মাশরুম কেন চাষ করবো

. নিরদ চন্দ্র সরকার, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: নিরাপদ সবজি মাশরুমের ওষধিগুণ, চাষ পদ্ধতি ও ভালো ফলনের কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরা হলো।

মাশরুম হলো খাবার উপযোগী ছত্রাকের ফলন্ত অঙ্গ যা অত্যন্ত পুষ্টিকর, সুস্বাদু ও ঔষধিগুণসম্পন্ন। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ মুখোরোচক খাবার হিসেবে মাশরুম গ্রহণ করে আসছে এবং বর্তমান বিশ্বে সব দেশের মানুষই মাশরুম খেয়ে থাকে।

পবিত্র কোরআন ও হাদিসে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ খাবার হিসেবে মাশরুমের কথা উল্লেখ আছে। বাংলাদেশ একটি ঘন বসতিপূর্ণ দেশ। এদেশের প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১০৯০ জন মানুষ বাস করে এবং প্রতি বছরে ১.৩৭% হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

এদেশে চাষের আওতায় জমির পরিমাণ বাড়িয়ে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ক্রমবর্ধমান এ জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি জোগানের জন্য এমন একটি ফসল দরকার যা পুষ্টিকর, সুস্বাদু ও ঔষধিগুণ সম্পন্ন এবং যা আবাদের জন্য কোন উর্বর জমির প্রয়োজন হয় না।

সেক্ষেত্রে মাশরুম সবজি চাহিদা পূরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

মাশরুমের পুষ্টি ঔষধিগুণ: মাশরুমে প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেলের পরিমাণ খুব বেশি। অপরপক্ষে চর্বির পরিমাণ খুব কম, নাই বললেই চলে। মাশরুমের প্রোটিন হলো অত্যন্ত উন্নত, সম্পূর্ণ এবং নির্দোষ।

মানব দেহের অত্যাবশ্যকীয় ৯টি এমাইনো এসিডের সবগুলোই মাশরুমে আছে। প্রাণিজ আমিষ যেমন- মাংস ও ডিমের আমিষ উন্নত ও সম্পূর্ণ হলেও তার সঙ্গে সম্পৃক্ত চর্বি থাকায় দেহে কোলেস্টেরল সমস্যা দেখা দেয়।

যার ফলে উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, মেদভুঁড়ি ইত্যাদি জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পক্ষান্তরে মাশরুমের প্রোটিন নির্দোষ। চর্বি ও কার্বোহাইড্রেটের নিম্ন উপস্থিতি এবং কোলেস্টেরল ভাঙ্গার উপাদান লোভাস্টাটিন, এন্টাডেনিন, ইরিটাডেনিন ও নায়াসিন থাকায় শরীরে কোলেস্টরল জমার ভয় থাকে না।

এ কারণে প্রোটিনের অন্যান্য সব উৎসের তুলনায় মাশরুমের প্রোটিন উৎকৃষ্ট ও নির্দোষ। নিয়মিত খেলে মাশরুম ডায়াবেটিস  ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে; ক্যান্সার, জন্ডিস ইত্যাদি প্রতিরোধ করে; হৃদরোগ, টিউমার, যৌন অক্ষমতা, রক্তস্বল্পতা ও মেদভুঁড়ি ইত্যাদি প্রতিরোধ ও নিরাময় করে; হাড় ও দাঁত শক্ত করে এবং চুল পাকা ও চুলপড়া রোধ করে।

বাংলাদেশে মাশরুম চাষ: বাংলাদেশে প্রকৃতিকে ব্যবহার করেই বিভিন্ন প্রকার মাশরুম চাষ করা যায়। বর্তমানে মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট থেকে ৭ প্রকারের মাশরুম চাষের জন্য পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

