মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী: মাধ্যমিক পাশ করে ২০০৪ সালে পাড়ি জমিয়েছিলেন ইরাক। মাত্র ৩২ মাস বিদেশ থেকে ফিরে আসেন দেশে। সে সময় কৃষি কাজ শুরু করে চলে ১০ বছর। এরপর নেন এনজিওতে চাকরি। চাকরি করেন প্রায় ৫ বছর। সর্বশেষ চাকরি ছেড়ে শুরু করেন লেয়ার মুরগির খামার। তাতেই বাজিমাত ইরাক ফেরত ফারুকের।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরের ইসলামপুর এলাকার বাররশিয়া মুনশি হাজীর গ্রামের বাসিন্দা ফারুক। বাবা পেশায় স্কুল শিক্ষক হাজী একরামুল হক। ফারুক ছয় ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। চর অঞ্চলে আম বাণিজ্যিক ফসল হওয়ায় প্রথমত বাবার বাগান দেখাশোনা শুরু করেন তিনি। মন লাগে এসবে। চাকরি শুরু করলেন এনজিওতে। সুদের টাকা হালাল হবেনা-ধারণা থেকেই ছাড়লেন চাকরি। নামলেন ঝুঁকিপূর্ণ পোল্ট্রি এ ব্যবসায়।
পড়তে পারেন: হাঁসের খামার করে লাখপতি নওগাঁর খালেক
শুরুটা মোটেও সুখকর ছিলনা। সালটা ছিল ২০১৭। শুরুতেই হোচট। লেয়ার মুরগির একদিন বয়সী ১১’শ বাচ্চা তুললেন খামারে। হালকা শীত, জানুয়ারি মাস। ব্রুডার ঘরে তাপমাত্রার নিয়ন্ত্রণ না থাকায় মারা গেলো কিছু মুরগি। ঘর করলেন প্রায় সাতে ৩ লাখ টাকার। আনুষাঙ্গিক খরচ আরো সাড়ে তিন লাখ। ৭ লাখ টাকা খরচ করে দাঁড় হলো খামারের কাঠামো। পাশেই করলেন বায়োগ্যাস প্লান্ট। মুরগিসহ খরচ দাঁড়ালো ১১ লাখ।
গত শনিবার (২৭ আগস্ট ২০২২) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, খামারে কাজ করছেন ফারুক হোসেন। কথা হয় মুরগির খামারে লাভ-লোকসান, ঝুঁকি নিয়ে বিস্তারিত।
ফারুক হোসেন এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, সুদের টাকা হালাল হবে না তাই এনজিওর চাকরি ছেড়ে খামার করেছি। চাকরিতে থাকার সময় আমার এক বন্ধু এই লেয়ার খামার করেছে সেটা দেখতাম। লাভ-লোকসান নিয়ে হিসেব নিকাশ করে আমিও নেমে পড়লাম। প্রথমে ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে মুরগি যখন ডিম দিতে শুরু করে তখন রাণীক্ষেত রোগে ধরে। আমি বুঝতে পারিনি। আড়াই’শ মুরগি মারা যায়। কোনটা জবাই করি। এভাবে দেড় থেকে ২ লাখ টাকা লোকসান হয়, সেই বছরে।
“আমি দমে যাইনি। ঘর-কাঠামো সবকিছু রেডি থাকার কারণে আরেক দফা বাচ্চা তুলি। এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। খামারে একা কাজ করি। লিটার সরাতে হয়না। পানি দিয়ে ধুয়ে বায়োগ্যাস প্লান্টের ভেতরে ঢুকিয়ে দিই। গ্যাস উৎপন্ন হয়। বাড়িতে ৮ জন মানুষের রান্নার কাজ চলে। লাভও হয় মোটামুটি। অনেক সময় মনে হয় চাকরি ছেড়ে ভুল করিনি।”
প্রত্যন্ত চর অঞ্চলে মুরগির খামার কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে ডাক্তার নাই। ফিডের বস্তা চাঁপাই সদর থেকে আনাতে হয়। বস্তায় খরচ পড়ে ৫০ টাকা বেশি। তারপরও দিনে আগে দেড় হাজার থেকে ১২’শ টাকা লাভ আসতো। এখন কমে গেছে। খাদ্যের দাম বাড়ার কারণে অর্ধেক লাভ নাই হয়ে গেছে। আগে ১৭’শ পঞ্চাশ টাকায় ৫০ কেজির বস্তা কিনতাম এখন সেই খাদ্য ২৯’শ টাকা। আগে ডাক্তার রাজশাহী থেকে নিয়ে আসলে ৫০০ টাকা দিলেই হতো। এখন ১ হাজার দিতে হয়। তারপরও লাভ হয়। তা না হলে তো আর টিকে থাকা যেতো না।
পড়তে পারেন: মাছ-মুরগির খাবার ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই আসলে কতটা লাভজনক?
সফলতার পেছনে কৌশল জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার মুরগি আর এক মাসের মধ্যে ডিম দিবে। ১৩০ দিন বয়সে ডিম আসে যদি মুরগির ওজন ঠিক থাকে ও সুস্থ থাকে। দিনে দুইবার খাবার দিই। সকাল ৬ টার দিকে একবার আর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে একবার। রাতে খাবার দিই না। অতিরিক্ত খাবার দিলে খামারে লাভবান হওয়া সম্ভব নয়। ভালো কোম্পানির ভ্যাকসিন ও মেডিসিন ব্যবহার করলে লাভবান হওয়া যাবে। আর খেয়াল রাখতে হবে মুরগি ভালো আছে কিনা।
প্রতিবেশিরা জানান, ফারুক হোসেন মুরগির খামার করেছেন আমের বাগানের ভেতর। কারো কোন সমস্যা হয়না। লিটার থেকে গ্যাস দিয়ে রান্না করেন। এই খামারেই তার ভাগ্য খুলেছে। বিদেশ থেকে টাকা নিয়ে এসেছেন সেইসময়ে ১৫ বিশ লাখ। যেখানে ইনভেস্ট করেন সেখানেই তার লাভ হয়।
“চিকিৎসার কোন ঘাটতি থাকে না। পরামর্শ মেনে চলেন। সময় মতো টিকার ব্যবস্থা করেন তাই তিনি একজন সফল খামারি।”
খামার দেখাশোনা ও ভ্যাকসিনেশন কাজ করেন প্রাণিসম্পদের আতাউর রহমান। তিনি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, ফারুক হোসেন অত্যন্ত যত্নশীল একজন খামারি। তাঁর খামারের কোন সমস্যা হলে সাথে সাথে জানান। চিকিৎসার কোন ঘাটতি থাকে না। পরামর্শ মেনে চলেন। সময় মতো টিকার ব্যবস্থা করেন তাই তিনি একজন সফল খামারি। আধুনিক খামারির তালিকায় তিনি পড়বেন।
এগ্রিকেয়ার/এমএইচ