আশানুরূপ কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

হাজীগঞ্জ, শাহরাস্তি, কচুয়া, ফরিদগঞ্জ উপজেলার কৃষি ব্লকের চাষিদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ, প্রশিক্ষণ ভাতা, যাতায়াত খরচ, সার, বীজ, বালাইনাশকসহ ফসলের আন্তঃপরিচর্যার বরাদ্দ টাকাদানেও কৃষি উপ-সহকারীরা নয়-ছয় করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন কৃষি ব্লকে প্রকৃত কৃষকদের নাম তালিকাভুক্ত না করে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, ইউপি মেম্বারের ছেলে, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কৃষি উপ-সহকারীদের সহায়তায় কৃষক সেজে প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে ফসলভেদে প্রকল্পের বরাদ্দ কৃষি উপকরণ আত্মসাৎ করাসহ প্রশিক্ষণ ভাতা ও যাতায়াতের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন।

জানা যায়, হাজীগঞ্জে ২০২০-২১ অর্থবছরে এ প্রকল্পের আওতায় ৩৭টি কৃষি ব্লকে ১২ জন চাষি পেঁয়াজ চাষ করেন। পেঁয়াজ প্রদর্শনীর উপকরণ বিতরণে উপজেলা কৃষি উপসহকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ করেন বিভিন্ন ব্লকের ভুক্তভোগী কৃষকরা।

অনুসন্ধানে প্রকল্পের অর্থ লোপাটের আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়। উপজেলার ১২নং দ্বাদশগ্রাম ইউনিয়নের কাপাইকাপ ব্লকের পেঁয়াজ চাষি কাউছার হোসেন পেঁয়াজ চাষের আন্তঃপরিচর্যার এক হাজার ৭০০ টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও তিনি এক টাকাও পাননি। ৪ নং কাঁলোচো ইউনিয়নের কাঁলোচো ব্লকের পেঁয়াজ চাষি হেদায়েত উল্লাহ পাননি বরাদ্দ বালাইনাশক। তিনি আন্তঃপরিচর্যার এক হাজার ৭০০ টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও পেয়েছেন এক হাজার ৫০০ টাকা। ৩ নং কাঁলোচো ইউনিয়নের মাড়কি ব্লকের মো. নূরুল আমিন আন্তঃপরিচর্যার এক হাজার ৭০০ টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও পেয়েছেন এক হাজার টাকা মাত্র। কোনো কোনো কৃষক প্রয়োজনের তুলনায় পেঁয়াজ বীজ পেয়েছেন অনেক কম। কেউ পেয়েছেন আধা কেজি বীজ। এছাড়া পেঁয়াজ চাষি তালিকায় ভুয়া নাম অন্তর্ভুক্ত করে অর্থ লোপাটের ঘটনাও ঘটেছে।

মে মাসে হাজীগঞ্জে তিন দিনব্যাপী কৃষক-কৃষানিদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। হাজীগঞ্জে কৃষক-কৃষানিদের মধ্যে যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তাদের অনেকে কৃষক নন। কৃষি জমিও নেই। কৃষি কাজও করেন না। কেউ রাজনৈতিক নেতা, কেউ মেম্বারপুত্র, কেউ স্থানীয় প্রভাবশালী, কেউ ইউনিয়নের নেতা। অনুসন্ধানকালে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়।

জানা যায়, উপজেলার ৮নং পূর্ব হাটিলা ইউনিয়নের বেলঘর গ্রামের আ. গনি মেম্বারের পুত্র নাজমুল হোসেন হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে পড়ছেন। পেশায় কৃষক না হলেও নিয়েছেন কৃষি প্রশিক্ষণ ও ভাতা। একই গ্রামের দেলোয়ার হোসেন পাটোয়ারীর ছেলে হাসান পাটওয়ারী পেশায় কৃষক নন। কোনোদিন কৃষি কাজও করেননি। হাসান পাটওয়ারীও নিয়েছেন প্রশিক্ষণ ভাতা। এছাড়া একই ইউনিয়নের পূর্ব হাটিলা গ্রামের মৃত দাউদ ইসলামের ছেলে আলমগীর হোসেন কৃষি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলেও নিয়েছেন কৃষি প্রশিক্ষণ ও ভাতা।

হাজীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মাজেদুর রহমান বলেন, বিভিন্ন কৃষি ব্লকে কৃষি উপ-সহকারীরা অনিয়ম করে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। উপজেলার কয়েকজন কৃষি উপসহকারী জানান, কৃষি অফিসার আন্তঃপরিচর্যার টাকা দিয়েছেন নিজেই। এ ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না।

অনুসন্ধানকালে আরও জানা যায়, শাহরাস্তির ৩১টি কৃষি ব্লকে পেঁয়াজ চাষ করেছেন ১৫ জন কৃষক। কৃষকদের মধ্যে সূচিপাড়া উত্তর ইউনিয়নের ধামরা ব্লকের হাড়াইরপাড় গ্রামের মৃত আবদুল হামিদ পাটোয়ারির ছেলে মিজানুর রহমান ৩৩ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছেন তিনি ফসলের আন্তঃপরিচর্যার কোনো টাকা পাননি বলে জানান। একই উপজেলার সূচিপাড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের নরিংপুর গ্রামের নরিংপুর ব্লকের মৃত মমতাজুর রহমানের পুত্র মো. ফরিদ শেখ পেঁয়াজ চাষ করেছেন ঠিকই কিন্তু তিনি বালাইনাশক ও আন্তঃপরিচর্যার এক হাজার ৭০০ টাকা পাননি।

কচুয়া উপজেলার ৩৭টি কৃষি ব্লকের বেশিরভাগ পেঁয়াজ চাষি ফসলের আন্তঃপরিচর্যার টাকা পাননি। অনুসন্ধানকালে অনিয়ম ধরা পড়ার ভয়ে পেঁয়াজ তোলার এক মাস পর চাষিদের ডেকে এনে আন্তঃপরিচর্যার টাকা পরিশোধ করেন একজন কৃষি উপসহকারী।

কাগজে কলমে ফসলের প্রদর্শনী প্লটভিত্তিক ভৌত অগ্রগতি শতভাগ দেখানো হলেও জেলার কচুয়া, হাজীগঞ্জ, শাহরাস্তি উপজেলার পেঁয়াজ চাষিরা পেঁয়াজের আবাদ করে আশানুরূপ ফলন পায়নি। প্রায় প্রতিটি কৃষি ব্লকের উপ-সহকারীরা চাষিদের জন্য বরাদ্দকৃত পেঁয়াজ ফসলের আন্তঃপরিচর্যার টাকা হরিলুট করেছেন। দেরিতে বীজ পেয়েছেন বলেও অভিযোগ করেন বেশিরভাগ কৃষক।

 

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