ঋতুভেদে উপযুক্ত মাশরুম চাষ করতে পারলে উচ্চমূল্যের এবং ব্যয়বহুল শীতলীকরণ যন্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। ওয়েস্টার ও কান মাশরুম সারা বছরই চাষ করা যায় যদিও পিংক ও পিও-১০ ওয়েস্টার ব্যতীত সকল ওয়েস্টারের ফলন গরমকালে একটু কমে যায়।

গ্রীষ্মকালে মিল্কি, স্ট্র ও ঋষি মাশরুম এবং শীতকালে শীতাকে ও বাটন মাশরুম চাষ করা যায়।

মাশরুম চাষ পদ্ধতি: বীজ উৎপদন/ সংগ্রহ: মাশরুম উৎপাদন করার জন্য স্পন বা বীজের প্রয়োজন হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারি মাশরুম ইনস্টিটিউট  বা বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা মাশরুম ফার্ম থেকে বীজ সংগ্রহ করে মাশরুম চাষ করা যাবে।

তবে নিজের বীজ নিজে তৈরি করে নেয়াই ভালো। এজন্য মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট থেকে সহজ পদ্ধতিতে ধানের খড়ে এবং কাঠের গুঁড়ায় মাশরুম বীজ উৎপাদন কৌশল হাতে কলমে শিখে নিতে হবে।

ধানের খড়ে ওয়েস্টার মাশরুম চাষ: খড় বাংলাদেশের সর্বত্র পাওয়া যায় এবং দামও তুলনামূলকভাবে সস্তা। খড় দিয়ে একজন লেখাপড়া কম জানা মানুষও সহজেই নিজের   প্রয়োজনীয়   মাশরুম বীজ নিজে তৈরি করে নিতে পারেন।

প্রয়োজনীয় উপকরণ: একটি বড় ড্রাম (২০০ লিটার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন), ড্রামের সমান মাপের নেট ব্যাগ, কয়েকটি ইট/ পাথর টুকরো, চুলা, থার্মোমিটার, রশি, পিপি ব্যাগ, রাবার ব্যান্ড, খড় কাটার যন্ত্র/ কাস্তে, খড়, পানি, ইত্যাদি।

খড় প্রক্রিয়াকরণ: একটি বড় ড্রাম একটি চুলার ওপর বসিয়ে তাতে ১৬০ লিটার পানি নিয়ে তাপ দিতে হবে।

পানির তাপমাত্রা ৬০০ সে. অথবা ১৪০০ ফা. হলে ১২ কেজি চকচকে সোনালি রঙের কাটা খড় (২/৩ ইঞ্চি করে কাটা) একটি নেটের ব্যাগে ভরে ওই পানিতে ডুবিয়ে দিতে হবে এবং ড্রামের মুখ একটি ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।

পানির তাপমাত্রা মাপার জন্য থার্মোমিটার ব্যবহার করতে হবে (থার্মোমিটার বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির দোকানে পাওয়া যায় তবে বর্তমানে দেশের সর্বত্রই পোলট্রি ফিড/ উপকরণের দোকানে পাওয়া যায়)।

খড় ভর্তি নেটের ব্যাগটি গরম পানিতে ডুবানোর জন্য ভালোভাবে পরিষ্কার করা কয়েকটি ইট বা পাথর টুকরা ব্যবহার করা যেতে পারে। এসময় লক্ষ্য রাখতে হবে, পানির তাপমাত্রা যেন ৬০ ডিগ্রি  সে. এর উপরে উঠে না যায়। এজন্য খড় পানিতে ডুবানোর সাথে সাথে চুলা বন্ধ করে দিতে হবে।

খড় পানিতে ডুবানের ঠিক এক ঘণ্টা পর নেটের ব্যাগটি পানি থেকে তুলে সাথে সাথে ঝুলিয়ে দিতে হবে এবং ঝুলন্ত অবস্থায় ২০/২২ ঘণ্টা রাখতে হবে। ঝুলিয়ে রাখার সময় যেন কোন ক্রমেই ১৬ ঘণ্টার কম না হয়। ঝুলন্ত খড় নেটের ব্যাগ থেকে বেড় করে পানির পরিমাণ পরীক্ষা করে নিতে হবে।

