প্রতিবন্ধকতার বেড়াজালে বাজার যেতে

আবু খালিদ, সিনিয়র রিপোর্টার, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: কয়েক মাসের পরিশ্রমে গড়ে তোলা পেঁপে বাগানের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছেন না আছিয়া বেগম। কোন গাছের পেঁপে পাখি খেয়ে নষ্ট করেছে, কিছু গাছে পাকা পেঁপে ঝুলে আছে, কখন বা নষ্ট হয়। আপ্রাণ চেষ্টা করেও বিক্রি করতে পারছেন না তিনি।

দুই-একজন ফড়িয়া এসে এত কম দাম বলছেন, তা শুনে কষ্টের পরিমাণ আরও বেড়ে যাচ্ছে তার। না পারছেন নিজে বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে, না পাচ্ছেন কারও সহায়তা। পরিশ্রমের ফল এভাবে শেষ হয়ে যাওয়ায় মন ভার করে বসে আছেন তিনি।

গত ২৯ ডিসেম্বর (২০১৯) এমন দৃশ্যের দেখা মেলে সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার মাধাইনগর ইউনিয়নে। আছিয়া বেগম এগ্রিকেয়ার২৪.কম কে বলেন, প্রতিবছরই এমন অনেক ফসল, ফল নষ্ট হয়। উপায় না পেয়ে খুবই অল্প দামে বিক্রি করি। নিজের পরিশ্রমের পারিশ্রমিক তো পাই না, বরং যা খরচ হয় তার চেয়ে কম টাকা পাই।

তিনি বলেন, বাজারে গেলে নানা কথা শুনতে হয়। আর বাজারের পরিবেশও ভালো না। সেখানে কারও কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পাওয়া যায় না। মেয়ে মানুষ বাজারে এসেছে এই ভেবে সবাই হা করে তাকিয়ে থাকে।

শুধু ওই এলাকায় নয় একাধিক গ্রাম ও উপজেলা ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেলো। বাজারের পরিবেশ ভালো না হওয়ায় নিজেদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারছেন না গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তারা। বঞ্চিত হচ্ছেন ন্যায্য দাম থেকে।

সরেজমিনে একাধিক নারী উদ্যোক্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, অনেক চ্যালেঞ্জ আর প্রতিবন্ধকতার বেড়া জালে আঁটকে রয়েছেন তারা। অথচ সামন্য সহযোগিতা পেলে ‍ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা রয়েছে প্রত্যোকের মাঝে।

ফরিদপুরের নারী উদ্যোক্তা জাহানারা বেগম বলেন, জমি থেকে একটু দূরেই বাজার। সেখানে নিজের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারলে বেশি দাম পাবো। কিন্তু পরিবেশের কথা মনে হলে আর সাহস পাই না। এ কারণে পরিবারের পক্ষ থেকেও সমর্থন নেই।

তিনি বলেন, ওমুকের ছেলের বউ, ওমকের মা বাজারে গেছে/আসছে। মেয়ে-ছেলে বাজারে আসা ঠিক না। এমন নানা কথা উপেক্ষা করেও যদি বাজারে যাই, কিন্তু সেখানের পরিবেশ দেখে হতাশ হতে হয়।

‘টয়লেট ব্যবস্থাপনা একেবারেই নেই। পানি পান ও ছোট বাচ্চা রাখার স্থান নাই। পুরুষের আধিপাত্যে কথা বলা যায় না। দালালদের অত্যাচার রয়েছে। এরকম নানা সমস্যায় পরতে হয়।’ যোগ করেন তৃণমূলের এই নারী উদ্যোক্তা।

এদিকে সামান্য সহযোগিতা আর বাজারের অনুকূল পরিবেশে বদলে যেতে পারে এসব গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের জীবন যাপন। গ্রামীণ অর্থনীতিও হতে পারে আরও মুজবুত। তারও অনেক উদাহরণ রয়েছে।

সহযোগিতার ছোঁয়ায় অনেক গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের সংসারের চিত্র বদলে গেছে। মলিন হাসির পরিবর্তে মুখে লেগে আছে প্রশান্তির হাসি।

