ফসল ডেস্ক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: ন্যানো ফার্টিলাইজার হচ্ছে ‘স্লো রিলিজার’। এটি ফসলের ক্ষেতে ব্যবহার করলে গাছের গোড়ায় জমা থাকবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী গাছকে পুষ্টি সরবরাহ করতে সক্ষম হবে। কোন অপচয় যেমন হবে না তেমনি গাছটিও সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করতে পারবে।

আকারে ছোট হওয়ায় বীজের ক্ষুদ্র ছিদ্র দিয়ে এই পার্টিকেল বীজের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেও প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ করতে পারবে। ফলে উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।

এনিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর এর উর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা কৃষিবিদ এম. আব্দুল মোমিন।

বিশ্বের সর্বাধুনিক ন্যানো টেকনোলজির সাহায্যে দেশের বিজ্ঞানীগণ ’ন্যানো ফার্টিলাইজার’তৈরীর উদ্যোগ নিয়েছেন। ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং উৎপাদন ব্যয় কমানোর পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে এটিকে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ কাউন্সিল ফর সাইন্টিফিক এন্ড ইন্ডাষ্ট্রিয়াল রিসার্স (বিসিএসআইআর) এর বিজ্ঞানীগণ ’ন্যানো ফার্টিলাইজার’তৈরীর পর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদনে যাবার জন্য নিজস্ব উদ্যোগে এর গবেষণা কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

ন্যানো টেকনোলজি বিশ্বের অত্যাধুনিক ক্ষুদ্র প্রযুক্তি যা সহজেই ফসলের মূলে প্রবেশ করে তার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ করতে পারবে। এর ব্যবহারে তৈরী সার ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপাদন ব্যয় হ্রাস এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাতেও সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।

ফসল উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ এলিমেন্ট সার। আগের দিনে মানুষ বাড়িতে যে সমস্ত আর্বজনা থাকতো, সেগুলোকে এক জায়গায় জমা করতো। গরুর গোয়াল থেকে যে সমস্ত গোবর বা গৃহপালিত পশু পাখির বিষ্ঠা আসতো সেগুলোকে পচিয়ে জমিতে দিতো, তারপরে ভাল ফসল হতো।

৬০ দশকের পর সার যখন বাজারে ইউরিয়া, নাইট্রেজেন, ফসফারস এবং পটাশ আসে, তখন সার দেওয়ার সাথে সাথে ফসল উৎপাদন বাড়া শুরু হলো। ন্যানো পার্টিকেলের আকার অনুর চাইতে সামান্য বড়ো। এটি ন্যানো মিটার দিয়ে পরিমাপ করা হয়।

১ ন্যানোমিটার সমান টেন টু দি পাওয়ার মাইনাস ৯ মিটার বা ১ বিলিয়ন অফ এ মিটার। বস্তুকে ভেঙ্গে যখন অতটা ক্ষুদ্রতর পর্যায়ে নেয়া হয় তখন তার কার্যক্ষমতা বহুলাংশে বেড়ে যায়, অনেকটা পারমাণবিক শক্তির মতো। বিসিএসআইআর এর কয়েকজন বিজ্ঞানী প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব উদ্যোগে ন্যানো ফার্টিলাইজার তৈরীর বিষয়ে গবেষণায় অনেক দূর এগিয়েছেন।

জমিতে কৃষকেরা ম্যাক্রো নিউট্রিয়েন্ট হিসেবে রাসায়নিক সার (এনপিকে) নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম ব্যবহার করে। নাইট্রোজেনের জন্য ইউরিয়া, ফসফরাসের জন্য টিএসপি এবং পটাশিয়ামের জন্য পটাশ সার ব্যবহার করা হয়।

যা জমিতে ছিটিয়ে ব্যবহার করতে হয় বলে মাত্র ৩০ থেকে ৩৪ ভাগ ব্যবহার হয়। আর শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ অপচয়ের মাধ্যমে ক্ষেতের পার্শ্ববর্তী জলাশয় বা অন্যান্য পানির সঙ্গে মিশে পরিবেশের ক্ষতি সাধন করে থাকে।

