নিজস্ব প্রতিবেদক: হ্যাচারিতে কৃত্রিম প্রজনন ঘটিয়ে মৎস্য গবেষকেরা কোরাল মাছের পোনা উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছেন। হ্যাচারিতে উৎপাদিত এই পোনা মিঠা ও লোনা উভয় ধরনের পানিতে চাষ করা যাবে। হ্যাচারির কোরাল খাবার (ফিড) খেয়ে অভ্যস্ত হওয়ায় অন্যান্য প্রজাতির মাছের ক্ষতিরও আশঙ্কা নেই। ফলে পুকুরে চাষ হবে সামুদ্রিক কোরাল।

মূলত এত দিন সমুদ্র উপকূল থেকে কোরাল (ভেটকি) মাছের পোনা সংগ্রহ করে চিংড়িঘেরে চাষ করা হতো। তাতে কোরাল মাছ ঘেরের চিংড়িসহ অন্যান্য প্রজাতির মাছ খেয়ে ফেলত। চাষিদের লাভের বদলে গুনতে হতো লোকসান। এখন

আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে এই পোনা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি শুরু হবে। তখন কক্সবাজার, বাগেরহাট, খুলনাসহ দেশের উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপকভাবে কোরাল মাছ চাষ করা সম্ভব হবে। এই মাছ রপ্তানির মাধ্যমে আয় করা যাবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা।

দেশে প্রথম সামুদ্রিক কোরালের কৃত্রিম প্রজনন ঘটিয়ে পোনা উৎপাদনের এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে কক্সবাজার শহরের কলাতলীর গ্রিনহাউস মেরিকালচার হ্যাচারি। হ্যাচারির প্রধান গবেষক মোদাব্বির আহমেদ খন্দকারের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি দল এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেয়।

মৎস্য অধিদপ্তরের ‘টেকসই উপকূলীয় এবং সামুদ্রিক মৎস্য প্রকল্প’–এর (সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট) আওতায় কোরাল মাছের পোনা উৎপাদনের এ গবেষণা হয়েছে। এটি প্রধানমন্ত্রীর একটি অগ্রাধিকার প্রকল্প। এ গবেষণার জন্য অর্থসহায়তা দিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর।

গ্রিনহাউস মেরিকালচার হ্যাচারিতে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দেশের প্রথম কোরাল মাছের পোনা উৎপাদনের সত্যতা নিশ্চিত করেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান। তিনি বলেন, সম্প্রতি তিনি হ্যাচারি পরিদর্শন করে পোনা উৎপাদন কার্যক্রম দেখেছেন। এটি একটি সফল গবেষণা বলা যায়। হ্যাচারিতে একটি মা কোরাল প্রজননের পর ১০ লাখ ডিম ছেড়েছে এবং সেখান থেকে ৬ লাখ রেণু জন্ম নেয়।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান আরও বলেন, এখন রেণুগুলো হ্যাচারিতে লালন-পালন করা হচ্ছে। পোনা প্রজননের একটা ট্রায়াল সফল হয়েছে। পুরোপুরি সাফল্য পেতে হলে আরও দু-তিনটি ট্রায়াল দিতে হবে। তাতে সাফল্য এলে তখন বাজারে ছাড়া হবে পোনা। এরপর অন্যান্য হ্যাচারিতেও এই প্রযুক্তি উন্মুক্ত করা হবে। উদ্দেশ্য, কম দামে সারা দেশের চাষিরা যেন কৃত্রিম প্রজননের এই পোনা হাতের নাগালে পেতে পারেন।

গবেষণাকাজটি সম্পন্ন করতে মৎস্য–গবেষক মোদাব্বির আহমেদ খন্দকারের সময় লেগেছে ২০ মাস। এর পেছনে ব্যয় হয়েছে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকার বেশি। ৪ নভেম্বর হ্যাচারিতে মা কোরাল ডিম ছাড়লে গবেষণাটি আলোর মুখ দেখে। এই সাফল্যে দারুণ খুশি গবেষক দল।