এরকমই একজন গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তা শিরিন আক্তার। বগুড়া জেলার গাবতলী থানার তৃণমূলের এই নারী একসময়ে পরিবারের গতানুগতিক কাজ করেই সময় পার করতেন। একশনএইড বাংলাদেশ এর ‘মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর উইমেন (এমএমডব্লিউডব্লিউ)’ প্রকল্প এর পক্ষ থেকে সহযোগিতা পেয়ে তিনি এখন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে সমাজে স্বীকৃতি লাভ করেছেন।

ব্যবসায়ী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় খুব খুশি শিরিন আক্তার। তিনি বলেন, নিজের নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হয়েছে। একের পর এক সফলতা ধরা দিচ্ছে হাতের মুঠোয়। তিনিই এক সময়ে নিজের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে না পেরে মন খারাপ করে বসে থাকতেন। আর্থিক ক্ষতিও হয়েছে তার।

আলাপকালে শিরিন আক্তার এই প্রতিবেদককে বলেন, বাজারে যেতে না পারায় পণ্য নষ্ট হতো। ওজনে কারচুপি করতো, এখন ওজন নিজেই দিতে পারি। পণ্যের মোড়কীকরণ করে বিক্রি করছি, ফলে পণ্য নষ্টও হচ্ছে না।

হাসিমুখে তিনি বলেন, নিজের একটা ব্যবসায়ী ঠিকানা হয়েছে। ভালো দামে পণ্য বিক্রি করে অধিক আয় করছি। সমাজে একটা অবস্থান তৈরি হয়েছে। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত পাওয়ায় নিজের মধ্যেও অনেক বেশি ভালোলাগা কাজ করছে। বেসরকারি একটি উন্নয়ন সংস্থার (এমএমডব্লিউডব্লিউ) সহযোগিতার কারণেই আমার এই পরিবর্তন হয়েছে।

গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব রুরাল সোস্যালজি এসোসিয়েট প্রফেসর ড. লাভলু মজুমদার। এ গবেষক এগ্রিকেয়ার২৪.কম কে বলেন, নারী উদ্যোক্তাদের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সফল হতে হচ্ছে। অনেকেই এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন।

তিনি জানান, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার কম দক্ষতার কারণে পিছিয়ে পরছেন নারী উদ্যোক্তারা। বাজারের তথ্য সরবরাহের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থাও জরুরি।

উদাহরণ টেনে এ গবেষক বলেন, ধরুণ সব ধরণের প্রতিবন্ধকতা দূর করে একজন গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তা পণ্যটি উৎপাদন করলেন। এই সময়ে তার সামনে মহা-চ্যালেঞ্জ হিসেবে আর্বিভূত হয় ওই পণ্যটি বাজারজাতকরণ নিয়ে।

গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ আসে এবং সেগুলো সমাধানের পথ কী এ প্রশ্নের উত্তরে প্রফেসর ড. লাভলু মজুমদার বলেন, নারী উদ্যোক্তাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা বা প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হলে যেসব বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হতে তার মধ্যে অন্যতম হলো পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি।

তিনি বলেন, বাজারব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণ, তথ্য ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষিত করে তোলা, বাজারে পণ্য বিক্রির শতভাগ পরিবেশ তৈরি, (যেমন: ক্লাস্টার সেল এর মাধ্যমে হতে পারে), মূলধনের প্রাপ্যতা নিশ্চিতে পদক্ষেপ নেয়া, বিশেষ করে ব্যাংক ও ঋৃণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের শর্তসমূহ শিথিল ও আন্তরিকতা বৃদ্ধি, মেলা বা প্রদর্শনীর মাধ্যমে তাদের পণ্যগুলো তুলে ধরা, শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা: (বিভাগ-জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন-গ্রাম) ও বন্ডিং এবং ব্রিজিং নেটওয়ার্ক  ব্যবস্থা, ক্রেস্ট বা পুরস্কারের মাধ্যমে উৎসাহ প্রদান, সরকারি কার্যক্রমগুলোর তথ্য ছড়িয়ে দেয়াসহ বিভিন্ন কাজ করতে হবে।

