নিজস্ব প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: পর্যটন মৌসুমে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে চলা বাইকের চাপায় প্রতিদিন অন্তত ৬ হাজার কাকড়ার মৃত্যু হচ্ছে বলে জানিয়েছে সমুদ্র পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন মেরিন জার্নালিস্টস নেটওয়ার্ক।

এছাড়া অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের প্রভাবে প্লাস্টিক দূষণ ও পশুপাখি বিলীন হয়ে সৈকতটি তার সম্ভাবনা হারিয়ে ফেলছে বলে উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। আজ বৃহস্পতিবার (২৭ মে ২০২১) করোনা পরিস্থিতির বিবেচনায় অনলাইনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য প্রকাশ করে সংগঠনটি।

দুপুরে সংগঠনের সভাপতি মাহমুদ সোহেলের সভাপতিত্বে ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মুহাম্মদ আনোয়ারুল হকের সঞ্চালনায় প্রতিবেদনটি পাঠ করেন সংগঠনের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য কেফায়েত শাকিল।

প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়, পর্যটন মৌসুমে কুয়াকাটায় প্রতি সপ্তাহে অন্তত ৫০-৬০ হাজার পর্যটক ভ্রমণ করে। কিন্তু এদের মেনেজমেন্টের জন্য কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। যার কারণে প্রতিদিন এই সৈকতে পর্যটকদের ফেলা প্লাস্টিকের ৯০ শতাংশই চলে যাচ্ছে সমুদ্রে। এর কারণে সমুদ্রের প্রতিবেশ ব্যবস্থা ধংস হচ্ছে। এছাড়া, জীববৈচিত্র্যে সবচেয়ে বড় বিরূপ প্রভাব পড়ছে সৈকতে পর্যটক বহন করে চলা মোটরবাইকের কারণে।

এতে পরিসংখ্যান দেখিয়ে তুলে ধরা হয়, পর্যটন মৌসুমে কুয়াকাটায় প্রতিদিন অন্তত ২০০টি মোটরসাইকেল চলে। যার প্রতিটির দৈনিক আয় ১৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। এসব মোটরসাইকেল দিনে অন্তত ২ থেকে ৩ বার সৈকত হয়ে কাঁকড়ার দ্বীপে যায়। পর্যবেক্ষনে দেখা যায় প্রতিবার একটি মোটরসাইকেলের চাপায় অন্তত ১০টি করে কাঁকড়ার মৃত্যু হয়। যা মোট হিসেব করলে অন্তত ৬ হাজার কাঁকড়ার মৃত্যু হয়।

এছাড়া কুয়াকাটায় বন ধংস, বেদখল, ভাঙনে বসতি হারানো ও মৎস্য সম্পদের হুমকির তথ্যও উঠে এসেছে এই প্রতিবেদনে।
কুয়াকাটায় অনিয়ন্ত্রিত পর্যাটন বন্ধ এবং পরিবেশ বান্ধব পরর্যযটনের জন্য কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে। তাহলো- সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধে সৈকত এলাকায় প্লাস্টিক মোড়কজাত পণ্য নিয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে গড়ে ওঠা টঙ দোকান উচ্ছেদ করে সৈকতকে পরিচ্ছন্ন রাখা,আবর্জনা পরিষ্কার, বিচে ফুটবল খেলা নিয়ন্ত্রণ ও পর্যটকদের সচেতন করতে একটি বিশেষ বাহিনী নিয়োগ করা,পুরো সমুদ্র সৈকত এলাকায় মোটরবাইক চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সচেতনতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ, সৈকত এলাকায় উচ্চস্বরে বাদ্য বাজানো বন্ধ করা, লাল কাঁকড়া সংরক্ষণে পর্যটক নিয়ন্ত্রণসহ দ্রæত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, কুয়াকাটাকে দ্রæত ইসিএ এলাকা ঘোষণা করা, দ্রুত ফোরশোর, ফ্লাড ফ্লো জেন চিহ্নিত করণ, অবৈধ দখল উচ্ছেদ, ফ্ল্যাডফ্লো জোন/ফোরশোর এরিয়া চিন্হিত করে পরিবেশ আইন বাস্তবায়ন করা।