দেশের প্রথম কোরাল মাছে পোনা উৎপাদনের এই গবেষণায় ভিয়েতনাম, ভারত ও শ্রীলঙ্কার কোরাল হ্যাচারি–বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নিয়েছেন গবেষক মোদাব্বির আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নিবিড়ভাবে সামুদ্রিক কোরালের কৃত্রিম প্রজননের প্রচেষ্টা সফল করতে তাঁদের ২০ মাস সময় লেগেছে। ৪ নভেম্বর কোরালের কৃত্রিম প্রজনন সফলভাবে সম্পন্ন হয়। ওই দিন রাতে হ্যাচারির স্পিনিং ট্যাংকে একটি মা কোরাল ১০ লাখ ডিম ছাড়ে এবং সেখান থেকে ৬ লাখ রেণু পোনা জন্ম নেয়।

এগুলো বর্তমানে হ্যাচারিতে প্রতিপালন করা হচ্ছে। রেণু বড় হলে ক্রমান্বয়ে সেগুলো নার্সারি পুকুর ও ঘেরে চাষ করা যাবে। এই মাছ সমুদ্রের লোনাপানির খাঁচা, উপকূলের স্বল্প লোনাপানির পুকুর ও মিঠাপানির পুকুরে চাষ করা যাবে।

গ্রিনহাউস মেরিকালচারের স্বত্বাধিকারী তারিকুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে কোরাল মাছের পোনা উৎপাদনে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশও এক ধাপ এগিয়ে গেল। দেশের চাহিদা মিটিয়ে কোরাল মাছ রপ্তানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যাবে।

বর্তমানে দেশের চিংড়িঘেরে যে কোরালের চাষ হচ্ছে, তার পোনা প্রকৃতি থেকে আহরণ করা হয় বলে জানান জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান। তিনি বলেন, দেশের দক্ষিণ–পশ্চিম অঞ্চলে প্রকৃতি থেকে অধিকাংশ কোরালের পোনা ধরে চিংড়িঘেরে ছাড়া হয়। এই পোনা ফিড (খাদ্য) খায় না, জীবিত মাছ খায়।

অন্যদিকে, হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনা ফিড দিয়ে লোনা ও মিঠাপানিতে চাষ করা যাবে। কোরাল সুস্বাদু মাছ, শরীরে কাঁটাও কম। আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদাও অনেক বলে জানান বদরুজ্জামান। তিনি আরও বলেন, দেশের উপকূলীয় জেলাগুলো কোরাল চাষের আওতায় আনা গেলে দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে।

গবেষক মোদাব্বির আহমদ খন্দকার বলেন, হ্যাচারিতে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত কোরালের পোনা বাজারে ছাড়তে আরও দুই সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। থাইল্যান্ড থেকে কোরালের পোনা আমদানি করতে খরচ পড়ে প্রতিটিতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। আরও কম দামে হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনা বাজারে বিক্রি সম্ভব হবে।

কোরাল মাছ তাদের জীবনচক্রের প্রথম দু–তিন বছর (৫ কেজি পর্যন্ত) পুরুষ থাকে বলে জানান গবেষক মোদাব্বির আহমদ খন্দকার। তিনি বলেন, পরবর্তী সময়ে স্ত্রী মাছে রূপান্তরিত হয়। কোরাল মাছ মূলত জীবন্ত মাছ ও চিংড়ি খেয়ে জীবন ধারণ করে। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের মাধ্যমে এদের সম্পূরক খাদ্যে অভ্যস্ত করা হয়। প্রয়োজনীয় পুষ্টি প্রদানের মাধ্যমে ডিম ধারণের উপযোগী করা হয়। এ ক্ষেত্রে কিছু স্ত্রী মাছ ও কিছু পুরুষ মাছকে পূর্ণাঙ্গ প্রজননক্ষম করার জন্য প্রয়োজনীয় হরমোনও দিতে হয়। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত সময় লাগে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ/২০২৩