ড. লাভলু মজুমদার বলেন, প্রতিটি হাট-বাজারে আলাদা একটি কর্ণার তৈরি করতে হবে। যেন সেখানে অবাধে নারী উদ্যোক্তারা স্বাচ্ছন্দ্যে তাদের উৎপাদিত পণ্যগুলো বিক্রি করতে পারেন। নারী বান্ধব পরিবেশের পাশাপাশি সামাজিক ও পারিবারিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

পণ্য বিপণনে নারীদের দক্ষ করতে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে যেন ন্যায্য দাম নিশ্চিত হয়। এতে তারা উৎসাহ পাবেন। হিসাব নিকাশে দক্ষ করে তুলতে প্রয়োজনে কমিউনিটি সার্ভিস চালু করা যেতে পারে বলে, মত প্রকাশ করেন ড. লাভলু মজুমদার।

‘যেমন সপ্তাহের এক অথবা দুইদিন আশপাশের স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা এসে এসব উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গেলো। এতে নারী উদ্যোক্তাদের গ্রামীণ বাজারে আগ্রহ তৈরি হবে।’ বলেন তিনি।

এ প্রতিবেদকের সঙ্গে দশ জন সফল নারী উদ্যোক্তার সাথে কথা হয় তারা সবাই একশন এইড-বাংলাদেশ এর এমএমডব্লিউডব্লিউ প্রকল্পের সহযোগিতায় খুব ভালো সময় পার করছেন। এদের মধ্যে ফরিদপুরের তাছলিমা, সোনিয়া, গাইবান্ধা এলাকার মিতি বেগমসহ অনেকেই জানান, একটু সহযোগিতা আর সাপোর্ট বদলে দিয়েছে তাদের জীবন যাপন।

তারা জানান, একজন নারী হিসেবে আত্মপ্রত্যয়ী হতে শিখেছেন তারা ওই প্রকল্পের মাধ্যমে। বিভিন্ন কৌশল ও তথ্য জানার সুযোগ পেয়েছেন। এখন আর তাদের পেছনের দিকে তাকাতে হয় না।

এমএমডব্লিউডব্লিউ প্রকল্পের অধীনে এসকেএস ফাউন্ডেশনের সহায়তায় মোছা. রাজেয়া খাতুনের জীবন বদলে গেছে। তিনি বলেন, এক সময়ে গরু বিক্রি করতে হিমশিম খেতে হতো। অনেক সময়ে কম দাম পেয়েছেন। কিন্তু এখন তিনি নিজেই অনলাইনে বিক্রি করতে পারেন।

গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের প্রফেসর ড. রাজিয়া বেগম বলেন, নারী বান্ধব গ্রামীণ বাজার নিশ্চিতে সরকার ও হাট কমিটির সার্বিক সহযোগিতা খুবই প্রয়োজন। তবে নারীদেরও এগিয়ে আসতে হবে। নারী উদ্যোক্তাদের পণ্যগুলো প্রচারের ব্যবস্থাও থাকতে হবে।

নারী উদ্যোক্তাদের বাজারমুখি করতে আগ্রহী করার পরামর্শ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের প্রফেসর ড. মো. মিজানুর রহমান।

তিনি বলেন, নারী বান্ধব গ্রামীণ বাজার প্রতিষ্ঠায় সবার সম্মিলিত চেষ্টা ও সহযোগিতা দরকার। নারী বান্ধব বাজারব্যবস্থাপনায় সরকারিভাবে যেসব পদক্ষেপ ও কার্যক্রম রয়েছে সেগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে।

‘নারী বান্ধব গ্রামীণ বাজার নিশ্চিতে পণ্য সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা দেয়াসহ যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে নারী উদ্যোক্তাদের জন্যে সেগুলো প্রচারণায় আনতে হবে।’ যোগ করেন প্রফেসর ড. মো. মিজানুর রহমান।