ইউসুফ আলী সুমন, মহাদেবপুর (নওগাঁ) প্রতিনিধি : প্রকৃতিতে অনাবৃষ্টি আর তীব্র খরা শেষে দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর শ্রাবণের আকাশে ঘটে মেঘের ঘনঘটনা। গত কয়েকদিন থেকে বইতে শুরু করেছে শ্রাবণের ধারা। এতে বরেন্দ্র অঞ্চলের চাষিদের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে। আউশ ক্ষেত পরিচর্যা, সার-কীটনাশক প্রয়োগ, আমনের জমি চাষ, বীজতলা থেকে চারা তোলা ও রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকেরা। যেন দম ফেলার ফুরসত নেই তাদের।

কৃষকরা বলছেন, কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধিসহ ভরা মৌসুমে সার সংকট, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বাজারে অধিক মূল্যে রাসায়নিক সার বিক্রি এবং ক্রমেই এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় উৎপাদনে বাড়তি খরচের ধকলে পুড়ছেন তারা। জলবায়ু পরিবর্তনে প্রকৃতির এমন বিরুপ আচরণে ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন সচেতন চাষিরা। আর কর্তৃপক্ষ বলছেন, আগামী বোরো মৌসুম পর্যন্ত দেশে সার ঘটতির আশঙ্কা নেই। সিন্ডিকেট করে অধিক দরে সার বিক্রি করলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২০২৩ খরিপ-২ মৌসুমে এ অঞ্চলে ৪ লাখ ৩ হাজার ৪৬৬ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ পরিমাণ জমি চাষাবাদে আমনের বীজতলা প্রস্তুত করা হয়েছে ২০ হাজার ৬২৭ হেক্টরে। ইতিমধ্যে লক্ষ্যমাত্রার শতকরা ১৭ ভাগ জমিতে চারা রোপণ সম্পন্ন হয়েছে।

খরিপ-১ মৌসুমে ১ লাখ ৭১ হাজার ৩৮০ হেক্টরে আউশের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও এর বিপরিতে অর্জন হয়েছে ১ লাখ ৫১ হাজার ৩৭৮ হেক্টর। এসব জমি থেকে প্রায় ৬ লাখ ৮১ হাজার ২০১ মেট্রিক টন আউশ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। ধানের রাজ্য বলে খ্যাত বরেন্দ্র অঞ্চলের জেলা নওগাঁয় এবার ১ লাখ ৯৭ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সে লক্ষ্যে ৮ হাজার ৮০০ হেক্টর জমির বীজতলা তৈরি হয়েছে। ৫৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আউশের চাষাবাদ হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (দায়িত্বপ্রাপ্ত) একেএম মনজুরে মাওলা।

জেলার মহাদেবপুর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, দেশের অন্যতম ধান উৎপাদনকারী এ উপজেলায় এবার ২৮ হাজার ৬১৫ হেক্টরে আমন চাষের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ১ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে চারা রোপণ করেছেন চাষিরা। উফশী ও হাইব্রিড জাতের ১৩ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে আউশের চাষাবাদ হয়েছে। হেক্টরে আউশ উৎপাদন লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪ দশমিক ৫০ মেট্রিকটন

রাজশাহী কৃষি তথ্য সার্ভিস এর তথ্যমতে, শ্রাবন মাসে আউশ ধান পাকে। কিন্তু এবার তীব্র খড়া ও বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় কাটা-মাড়াই শুরু হতে দেরি হবে। আগামী ৩৫-৪০ দিনের মধ্যে এ অঞ্চলে আউশ কাটা শুরু হবে বলে জানিয়েছেন ধান চাষিরা।

নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার উত্তরগ্রাম গ্রামের কৃষক রেজাউল ইসলাম জানান, আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বৃষ্টি নেই। কৃষকেরা এটা ভাবতেই পারছে না। এ রকম বৈরী আবহাওয়া আগে কখনই দেখেননি। গত কয়েকদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আউশ খেত পরিচর্যা ও আমনের চারা রোপণে ব্যবস্ত সময় পার করছেন তিনি। একই কথা বলেন আরও ২০-২৫ জন কৃষক।

বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন জেলার অন্তত ১০ জন কৃষক জানান, আউশ ও আমন ধানে সেচ দিয়ে চাষ করলে তেমন একটা লাভ হয় না। এ সময় ধান রোপণ করতে প্রকৃতির বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। এবার বৃষ্টি দেরিতে হওয়ায় সেচ দিয়ে জমি চাষ করা শুরু করেছিলেন তারা। এখন বৃষ্টি হওয়ায় আর সেচ দিয়ে জমি চাষ করতে হচ্ছে না। এই বৃষ্টি তাদের জন্য আশির্বাদ বয়ে এনেছে।

তারা আরও জানান, এতদিন বৃষ্টি না থাকায় ধান রোপণ করতে পারেননি। এখন বৃষ্টি হওয়ায় আমন রোপণে ব্যস্ত। বৃষ্টি দেরিতে আসায় আমন ধান রোপেণ অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। ধান উৎপাদনে খরচ বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনে প্রকৃতির এমন বিরুপ আচরণে ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন বলেও জানান চাষিরা

নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা অরুন চন্দ্র রায় জানান, উপজেলার প্রতিটি মাঠে ধান চাষিদের পরামর্শ ও পরিচর্যার বিষয়ে দিক নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। বৃষ্টির অভাবে আমনের চারা রোপণে বিলম্ব হলেও লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। কৃষকদের দ্রুত আমনের চারা রোপণের পরামর্শ দেন এই কৃষি কর্মকর্তা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম জানান, গত মঙ্গলবার চাঁপাইনবাবগঞ্জে মুষলধারে বৃষ্টিপাত হয়েছে। এখানকার চাষিরা আমন রোপনে মহাব্যস্ত। জেলার এবার ৫৩ হাজার ৬৪০ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার শতকরা ৪৫ ভাগ জমিতে চারা রোপণ সম্পন্ন হয়েছে বলেও জানান তিনি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী আঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক শামছুল ওয়াদুদ জানান, প্রকৃতিতে এখন বৃষ্টি হতে শুরু করেছে। সামনে আরও বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। ভাদ্র মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চারা রোপণ করা যাবে। আমন চাষে লক্ষ্যমাত্রা অজির্ত হওয়ার পাশাপাশি আউশ উৎপাদনে লক্ষ্য অতিক্রমের প্রত্যাশা করছেন তিনি।

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এর নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশীদ জানান, সেচযন্ত্রগুলো প্রস্তুত রয়েছে এবং প্রয়োজন মতো তারা সেচকার্য পরিচালনা করছেন।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