পরিবেশ ও জলবায়ু ডেস্ক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুরের পুনর্ভবা নদী থেকে হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে নওগাঁর সাপাহার উপজেলার এক বিশাল প্রাকৃতিক জলাভূমি জবই বিল। এই বিল ২৮ প্রজাতির পাখির কলরবে মুখরিত হয়ে উঠেছে।

প্রায় দুই হাজার হেক্টর আয়তনের এ বিলে প্রতি বছরের মতো এবারো সাইবেরিয়াসহ বিশ্বের শীতপ্রধান নানা দেশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখির দল আসতে শুরু করেছে।

বর্তমানে পরিযায়ী পাখির কলরবে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি মুখরিত হয়ে উঠছে বিলের চারপাশ। তা দেখতে নিয়মিত ভিড় জমাচ্ছেন নওগাঁসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা। বিলটির একটি অংশ বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ অঞ্চল হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন পাখিপ্রেমীরা।

জানা যায়, নওগাঁ জেলা শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে সাপাহার উপজেলার শিরন্টি, গোয়ালা, আইহাই ও পাতাড়ী ইউনিয়নের ডুমরইল, বোরা মির্জাপুর, মাহিল, কালিন্দার এবং ভুতকুড়িসহ পাঁচটি বিলের সমন্বয়ে গঠিত জবই বিল। জবই গ্রামের কাছাকাছি হওয়ায় লোকমুখে এর নাম “জবই বিল” হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রায় সারা বছর প্রাণ-প্রকৃতিতে মুখরিত থাকলেও শীতকালে বদলে যায় এ বিলের পরিবেশ।

সাইবেরিয়াসহ শীতপ্রধান বিভিন্ন দেশ থেকে আসা নানা প্রজাতির পাখ-পাখালির ডাকে ভিন্ন প্রাণের সঞ্চার হয় বিলটিতে। দেশীয় নানা প্রজাতির মাছে ভরপুর এ বিলে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিরাপদে থাকতে চায় পরিযায়ী পাখি। বিলটি বর্তমানে খাসজমি হিসেবে উপজেলা প্রশাসনের অধীনে আছে।

স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, বর্ষা মৌসুমে এর আয়তন প্রায় ২ হাজার হেক্টর এবং শুকনো মৌসুমে প্রায় দেড় হাজার হেক্টর। তবে সরকারি হিসাবে এ বিলের আয়তন ৪০৩ হেক্টর।

সম্প্রতি জবই বিল ঘুরে দেখা যায়, কুয়াশায় মোড়ানো সকালে চারিদিকে যখন সুনসান নীরবতা, ঠিক তখন থেকেই শুরু হয় পরিযায়ী পাখি ওড়াওড়ি। বিলজুড়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি অবস্থান নেয় পাখির ঝাঁক।

এ সময়ে চারিদিকে থাকে পাখির কলরবে মুখর। এসব পাখির পাতিসরালি, ভূতিহাঁস, শামুকখোল, চখাচখি বলে ডাকেন স্থানীয়রা। প্রায় ২৮ প্রজাতির দেশী ও পরিযায়ী পাখির উপস্থিতির দেখা মেলে এ বিলে। পরিযায়ী পাখি ছাড়াও পানকৌড়ি, ছন্নিহাঁস, বকের দেখা মেলে বিলজুড়ে। দূর থেকে এসব পাখি দেখতে হাঁস বলে মনে হলেও কাছে গেলে সেই ভুল ভাঙে দর্শনার্থীর। মানুষের উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্রই দলবেঁধে আকাশে উড়াল দেয় পাখি।

সম্প্রতি জবই বিলে ডিএসএলআর ক্যামেরায় পাখির ছবি তুলছিলেন কাজী ইসতেখার আহম্মেদ। ঢাকা ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে সপ্তম সেমিস্টারে অধ্যয়নরত এ শিক্ষার্থী বলেন, ‘বাবার চাকরির সুবাদে নওগাঁয় মাধ্যমিক অবধি দুই বছর থাকার সুযোগ হয়েছিল। সীমান্ত পাবলিক স্কুলে অধ্যয়নরত অবস্থায় এ বিলে পরিযায়ী পাখিদের বিচরণের অনেক গল্প শুনেছি। কিন্তু বাবা বগুড়ায় বদলি হওয়ায় কখনো আসার সুযোগ হয়নি। প্রায় সাত বছর পর নওগাঁয় বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। হাতে সময় ছিল তাই পাখির কলরব শুনতে এবং নানা প্রজাতির পাখি দেখতে চলে এলাম। পাখির ছবি তুলতে অনেক ভালো লাগছে।’

