নিজস্ব প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: পোল্ট্রি ফিডের দাম বৃদ্ধি এবং ডিমের দাম কমে যাওয়ায় ব্যবসায় লোকসানের মুখে খামারিরা। বেড়েছে ডিমের উৎপাদন খরচ। খামারিরা বলছেন, ফিডের মূল্যবৃদ্ধিতে ধংসের মুখে পোল্ট্রি খাত।

খামারিরা বলছেন, প্রথম দিকে ব্যবসায় লাভের মুখ দেখলেও ২০১৬ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে খাবার, ভ্যাকসিন ও বাচ্চার মূল্য বৃদ্ধি এবং ডিমের দাম কমে যাওয়ায় লেয়ার মুরগিতে লাভ কমতে থাকে। এর মধ্যে করোনাভাইরাসের ধাক্কায় বিক্রিবাট্টা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিরাট ক্ষতি হয় তাদের।

সেই সঙ্গে গরমের সময় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না থাকায় কলেরা রোগে লেয়ার মুরগির মড়ক শুরু হয়। দিনের পর দিন লোকসানে থাকা দেশের বিভিন্ন জেলার অনেক খামারি ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। তবে বেশির ভাগ খামারি ঋণ করে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে বিপাকে পড়েছেন। তারা না পারছেন খামার বন্ধ করতে, না পারছেন চালাতে।

এই শিল্প রক্ষায় সরকারকে বাচ্চা, খাবার ও ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণের দাবি জানিয়েছে খামারিরা। কুড়িগ্রাম জেলা পোল্ট্রি খামার মালিক সমিতির সভাপতি লিয়াকত আলী লিটু বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি দেখিয়ে দেশীয় কোম্পানি দাম বাড়িয়েছে। ফলে আমরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।”

বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। মুরগির খারাবের ‘ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি’ বর্তমানে প্রান্তিক খামারিদের লোকসানের প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন ফুলবাড়ী উপজেলার ভেটেরিনারি সার্জন মাহমুদুল হাসান। তিনি বলেন,“দেশের বাইরে থেকে আনা কাঁচামালগুলোর মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। আরেকটি কারণ হল খামারিদের লেয়ার মুরগির বাচ্চা কিনতে হচ্ছে উচ্চ মূল্যে। দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে খামারিদের লাভটা বেশি নিশ্চিত করা যাবে।”

জানা গেছে, উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামে ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় দুই শতাধিক লেয়ার খামারি ব্যক্তিগত উদ্যোগে পোলট্রি ব্যবসা শুরু করে। জেলায় সবচেয়ে বেশি লেয়ার খামার রয়েছে ফুলবাড়ী উপজেলায়; এখানে প্রায় ৭৪টি খামার রয়েছে।

ফুলবাড়ী উপজেলার কুটি গ্রামের ধরলা পোল্ট্রি ফার্মের মালিক ডলার জানান, ২০০৫ সালে পাঁচ লাখ টাকা ব্যয় করে কাজী ফার্ম থেকে এক হাজার ব্রাউন জাতের লেয়ারের বাচ্চা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। ২০১৫-১৬ সাল পর্যন্ত লাভের মুখ দেখায় খামার বড় করার পরিকল্পনা করেন তিনি।

কিন্তু বর্তমানে সবকিছুর মূল্য বৃদ্ধির কারণে ২০ হাজার লেয়ার মুরগি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন এ খামারি। তিনি বলেন, “বিদেশে কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধির কথা বলে কোম্পানিগুলো ১৬০০ টাকা সিডের বস্তা এখন ২ হাজার ৩০০টাকায় বিক্রি করছে। ফলে প্রতি বস্থায় অধিক ৭শ’ টাকা বাড়তি মূল্য দিতে হচ্ছে। ৩০০ টাকার ভ্যাকসিনের দাম হয়েছে ৫৫০টাকা। এছাড়া ২৫ টাকার লেয়ারের বাচ্চা ফরিয়ারা সিজনে ৬০ টাকা পর্যন্ত দামে সাপ্লাই দিচ্ছে। ফলে আমরা মাঠে মারা যাচ্ছি।”

ডলার জানান, তার খামারে প্রতিদিন ২০ হাজার কেজি সিড লাগে। কিন্তু সবকিছুতে মূল্য বৃদ্ধির কারণে মাসে তার ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা লোকসান গুণতে হচ্ছে। তার খামারের ব্যবসায় এক কোটি টাকা ‍বিনিয়োগ করা আছে। ফলে ব্যবসাও ছাড়তে পারছেন না।

ওই এলাকার পোল্ট্রি ফার্মের মালিক মমিনুল ইসলাম বলেন, “আমার ফার্মে ৬ হাজার লেয়ার জাতের মুরগি আছে। আমি ৬০/৭০ লাখ টাকা লগ্নি করে অবকাঠামো তৈরি করেছি। এনজিও থেকে ঋণ করেছি ৬ লাখ টাকা। মাসে কিস্তি দিতে হয় ৬০ হাজার টাকা। মাসে ডিম বিক্রি হয় ৯০ হাজার হাজার টাকার মতো। সবকিছু দিয়ে থুয়ে আমার ৩০ হাজার টাকা ঘাটতি থাকে। এই ব্যবসা আমাদের গলার কাটা হয়ে গেছে।”