এ সময় বাংলাদেশ ট্যুরিজম ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুখলেসুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে যে পর্যউটন হচ্ছে তা মূলত অনাচার। এ কারনেই আমাদের পর্যেটনকে ব্রান্ডিং করা যায় না। আমাদের দেশে পর্যেটনের যে সংকট তৈরি হয়েছে তা মূলত বিভিন্ন সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা এবং তাদের দায়িত্বের উদাসীনতার কারনেই। পরিবেশ সম্মত পর্যটনের জন্য রাজনৈতিক কমিটেমেন্ট আদায় করা না হলে কোনো ফল আসবে না।

অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, কুয়াকাটায় মানুষ পরিবেশের যে বিপর্যায়ের সম্মুখীন হচ্ছে তা প্রাকৃতিক নয়; মূলত ঐ এলাকার মানুষ এবং ওখানে যে সব পর্যটক ঘুরতে যায় তাদেরই সৃষ্টি। মানুষ যে নান্দনিকতা দেখার জন্য কুয়াকাটা যাবে তা যদি সেখানে না-ই থাকে মানুষ সেখানে যাবে কেন? তাই এই প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো আমলে না নিলে কুয়াকাটা ব্যাপক পরিবেশ বিপরর্যতয় হবে অচিরেই।

ডা নাছির উদ্দীন বলেন, কোভিড এর সময়ে আমরা অক্সিজেন স্বল্পতায় ভুগছি। ৭০ শতাংশের বেশি আসে মেরিন ইকোসিস্টেম থেকে। তাই সাগর ও কোস্টাল এরিয়ার ইকোসিস্টেমকে ধরে রাখতে হবে আমাদের বাঁচার স্বার্থেই।

বাপ্পী সরদার বলেন, এনভায়রনমেন্টাল পুলিশ বিভাগ চালু করার দাবি জানিয়ে বলেন, শুধু ট্যুরিস্ট পুলিশ লোকাললি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে পুলিশের আলাদা বিভাগ চালু করা দরকার।

এসএম আতিকুর রহমান বলেন, ফোরশোর এরিয়া নির্ধারণ করে পরিবেশ আইন প্রয়োগ না করলে বায়োডাইভার্সিটি ইকোসিসটেম ভেঙ্গে যাবে। অদুর ভবিষ্যতে এর প্রভাব সোয়াচ অব নো বটম পর্যন্ত পৌছবে। সাগর পাড়ের পরিবেশ সংরক্ষণ না করে বেড়ি বাঁধ দিলে কোনো কাজে আসেবে না। নানা পরিবেশ বিপর্যয় এর মাধ্যমে সাগর পাড়ের মানুষ বিপর্যিস্ত হবে।

ড. বিশ্বজিৎ নাথ বলেন, সমূদ্রে যে ঘুর্নিঝড় হয় এর পেছনে মুলে রয়েছে তাপমাত্রা বৃদ্ধি। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী আমাদের দূষণ। সাগরে প্লাস্টিকসহ নানা বর্জ্য ফেলা, সাগর পাড়ের ম্যানগ্রোভ নষ্ট করা, কাকড়াসহ নানা প্রাণী ধ্বংস করে ইকোসিসটেমকে ভেঙ্গে ফেললে এ রকম বড় বড় ঝড়কে আমরাই ডেকে আনি। পর্যটনের নামে পরিবেশের ভারসম্য নষ্ট করে বিশ্বের অন্যান্য দেশকে দায়ী করলে লাভ হবে না। স্যাটেলাইট ইমেজে সবই পরিস্কার দেখা যায় যে, সাগর দূষণে আমরা কতটুকু দায়ী।
তিনি আরো বলেন, নিদেন পক্ষে চিনে যেভাবে ওশান ট্যুরিজম হয় সেটাও যদি আমরা ফলো করি তাহলে আমরা ক্ষতি থেকে অনেকটা বাঁচতে পারবো।

প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন, আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংস্থা- আইইউসিএন’র কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ রাকিবুল আমিন, ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (WCS) এর কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. জাহাঙ্গীর আলম, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মজুমদার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ নাথ, সেভ আওয়ার সি’র পরিচালক এসএম আতিকুর রহমান, চাইনিজ একাডেমি অব সাইন্স-এর বন্যপ্রাণী গবেষক ডা নাছির উদ্দীন, সবুজ আন্দোলনের চেয়ারম্যান বাপ্পী সরদার, বাংলাদেশ ট্যুরিজম ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুখলেসুর রহমান, সেঞ্চুরি রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমজিআর নাসির উদ্দিন মজুমদার ও কুয়াকাটা প্রেসক্লাব সভাপতি নসির উদ্দিন বিপ্লব প্রমুখ।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