পাশের জয়পুরহাট জেলা সদরের বিশ্বাস পাড়া থেকে আসা দর্শনার্থী মিম খাতুন বলেন, সাপাহারে মামার বাড়ি হওয়ার সুবাদে তিন বছর আগেও জবই বিল দেখতে এসেছিলাম। তখনকার চেয়ে বিলের বর্তমান চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। আগে এখানে পাখি দেখতে এলে বসার কোনো জায়গা ছিল না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখতে হতো। আর এখন বিলের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া সড়কে অসংখ্য বেঞ্চ স্থাপন করা হয়েছে। এখানে আসার পর প্রচুর পরিমাণে পাতি সরালি ও শামুকখোল পাখি দেখলাম। পাখির কলকাকলি শুনলে মনে একটা প্রশান্তি কাজ করে।

সাপাহার উপজেলা সদরের বাসিন্দা মোনেম শাহরিয়ার নবাব বলেন, ‘বর্তমান উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জবই বিলে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে দর্শনার্থী এলে পাখির ছবি ছাড়া তেমন আর কোনো ছবিই তুলতে পারত না। বসে সময় কাটানোর মতো ব্যবস্থাও ছিল না। এখানে জবই বিল লেখা পয়েন্ট স্থাপনসহ দৃষ্টিনন্দন বসার জায়গা করে দিয়েছে প্রশাসন। এ উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।’

জবই বিল জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সমাজকল্যাণ সংস্থার সভাপতি সোহানুর রহমান বলেন, ‘পাখির আবাসস্থল রক্ষা এবং নিরাপদ বিচরণে ২০১৮ সাল থেকে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ৫২ সদস্যের প্রচেষ্টায় বর্তমানে বিলকে শিকারিমুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। আবহাওয়া ভালো থাকায় এবার প্রায় ২৫ হাজার পরিযায়ী পাখি বিলে এসেছে।

মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে প্রতি বছর শীতকালে দুই মাস এ বিলে মাছ ধরা উন্মুক্ত করে দেয়ায় জেলেদের কারণে পাখির বিচরণ বাধাগ্রস্ত হয়। এভাবে মাছ ধরা অব্যাহত রাখলে আগামীতে এ বিলে পরিযায়ী পাখি আসা বন্ধ করে দিতে পারে।’ সংকট নিরসনে এ বিলে বন বিভাগের অধীনে থাকা ভুতকুড়ি অংশকে “জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ অঞ্চল” হিসেবে ঘোষণার দাবি জানান তিনি।

সাপাহার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্ল্যাহ আল মামুন বলেন, হাজার হাজার জেলের জীবিকার একমাত্র উৎস জবই বিল। বিলে মাছ ধরার সময় পরিযায়ী পাখির বিচরণে কিছুটা সমস্যা হয় এটা সঠিক। তবে পরিযায়ী পাখির উপস্থিতির পাশাপাশি শীতকালে মাছ আহরণও জরুরি। বিলের একটি অংশকে পাখির জন্য সংরক্ষণাঞ্চল করার বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

তিনি বলেন, শীত মৌসুমে পরিযায়ী পাখি দেখতে, পাখির ছবি তুলতে এবং বর্ষা মৌসুমে নৌ-ভ্রমণ করতে নওগাঁসহ পাশের বিভিন্ন জেলা থেকে পর্যটকরা আসেন জবই বিলে। বিলকেন্দ্রিক পর্যটন বিকশিত হলে জবই বিলের ওপর নির্ভরশীল জেলেদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসবে। আগামীতে পর্যটকের কাছে এ বিলকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে নানা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের প্রস্তুতি চলছে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