একই অভিযোগ করলেন ওই এলাকার দোয়া পোল্ট্রি ফার্মের মালিক সিমু, আপন পোলট্রি ফার্মের মালিক ফজলু। তারা জানান, প্রতিবেশী এমদাদুল লোকসানে পড়ে খামার ব্যবসা গুটিয়েছেন।

ব্যবসায়ীরা জানান, একটি লেয়ার মুরগির ১২০দিন পর ডিম আসা শুরু হয়। ১৫০ দিনে ফুল প্রডাকশন শুরু হয়; এ সময় গড়ে ৯৮ ভাগ মুরগি দেয়। সাত-আট মাস পর্যন্ত ফুল প্রডাকশন থাকে। এরপর কমে গিয়ে ৯০ থেকে ৮৫ ভাগে নেমে যায়। ১৭/১৮ মাস পর ৭৫ ভাগে প্রডাকশন নেমে গেলে ১৬০ থেকে ২০০ টাকা কেজিতে মুরগিগুলো মার্কেটে বিক্রি করা হয়। শুরুতে ব্যবসায়ীরা ১ হাজার মুরগি দিয়ে সাত-আট লাখ টাকা আয় করে।

বেশি আয় হওয়ায় ব্যবসায়ীরা অধিক লাভের আশায় খামারে বেশি মুরগি উঠিয়ে এখন বিপদে পড়েছেন। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের সময়ে ডিম বিক্রি না হওয়ায় লাখ লাখ টাকা লোকসান গুণেছেন ব্যবসায়ীরা। তারপর থেকে তারা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না।

খামারিরা বলছেন, প্রান্তিক পর্যায় ও বড় খামারিরা ডিম উৎপাদন করেও দাম পাচ্ছেন না। মুরগি পালনে ব্যায় বেড়েছে বহুগুণ। ডিম ও মাংসের দাম কমলেও বাড়ছে বাচ্চা ও ওষুধের দাম। ডিমপাড়া মুরগির এক দিনের বাচ্চার দাম বাড়িয়েছেন হ্যাচারি মালিকরা। তাঁরা সিন্ডিকেট সিন্ডিকেট করে বাচ্চার দাম বাড়িয়েছেন।

তারা বলছেন, বাচ্চা উৎপাদনকারী হ্যাচারি মালিকদের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। আর তা না পারলে খামারির এই লোকসান ঠেকানো সম্ভব নয়। বাচ্চার দাম হাতের নাগালে থাকলে উৎপাদন খরচ কমে যায় এবং লাভবান হওয়া যায়। বাচ্চার দাম ২০-৩০ টাকা থেকে ৫০ টাকার এর বেশি হয়ে যায় তখন আর লাভের মুখ দেখতে পান না খামারিরা।

ডিম উৎপাদনকারী খামারিরা বলছেন, আমিষের চাহিদা পূরণে ডিমের ভূমিকা অন্যতম। এই সম্ভাবনাময় খাত বর্তমানে নানা সংকটে ঘুরপাক খাচ্ছে। উৎপাদন খরচ তুলতে খাচ্ছেন হিমসিম। এসব মুরগি ১২০ দিন থেকে ডিম দেওয়া শুরু করে কিন্তু তার আগে মুরগি পালনের যে খরচ পড়ছে তা অত্যাধিক। এরপর ডিম উৎপাদনের পর পর্যাপ্ত দাম মিলছে না। প্রতিপিস ডিম উৎপাদনে খরচ ৬.৫০ টাকা হলেও তা বিক্রি হচ্ছে ৫.৫০ টাকায়। ফলে লোকসান গুণছেন খামারিরা।

মুরগির খাবারের দাম বেড়েই চলে লাগামহীন, বাড়ছে প্রতি ইউনিট বিদ্যুত খরচ, রোগ-বালাইয়ে মুরগি মরে সয়লাব হলেও মিলছে না কোন সরকারি ঋণ। করোনাকালীন ৪ শতাংশ হারে ঋণের ঘোষণা দিলে সরকারি এ ঋণ অধিকাংশ খামারি পান নি। সবমিলিয়ে নতুন করে কেউ আর এই ব্যবসায় পা বাড়াচ্ছেন না বরং বড় মূলধনের ব্যবসায়ীরা মুরগি চাষ বাদ দিয়ে অন্যদিকে ঝুঁকছেন।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. আব্দুল হাই সরকার বলেন, করোনাভাইরাস-পরবর্তীকালে ফিডের মূল্য কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিষয়টি জেলা সমন্বয় কমিটির সভায় উত্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে ভুট্টা সংগ্রহ করে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ফিড তৈরির পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। খামারিরা নিজেরা খাবার তৈরির উদ্যোগ নিলে লোকসান কমে যাবে বলে মনে করে তিনি।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