খড়ে পানির পরিমাণ এমন থাকতে হবে যাতে এক মুঠো খড় দুহাতে ধরে জোরে চিপ দিলে হাতে পানির রেখা দেখা দিবে কিন্তু ফোঁটা পড়বে না। খড়ে পানির পরিমাণ বেশি থাকলে একটু হালকা রোদে নেড়ে নেয়া যেতে পারে।

প্যাকেট তৈরি ইনকুবেশন: সাধারণত ৯ ঢ ১২” অথবা  ১২ ঢ ১৮” সাইজের পিপি ব্যাগে প্যাকেট তৈরি করা হয়। ৯ ঢ ১২” সাইজের ব্যাগের জন্য ৭৫ থেকে ১০০ গ্রাম এবং  ১২ ঢ ১৮” সাইজের ব্যাগের জন্য ১৫০ থেকে ২০০ গ্রাম মাদার কালচার ব্যবহারের প্রয়োজন হয়।

মাদার কালচার সরকারি বা বেসরকারি ফার্ম থেকে সংগ্রহ করতে হবে। এসব ফার্মের কাঠের গুঁড়ায় তৈরি বাণিজ্যিক স্পন প্যাকেটও খড়ের প্যাকেটের মাদার কালচার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। মাদার কালচার খড়ের প্যাকেটে স্তরে স্তরে অথবা সম্পূর্ণ মিশ্রিত করে দেয়া যেতে পারে।

মাদার কালচার মিশ্রিত খড় দিয়ে প্যাকেট ভর্তির পর প্যাকেটের মুখ রাবার ব্যান্ড বেঁধে দিতে হবে এবং প্যাকেটের গায়ে কাঠি (বল পয়েন্ট কলম) দিয়ে ৪ থেকে ৬টি ছিদ্র করে দিতে হবে। এসব ছিদ্রের ২/১ টি যেন প্যাকেটের তলায় থাকে।

অতঃপর প্যাকেটগুলোকে একটি ঘরে র‌্যাকের তাকে সাজিয়ে রাখতে হবে। গরমকালে প্যাকেটের তাপমাত্রা যাতে বেড়ে না যায় এজন্য ঘরে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

তৈরির ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে প্যাকেট সম্পূর্ণ সাদা হয়ে যায় অর্থাৎ মাশরুমের মাইসেলিয়াম দ্বারা পূর্ণ হয়ে যায়।

প্যাকেট কর্তন পরিচর্যা: প্যাকেট সম্পূর্ণ সাদা হওয়ার ৫-৭ দিন পর প্যাকেটের গায়ে ৪ থেকে ৮ জায়গায় ১ঢ১” করে কেটে চেঁছে দিতে হবে।

কাটার স্থানটি যে স্তরে মাদার কালচার দেয়া হয়েছিল সে স্তর বরাবর হলে ভালো হয়। অতঃপর প্যাকেটগুলো চাষ ঘরের তাকে সাজিয়ে অথবা ছিকায় ঝুলিয়ে দিনে ৩ থেকে ৮ বার হালকা পানি স্প্রে করতে হবে যাতে ঘরে উচ্চ আর্দ্রতা বজায় থাকে।

ঘরে সর্বদা উচ্চ আর্দ্রতা বজায় রাখলে, দিনের বেলা প্রয়োজনীয় আলো থাকলে, ঘর থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড বেড় করে দেয়ার ব্যবস্থা রাখলে ২/৪ দিনের মধ্যেই মাশরুমের অঙ্কুর দেখা যাবে এবং পরবর্তী ২/৪ দিনের মধ্যে মাশরুম সংগ্রহ করা যাবে।