আমাদের দেশের কৃষকরা মনে করে বেশি সার দিলে উৎপাদন বেশি হয়। ফলে তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত সার ব্যবহার করে থাকেন, ক্ষেতে দেওয়ার সাথে সাথে প্রায় ৭০ ভাগ সার গ্যাস আকারে উড়ে যাচ্ছে, অথবা মাটির নীচে লিচিং হয়ে চলে যাচ্ছে। মাটি ও পানিতে মিশে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।

এতে একদিকে মাটির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, আরেকদিকে এমোনিয়া আকাশে উড়ে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কারণে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। তাহলে এ থেকে বের হবার উপায়টা কি? তাহলে আমরা এভাবেই ইউরিয়া, ফসফেট ও পটাশ দেবো বা সার ব্যবস্থাপনা করবো? গ্লোবাল ওয়ার্মিং এড়াতেই নতুন টেকনোলজি ন্যানো ফার্টিলাইজার এনছেন গবেষকরা।

আসুন জানা যাক ন্যানো ফার্টিলাইজার কিভাবে কাজ করে? এটা এমন একটি সার যেখানে ফসলের প্রয়োজনীয় অনেক পুষ্টি উপাদানকে অনেক কম মাত্রায়, একসাথে মিশিয়ে উপাদানগুলোকে কম্প্যাক্ট করে পলিমারাইজড করা হয়। ফলে স্থাযিত্ব বেড়ে যায়।

ফসলের গাছ দ্রুত এটা নিতে পারছে। এতে লাভ হচ্ছে একবার সার ব্যাবহার করে দুই ফসল ফলানো যাচ্ছে। কেননা, আমাদের দেশে এক বছরে প্রায় দুই বা তিনটি ফসল হয়। এখন ফসলের জন্য একাধিকবার সার দিতে হয়, এতে আনুপাতিক হারে মাটি ও পানি দূষিত হচ্ছে। আবার এমোনিয়া আকাশে উড়ে, বায়ুমন্ডল দূষিত হচ্ছে। কৃষককে কিন্তু এগুলো কিনতে হচ্ছে।

ভর্তুকি থাক আর যাই থাক, তারপরও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তাহলে উপায়টা কি? উপায় হচ্ছে এই ন্যানো ফার্টিলাইজার।

ন্যানো ফার্টিলাইজারের মাধ্যমে কম্প্যাক্ট নাইট্রোজেন, ফসফেট, পটাশ কিংম্বা অন্যান্য খাদ্য উপাদান পলিমারাইজড করে, গাছের গোড়ায় দিলে একবার ব্যবহার করে কমপক্ষে দুটো ফসল ফলানো সম্ভব। এটা আট মাস পর্যন্ত রাখা যায়।

তাহলে ফার্টিলাইজারে কিন্তু নতুন টেকনোলজি আসছে। এটা একটা বিষয়। দ্বিতীয়টি হলো এপ্লিকেশনের দিক দিয়ে বৈচিত্র আসছে। আমাদের দেশের কৃষক নাইট্রোজেন ফসফেট কিনে নিয়ে যায় বস্তা ধরে। তিনটা বস্তা নিলো, নিয়ে গিয়ে ক্ষেতের পাশে একটা চট পেড়ে নিলো। তার উপরে ঢেলে দিলো, তারপর হাত দিয়ে মিশানো শুরু করলো। এখন একটা ফসফেটের দানা একটা ইউরিয়ার দানার চেয়ে অনেক বড়।

আবার একটা ইউরিয়ার দানা ফসফেটের দানার চেয়ে অনেক ছোট। আর পটাশিয়াম এর দানাটা কৃষ্টাল। তিনটাকে মিশানো হলো। ছড়ানোর সময় কি হলো, বড় দানাটা আগে হাতে আসবে, তাহলে যে এলাকাতে বড় দানাটা পড়লো, সেখানে ফসফেট বেশি পড়লো। তারপর আরেক পাশে ইউরিয়া বেশি পড়লো। পরের পাশে পটাশিয়াম বেশি পড়লো।

একই ক্ষেতের মধ্যে, অর্থাৎ একটা কৃষকের ক্ষেত যদি বিশ শতক হয়, তার মধ্যে যদি তিন ভাগের এক ভাগে ফসফেট বেশি পড়ে, তারপর তিন ভাগের আরেক ভাগে ইউরিয়া বেশি পড়ে এবং তিন ভাগের অপর ভাগে পটাশিয়াম বেশি পড়ে, তাহলে কি হবে? ফলনের তারতম্য হবে।

