আবু খালিদ, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: হেক্টরে ১০ টন বা বিঘাতে সোয়া ৩৩ মন পর্যন্ত ফলন। জাতটি দিয়ে বীজ উৎপাদন ও বিপনন করতে পারবেন কৃষক। হাইব্রীড বীজ ও প্যারেন্ট লাইন বীজ আমদানিতে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়ের পাশাপাশি কৃষকের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে।

এমনই নানা গুণ সমৃদ্ধ এক উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের উদ্ভাবন ও মাঠ পর্যায়ে সফলতা মিলেছে। জাতটির নাম ব্রি হাইব্রিড ধান৫। বাংলাদেশ ধান গবেষনা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) উদ্ভাবিত জাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফলন দেবার রেকর্ড করেছে নতুন উদ্ভাবিত ব্রি হাইব্রীড ধান৫।

২০১৬ সালে অবমুক্ত হবার পর কয়েকটি বেসরকারী কোম্পানি, কৃষক, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) এবং ব্রির গবেষনা মাঠে এই সুফল পাওয়া গেছে।

ব্রি সূত্র জানায়, বোরো মৌসুমে উচ্চ ফলনশীল (হাইব্রীড) জাতগুলোর মধ্যে ব্রি হাইব্রীড-১,২,৩ এবং ৫ জাতগুলো চাষাবাদ করা হয়। এছাড়া ব্রি হাইব্রীড৪ ও ৬ জাত দুটি আমনে আবাদ করা হয়। ব্রি’র ৯১ টি জাতের মধ্যে মাত্র কয়েকটি জাত সর্বোচ্চ ৮ থেকে ৯ টন পর্যন্ত ফলন দিলেও ব্রি হাইব্রীড ধান৫ এখনও পর্যন্ত ১০ টন ফলন দিচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতটি যেকোন কৃষক ও নিবন্ধিত বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বীজ উৎপাদন করতে পারবে। সেক্ষেত্রে ব্রির বিজ্ঞানীরা বিনামূলে বীজ ও কারিগরি সহায়তা দিবে। এমনকি কোন কৃষক যদি উদ্ভাবিত বীজ বিপনন করতে চান, তাহলে বিপনন সুবিধাও করে দিবে ব্রি।

জাতটির দানায় অ্যামাইলোজের পরিমান শতকরা ২৩-২৪ ভাগ। দানার আকৃতি সরু ও লম্বা এজন্য ভাত ঝরঝরে। দানায় প্রোটিনের পরিমান বেশি। তাছাড়া জাতটির গাছের উচ্চতা ১০৫-১১০ সেন্টিমিটার।

এ বিষয়ে জাতটির উদ্ভাবক দলের অন্যতম সদস্য ও ব্রির হাইব্রীড রাইস ডিভিশনের প্রধান ড. মো. জামিল হাসান এগ্রিকেয়ার২৪.কম কে বলেন, জাতটির ১৪৩ থেকে ১৪৫ দিন জীবনকাল হলে কিছুটা ঘাত সহিষ্ণু। অর্থাৎ বেশি মাত্রায় শীত ও খরা হলেও স্বাভাবিক ফলন ধরে রাখতে পারবে।

তাছাড়া কান্ড শক্ত বিধায় সামান্য ঝড়েও ঢলে পড়ার সম্ভাবনা থাকে না। স্বাভাবিক অবস্থায় গাছ প্রতি গুচ্ছির সংখ্যা ১২-১৫টি থাকে বিধায় উচ্চ ফলন দিতে পারে। যেকোন জাতের চেয়ে এখনও পর্যন্ত এটিই সর্বোচ্চ ফলন দিতে সক্ষম হয়েছে। সঠিক পরিচর্চা ও নিয়মনীতি পরিপালন করলে ১০ টনের ল্যান্ডমার্ক দীর্ঘস্থায়ী করা সম্ভব হবে।

দেশে বীজ উৎপাদন করা সম্ভব হলে আমদানি ব্যয় দেড়শ কোটি টাকার বা আমদানি ব্যয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করা সম্ভব হবে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। তারা জানায়, চলতি অর্থ বছরে এখনও পর্যন্ত দেড়শ কোটি টাকার ৩৭ লাখ ১৭ হাজার ৮৩০ কেজি হাইব্রীড বীজ, এ লাইন ও আর লাইন প্যারেন্ট বীজ আমদানি করতে হয়েছে।

প্রতি বছর গড়ে দুইশ কোটি টাকার বীজ ও প্যারেন্ট লাইন বীজ আমদানিতে ব্যয় করা হচ্ছে। যার মধ্যে বীজের প্যাটেন্টের জন্য প্রায় ৬০ কোটি টাকা দিতে হচ্ছে।

