ফসল ডেস্ক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: ধানের বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়ে উচ্চ তাপমাত্রার কারণে বৃদ্ধি ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত হলেও ফুল ফোটা পর্যায়ে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি হলে ধানে চিটা দেখা দেয়। তাপদাহ ও ঝড়ো আবহাওয়ার পরবর্তীতে বোরো ধানের পরিচর্যা বিষয়ে আজকের আলোচনা:-

গত মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ধানের ফুল ফোটা পর্যায়ে দিনের বেলায় তাপমাত্রা প্রায়শই ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার চেয়ে বেশি হওয়ার কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ধানে চিটা পরিলক্ষিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এপ্রিলের ৪ তারিখে উচ্চ তাপমাত্রা প্রবাহের সাথে সাথে কালবৈশাখী ঝড় হয় দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে হাজার হাজার হেক্টর জমির ধান শুকিয়ে চিটা হয়ে যায়।

উচ্চতা প্রবাহের সাথে যদি কালবৈশাখী ও সংগঠিত হয় তখন ধানের ক্ষতি ব্যাপক হয়ে থাকে এবং ধান মাত্রাতিরিক্ত চিটা হয়ে যায়।

তাপদাহ ও কালবৈশাখী পরবর্তীতে যেসব করতে হবে

১. প্রধানের যে সকল জাত ফুল ফোটা পর্যায়ে আছে বা এখন ফুল ফুটতে পর্যাপ্ত পানি ধরে রাখতে হবে। ধানের শীষে দানা শক্ত না হওয়া পর্যন্ত জমিতে অবশ্যই দুই থেকে তিন ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে।

২. ঝড়ের কারণে ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া (বিএলবি) বা ব্যাকটেরিয়া জনিত লালচে রেখা (বিএসবি) রোগের আক্রমণ হতে পারে। আক্রান্ত যে সকল জমিতে ধান ফুল আসা পর্যায়ে রয়েছে সে সকল জমিতে ৬০ গ্রাম এমওপি সার, ৬০ গ্রাম থিওভিট, ২০ গ্রাম দস্তা সার ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে। তবে ধান থোড় অবস্থায় থাকলে বিঘা প্রতি অতিরিক্ত ৫ কেজি পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

৩. বোরো ধানের এ পর্যায়ে নেক ব্লাস্ট বা শীষ ব্লাস্ট রোগের ব্যাপক আক্রমণ হতে পারে। শীষ ব্লাস্ট রোগ হওয়ার পরে দমন করার সুযোগ থাকে না তাই ধানের জমিতে রোগ হোক বা না হোক থোড় ফেটে শীষ বের হওয়ার সাথে সাথে একবার আবার ৭ দিন পর ৩৩ শতাংশ জমিতে (প্রতি বিঘায়) ট্রুপার ৭৫ ডব্লিউপি/ দিফা ৭৫ ডব্লিউপি/ জিল ৭৫ ডব্লিউপি অথবা ট্রাইসাইক্লাজল গ্রুপের অনুমোদিত ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় ৬৭ লিটার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

৪. এসময় জমিতে বাদামী ঘাসফড়িং আক্রমণ হতে পারে। আক্রমণ প্রবণ এলাকায় কীটনাশক যেমন মিপসিন ৭৫ ডব্লিউপি, একতারা ২৫ ডব্লিউপি, প্লিনাম ৫০ ডব্লিউপি এছাড়া আমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। বোতলে বা প্যাকেটে উল্লিখিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। কীটনাশক অবশ্যই গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হবে এক্ষেত্রে ডাবল নজেল বিশিষ্ট স্প্রেয়ার ব্যবহার করা উত্তম।

তাপদাহ ও ঝড়ো আবহাওয়ার পরবর্তীতে বোরো ধানের পরিচর্যা শিরোনামে সংবাদের তথ্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে নেওয়া হয়েছে।

রাজশাহীতে বোরো ধানে হিটশকে কপাল পুড়েছে কৃষকের

অতিরিক্ত গরমে মানুষ যেমন হিটস্ট্রোক করে ঠিক তেমনি তীব্র তাপমাত্রায় ধানগাছ শুকিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াকে হিটশক বলে। রাজশাহী অঞ্চলে মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া শুস্ক বাতাস ও ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে তাপমাত্রায় হিটশকে কপাল পুড়ছে কৃষকের।

দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়া ও তীব্র আবহাওয়ায় শুকিয়ে যাচ্ছে ধানগাছ। কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট এ পরিস্থিতিকে নতুন চ্যালেঞ্জ বলে দেখছেন ধান গবেষকরা।

কৃষকদের নতুন আতঙ্ক এই হিটশক! ধানের শীষগুলো সাদা হয়ে মারা যাচ্ছে। গত রোববার (৪ এপ্রিল) কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকা এবং নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, কুষ্টিয়া ও ময়মনসিংহ জেলাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছে হিটশকে। এ থেকে বাদ পড়েনি রাজশাহী অঞ্চল।

গত বুধবার (৭ এপ্রিল ২০২১) রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট আঞ্চলিক শাখা থেকে বিজ্ঞানীরা জেলার পবা উপজেলার আলিমগঞ্জ ও কসবা এলাকা পরিদর্শন করেছেন। এই দলে ছিলেন কৃষি বিভাগের প্রধান ডা. আউয়াল, ব্রি আঞ্চলিক কার্যালয়ের পিএসও ও প্রধান ড. মো. ফজলুল ইসলাম, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মনিরুজ্জামান, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. তাহমিদ হোসেন আনছারী ও ড. কাজী শিরিন আক্তার জাহান এবং উদ্ভিদ কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোসাদ্দেক হোসেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, রাজশাহীতে মোট ৬৬ হাজার হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ করা হয়েছে। গত ৪ তারিখে বৃষ্টি ও আদ্রতাহীন শুস্ক ঝড়ে দশমিক শূন্য ৪ হেক্টর জমি বোরো ধান আক্রান্ত হয়েছে বলে এখন পর্যন্ত জানা গেছে। যার পরিমাণ দাঁড়ায় ২৮ হেক্টর জমি। হেক্টর প্রতি ৬ মেট্রিকটন ধান হিসেবে ১৬৮ মেট্রিকটন ধানের ক্ষতিসাধন হয়েছে। এছাড়াও এ ক্ষতির পরিমাণ সামান্য বাড়তে বলে প্রাথমিক আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ব্রি রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান ড. মো. ফজলুল ইসলাম বলেন, এবারে বৃষ্টি নেই অনেকদিন। আবহাওয়া অত্যন্ত রুক্ষ। ৪ এপ্রিল সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টি ছাড়াই ঝড় শুরু হয়। সেদিন বাতাস ছিল অতিরিক্ত গরম। আদ্রতা ছিল শুন্যের কোটায়। ফলে ঐদিন যেসব ধানের শীষ বের হয়েছিল সেগুলোর ফুল ঝরে যায়। বাতাসের গতির সাথে আর্দ্রতার মিল না থাকায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গরম অনুভব হয়েছে। ডিহাইড্রেশন প্রক্রিয়ায় সদ্য ফোটা শীষ থেকে পানি বের হয়ে গিয়ে শীষ শুকিয়ে গেছে। তবে, বৃষ্টি হলে এমনটি হতো না। রাজশাহীতে ক্ষতির পরিমাণটা কম হয়েছে। হাওর অঞ্চলে হিটশকের প্রভাব পড়েছে বেশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. তাহমিদ হোসেন আনছারী বলেন, তাপমাত্রা বাড়লে কিংবা কমলে হিটশক বা হিট ইনজুরি হয়ে থাকে। দুটো কারণেই হতে পারে। গত ৪ তারিখে যে গরম বাতাসের ঝড়ে ধানের ক্ষতিসাধন হয়েছে। ধানে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা হলে হিটশক হয়। হিটশকে মারাত্মক ক্ষতি হয় ধানের ফ্লাওয়ারিং স্টেজে (ফলনের প্রাথমিক পর্যায়)। একদিন আগে কিংবা ঐদিন যেসব ধান পরাগায়ন হচ্ছিল সেই ধানের শিষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরাগায়ন করতে পারেনি এবং ফ্লাওয়ারিং স্টেজ চলার কারণে ওইসব ধানের শীষ থেকে পানি বেরিয়ে গেছে। সেইসাথে বৃষ্টি না হওয়ায়, পরের দিন রোদ উঠার পর শিষগুলো সাদা আকার ধারণ করে শুকিয়ে যায়।

কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের এটি একটি নতুন চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন এই বিজ্ঞানী। তিনি আরোও বলেন, ঝড়ের দিন ফুল ফোটা অবস্থায় থাকা জমির ৫-১০% ধান প্রথমে সাদা ও পরবর্তীতে কালো বর্ণ ধারণ করে চিটা হয়ে গেছে। তাছাড়া ঝড়ের কারণ পাতায় পাতায় ঘর্ষণে পাতা ফেটে গিয়ে ক্ষতস্থান দিয়ে ব্যকটেরিয়া প্রবেশ করে বিএলবি বা পাতাপোড়া রোগ সৃষ্টি হয়েছে। পাতার অগ্রভাগ ও কিনারা পুড়ে যাওয়ার মতো খড় বর্ণ ধারণ করেছে।

ধানের হিটশক বা তীব্র তাপমাত্রায় চাষিদের করণীয় বিষয়ে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট জানায়, ধানের দানা শক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত জমিতে ২-৩ ইঞ্চি পানি দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে। ধানের অগ্রভাগ বা পাতাপোড়া রোগ দেখা দিলে প্রতি ৫ শতাংশ জমিতে থিওভিট ও এমওপি ৬০ গ্রাম, ২০ গ্রাম দস্তা বা জিঙ্ক ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। সেইসাথে প্রতি বিঘা জমিতে ৫ কেজি পটাশ দিলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। ধানে ব্লাস্ট রোগ দেখা দিলে ট্রাইসাক্লাজল গ্রুপের ছত্রাকনাশক প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭-১০ দিন স্প্রে করলে ধানের ব্লাস্ট প্রতিরোধ করা যায়।

রাজশাহী অঞ্চলে চাষিদের পানি স্বল্পতার কারণে ধানে হিটশক হতে পারে কিনা জানতে চাইলে ইনস্টিটিউটের সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মনিরুজ্জামান বলেন, রাজশাহী অঞ্চলের ধান চাষিদের কোন সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ধানের ফ্লাওয়ারিং স্টেজ আসার আগে এবং এর পরবর্তী ১০-১২ দিন জমিতে ২-৩ ইঞ্চি পানি রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এখানকার কৃষকরা সেই মোতাবেক ধান চাষ করে আসছেন। গত ৪ তারিখে যা হয়েছে তা হটাৎ, প্রকৃতিক। যাদের সেচ দেওয়ার পরিস্থিতি বা সুযোগ আছে তারা দিবে। আর যাদের সেই সুযোগ নেই সেটা আলাদা ব্যাপার।

আবহাওয়া অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ৪ এপ্রিল বিকেল ৪ টার পর থেকে হঠাৎ গরম বাতাস শুরু হয়।তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপর ছিল। এছাড়াও গত দু-সপ্তাহ ধরে প্রায়ই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে রাজশাহীতে। যা ৩৫-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠানামা করেছে। ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং আর্দ্রতা না থাকায় ধানে ক্ষতি হয়েছে।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, এটা একটি নতুন সমস্যা। তবে আগেও হয়েছে। কিন্তু বড় ক্ষতি আগে হয়নি। দেশে এ বছর প্রচুর বোরো ধান হয়েছে। এ ক্ষতি সার্বিক উৎপাদনে কোনো প্রভাব পড়বে না।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ডা. আউয়াল বলেন, জেলায় এবার ৬৬ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। ৪ এপ্রিল ঘন্টাব্যাপী বৃষ্টিহীন ঝড়ো বাতাস প্রবাহিত হয়েছে। তাপমাত্রা বেশি হওয়ায় ও বাতাসে আর্দ্রতা না থাকায় বোরো ধানের ক্ষেতের শীষ মরে গেছে। জলীয় বাস্প কম থাকলে আমরা যে তাপমাত্রা পরিমাপ করি না কেন, এর চেয়ে অনুভব তাপমাত্রা অনেক বেশি হবে। তখন মনে হয় গায়ে লু-হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। সেদিনই মূলত এ ব্যাপারটা হয়েছিল। এখন পর্যন্ত দশমিক শূন্য ৪ হেক্টর জমি বোরো ধান আক্রান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। যার পরিমাণ ২৮ হেক্টর জমি। হেক্টর প্রতি ৬ মেট্রিকটন ধান হিসেবে ১৬৮ মেট্রিকটন ধানের ক্ষতিসাধন হয়েছে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