ন্যানো ফার্টিলাইজার কিন্তুএকটা নতুন টেকনোলজি। এটাকে কিভাবে কৃষকের কাছে কমিউনিকেট করতে হবে। ইদানিংকালে আমরা যেটা করেছি, বাংলাদেশে তো ফার্টিলাইজার আইন আছে, পলিসি আছে এবং এগুলোর একটা মানদন্ড আছে। ন্যানো ফার্টিলাইজার হলো এখনকার সলিউশন বা সমাধান। ইতিমধ্যে ন্যানো ফার্টিলাইজারের টেস্ট ট্রায়েল শুরু করেছে বেসরকারি সংস্থা এসিআই লিমিটেড।

উদাহরণ হিসেবে ধরুন, চা বাগানের গাছগুলো আলাদা আলাদা থাকে। গাছের গোড়ায় যদি ৫০ গ্রামের গ্রানয়েল (ন্যানো ফার্টিলাইজার) দিয়ে দেয়া হয়, সেটা চায়ের যে লাইফ সাইকেল আছে অর্থাৎ উৎপাদনের সময়টা সাত আট মাস, এই পুরো সময়টা চা উৎপাদন করা যাবে।

চা বাগানে সার ছড়িয়ে দিলে বৃষ্টি হলে পানিতে গড়িয়ে নিচে চলে যায়। অনেক সময় লিচিং হয় না, মাটিতে মেশে না। সেক্ষেত্রে গাছের গোড়াতে ফার্টিলাইজারটা ঠিকমত পৌছাচ্ছে না। এই ন্যানো ফার্টিলাইজার চা বাগানে অনেক বেশি দেওয়া লাগবে না। বেশিবার দেওয়া লাগবে না এবং তার ফলনটা ঠিকই পাওয়া যাবে। এতে করে একদিনে একজন শ্রমিক এক একর জমিতে সার ছিটাতে যে পরিমান খরচ হয় তার অনেক কম খরচ হবে, বাড়তি লেবার লাগবে না, তেমনি বাড়তি সারও লাগবেনা।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে অর্গানিক ফার্টিলাইজার। আমাদের জমিগুলো প্রতিনিয়ত চাষবাষের কারণে কম্প্যাক্ট হয়ে যাচ্ছে। মাটির নীচে কিন্তু অক্সিজেন দরকার এবং মাটি ফাঁপা হওয়া দরকার। এক্ষেত্রে এখানে যদি অর্গানিক সার না দেই তাহলে কিন্তু জমির সমস্যা হবে।

আমাদের দেশে কিন্তু অনেক কিছুর ওয়েস্টেজ হয়, যেমন কুসরের ছোবড়া, পাটকাঠি, বাড়ির আবর্জনা, গোবর, মুরগির বিষ্ঠা সবকিছু মিলে কিন্তু অনেক ওয়েস্ট আছে। এই ওয়েস্টগুলোকে যদি আমরা সঠিক নিয়মে একসাথে করে মাইক্রোবিল দিয়ে ট্রিট করতে পারি, তাহলে হবে কি এই সমস্ত ফার্টিলাইজর যেমন একদিকে মাটি ফাঁপা করবে।

আরেকদিকে পানির রিটেনশন বাড়াবে। পানি ধারণক্ষমতা বাড়াবে। সাথে সাথে শিকড়ের সক্ষমতা বাড়াবে এবং গাছের যেসমস্ত উপাদান দরকার হয় তা সরবরাহ করবে। দেখা যাবে যে এই অর্গানিক ফার্টিলাইজার ব্যবহার করে মাটির উর্বরতা বাড়বে। অন্য সার প্রয়োগের পর এই সারগুলো গাছ নিতে পারবে। তাতে ফসলের ফলন অনেক বেড়ে যাবে।

ন্যানো টেকনোলজির প্রয়োগ বিশ্বব্যাপী শিল্পায়নের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সেক্ষেত্রে বিশ্বের উন্নত দেশের মতো ন্যানো ফার্টিলাইজার তৈরী করে তা দেশের কৃষকদের হাতে তুলে দিতে পারলে সার্বিক উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে এক যুগান্তকারি অগ্রগতি সাধিত হবে।