বাংলাদেশে বোরো মৌসুমে হাইব্রিড ধান চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান ব্রি সাবেক মহাপরিচালক ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস। তিনি বলেন, উপযুক্ত জাত, সঠিক সময়ে বীজ বপন, চারা রোপণ এবং  উন্নত আন্ত পরিচর্যার মাধ্যমে এই মৌসুমে হাইব্রিড ধান চাষ করে দেশের খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।

তাছাড়া প্রতি বছর প্যারেন্ট লাইন বীজসহ বিভিন্ন বীজ আমদানিতে বড় অঙ্কের টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। এ জাতটি সেটি রোধ করতে সক্ষম হবে। যেকোন ধানের তুলনায় ব্রি হাইব্রীড ধান৫ জাতটি সর্বোচ্চ ফলন দিবে। তাছাড়া এ জাতের ধানের চাল সরু ও রান্না ভাত কিছুটা ঝরঝরা হবার কারনে মানুষের কাছেও জনপ্রিয় হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

নতুন এই জাতের ধানটি আবাদ ও পরিচর্চায় বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করেন গবেষকরা।

দেশের মোট ধান উৎপাদনের শতকরা প্রায় ৯১ ভাগই ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল ধানের জাত থেকে আসছে বলে জানান ব্রির মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে ব্রি এ পর্যন্ত ৯১ টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে ইনব্রীড ৮৫ টি এবং হাইব্রিড ৬টি।

এসব জাতগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ঘাত সহিষ্ণু বা লবনাক্ততা, খরা, জলমগ্নতা সহিষ্ণু জাত রয়েছে। এছাড়া উচ্চ প্রোটির ও জিংক সমৃদ্ধ এবং চাল রফতানি উপযোগি জাত রয়েছে। পরিবর্তনশীল জলবায়ুর জন্য ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলো মাঠ পর্যায়ে আবাদ করা হচ্ছে। দেশের প্রায় ৮০ ভাগ জমিতে ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল ধানের চাষাবাদ করা হয়।

এ ঊর্ধতন কর্মকর্তা জানান, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশে ধানের বিভিন্ন জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে চালের চাহিদা পূরনে কাজ করছে ব্রি। এরই ধারাবাহিকতায় হাইব্রীড জাতের ধান উদ্ভাবন ও কৃষকের মাঝে বিতরন করছে। ব্রি হাইব্রীড ধান৫ জাতটি কৃষকরাই যাতে উৎপাদন ও বিপনন করতে পারে সে জন্য কার্যক্রম গ্রহন করা হচ্ছে। এটির নানান সুবিধা বিবেচনায় কৃষক পর্যায়ে পৌছানো হচ্ছে, যার মাধ্যমে কৃষকরা উদ্যোক্তাতে পরিণত হতে পারবেন।

ব্রি৫ চাষাবাদ ব্যবস্থাপনা: বীজ বপন কাল অক্টোবর থেকে জানুয়ারী মাস। তবে ১৫ ই নভেম্বর থেকে ১৫ ই ডিসেম্বর উৎকৃষ্ঠ সময়। প্রতি হেক্টর (৭.৫ বিঘা) জমিতে মাত্র ১৫ কেজি বীজ প্রয়োজন। সবসময় রোদ্র থাকে এমন জায়গাতে বীজতলা তৈরী করতে হবে।

বীজতলার মাটির উর্বরতার উপর নির্ভর করে পচা গোবর ও রাসায়নিক সার দিতে হবে। চারা রোপনের তিন সপ্তাহ পর ৫-৬ দিনের জন্য সেচ বন্ধ রেখে জমি একটু হালকা শুকানো যেতে পারে। হাইব্রীডসহ ধানের বিভিন্ন রোগের জন্য অতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহার দায়ি।

এজন্য শেষ মাত্রার ইউরিয়া প্রয়োগে সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে। ফুল আসার ৩০-৩৫ দিনপর ধান হলুদ হলে অর্থাৎ শীষের অগ্রভাগের শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত হলেই দ্রুত ফসল কর্তন করে ফসল ঘরে উঠাতে হবে। তবে ব্রি হাইব্রিড ধান৫ বীজ থেকে উৎপাদিত ধান কোনমতেই বীজ হিসাবে রাখা যাবে না কিংবা পরবর্তীতে বীজ হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না। বীজ ও ধান উৎপাদনে আলাদা আলাদাভাবে করতে হবে। ঘাত সহিষ্ণু বিধায় জাতটি আবাদে সার ও অনান্য উপকরের ব্যবহার কম করতে হয়।