একবার মাশরুম সংগ্রহের পর সংগৃহীত স্থান থেকে মাশরুমের গোড়া, ময়লা, ইত্যাদি চেঁছে পরিষ্কার করে আবার তাকে বসায়ে পানি স্প্রে করতে হবে। তাতে আবার মাশরুম আসবে। এভাবে একই প্যাকেট থেকে ৪ থেকে ৭ বার মাশরুম সংগ্রহ করা যাবে এবং প্রতি কেজি খড় থেকে অন্তত এক কেজি মাশরুম পাওয়া যাবে।

বিশেষ সতর্কতা: (১) খড়গুলো যেন চক চকে সোনালি রঙের হয়, (২) প্রতি ব্যাগে খড়ের পরিমাণ যেন ১০ থেকে ১৪ কেজির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, (৩) পানির তাপমাত্রা যেন ৬০ ডিগ্রি সে. বা ১৪০ ডিগ্রি ফা. এর বেশি এবং ৫৫ ডিগ্রি সে. বা ১৩১ ডিগ্রি ফা. এর কম না হয়,

(৪) গরম পানিতে যেন এক ঘণ্টার বেশি বা কম সময় না থাকে, (৫) খড়ের ব্যাগ ঝুলন্ত অবস্থায় যেন কোন ক্রমেই ১৬ ঘণ্টার কম না থাকে।

খড়ে মিল্কি মাশরুম চাষ করতে হলে খড় প্রক্রিয়াকরণ ও প্যাকেট তৈরি ওয়েস্টার মাশরুমের মতোই হবে। মাইসেলিয়াম রান পূর্ণ হলে প্যাকেট কর্তনের পরিবর্তে খুলে দিয়ে এক থেকে দেড় ইঞ্চি পুরু করে কেজিং সয়েলের স্তর দিতে হবে এবং দিনে ২/ ১ বার হালকা পানি স্প্রে করতে হবে।

মাশরুমের ভালো ফলন পাওয়ার উপায়: মাশরুমের ভালো ফলন পাওয়ার জন্য (১) উন্নত জাতের ভালো মানের বীজ সংগ্রহ/ তৈরি করতে হবে; (২) মৌসুম  অনুযায়ী মাশরুম ও তার জাত নির্বাচন করতে হবে এবং (৩) চাষ ঘরে উচ্চ আর্দ্রতা বজায় রাখতে হবে, মাশরুম অনুযায়ী প্রয়োজনীয় তাপ ও আলো বজায় রাখতে হবে এবং পরিমিত অক্সিজেন প্রবেশের এবং অতিরিক্ত কার্বনডাই অক্সাইড বেড় করার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

মাশরুম সংগ্রহ সংরক্ষণ: মাশরুম যথেষ্ট বড় হয়েছে কিন্তু মাশরুম পিলিয়াসের কিনারা পাতলা হয়ে ফেটে যায়নি এমতাবস্থায় মাশরুম সংগ্রহ করতে হবে।

এক হাতে প্যাকেট ধরে অন্য হাতের পাঁচ আঙুলের সাহায্যে আলতো মোচড় দিয়ে মাশরুম তুলে নিতে হবে। সংগৃহীত মাশরুম গোড়া কেটে পরিচ্ছন্ন করে  গ্রেডিং করতে হবে এবং গ্রেড অনুযায়ী পিপি ব্যাগে ভরে সিলিং করতে হবে এবং তুলনামূলকভাবে ঠাণ্ডা জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে।

রেফ্রিজারেটরে মাশরুম সংরক্ষণ করতে চাইলে রেফ্রিজারেটরের সাধারণ তাপে (৯-১১ ডিগ্রি সে. তাপে) রাখতে হবে। মাশরুম শুকিয়ে এবং শুকনো মাশরুম পাউডার করে সংরক্ষণ করা যায়।

নিরাপদ সবজি মাশরুমের ওষধিগুণ, চাষ পদ্ধতি ও ভালো ফলনের কৌশল শিরোনামে লেখাটি লিখেছেন ড. নিরদ চন্দ্র সরকার, উপপরিচালক, মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, ডিএই, সাভার।

আরও পড়ুন: মাশরুম কেন চাষ করবো, পর্ব-০২