মেহেদী হাসান, রাজশাহী: ভারতে সয়াবিন রপ্তানিতে দেশে বাড়ছে ডিম-মাংসের দাম। দেশটিতে প্রাণিখাদ্য তৈরির কাঁচামাল সয়াবিনের ঘাটতি দেখা দেওয়ায় বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হচ্ছে। এতে বাংলাদেশে আগে থেকেই ঘাটতি থাকা সয়াবিনে বেশ সংকট তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে খাদ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে দেশের পোলট্রি ও গবাদি পশুর খাদ্য প্রস্তুতকারী কারখানাগুলো। ফলে রাতারাতি বাড়ছে ডিম-মাংসের দাম। গত ২ সপ্তাহে ডিম ও মাংসের দাম বেড়েছে তিন দফায়।

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) সভাপতি মসিউর রহমান জানান, সয়াবিনের রপ্তানি সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। দ্রুত এই সিদ্ধান্ত বাতিল না করলে ডিম, দুধ, মাছ, মাংসের দাম বেড়ে যাবে। আমরা ফিডের দাম ততটুকুই বাড়াব যতটুকু না বাড়ালে হয় না। ইতিমধ্যে ৩০ শতাংশের ওপরে ফিড তৈরির পণ্যের দাম বেড়েছে। নিজেদের সংকটে রেখে ভারতসহ যে কোনো দেশে সয়াবিন রপ্তানি বন্ধ না করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। ডিম-মাংসের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যাবে। ফলে জনস্বাস্থ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

আরোও পড়ুন:  ভারতে সয়াবিন রপ্তানির প্রভাবে ফের বাড়ছে খাদ্যের দাম

রাজশাহী পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক জানান, সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের কারনেই দেশের খামারিরা মারা পড়বে। আজ খাদ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা। কেজিপ্রতি ২ টাকা বৃদ্ধি মানে খামারিরা ধ্বংশ। ৯০ শতাংশ খামার বন্ধ হয়ে যাবে। ফিড মিলের মালিকরা আরোও ফুলে ফেঁপে উঠবে। ডিমের দাম ১২-১৩ টাকা হয়ে যেতে পারে। বর্তমানে ৯ টাকা পিস ডিম, ব্রয়লার মুরগি ১৫০ টাকা লেগেছে। ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সেইসাথে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়বে।

জানা গেছে, ভারতের উদ্ভুত সংকট মেটাতে ব্রাজিলসহ দক্ষিণ আমেরিকা ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন আমদানি করলে তা দেশটিতে পৌঁছাতে সময় লাগবে অন্তত ৬০ দিন। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের পোলট্রি মুরগি ও গবাদি পশুর খাবার তৈরির ঘাটতি মেটাতে বাংলাদেশ থেকে সয়াবিন মিল বা সয়াবিনের খইল আমদানির দাবি জানায় দেশটির ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সয়াবিন মিল রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। রপ্তানির কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় বাজারে সয়াবিনের দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ টাকা। গতকাল রোববার খাদ্যের দাম বস্তাপ্রতি বাড়ে ১০০ টাকা। বৃহৎ সিন্ডিকেট সরকারের নাকের ডগায় বসে এসব করছে বলে অভিযোগ খামারিদের।

কথা হয় রাজশাহীর কয়েকটি পোল্ট্রি, ডেইরি খামারির সাথে। এসব উদ্যোক্তারা বলছেন, ডিম, মাছ, মুরগি উৎপাদনে মোট খরচের প্রায় ৭০-৭৫ শতাংশ খরচই হয় ফিড কেনা বাবদ। ফিডের দাম বৃদ্ধি পেলে খামারিদের উৎপাদন খরচ বাড়ে। আবার খরচের বিপরীতে পণ্যের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় বড় অংকের লোকসানের মুখে পড়তে হয় উদ্যেক্তাদের। দফায় দফায় খাদ্যের দাম বৃদ্ধিতে লোকসানের মুখে আছে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প। নিজের দেশে সয়াবিন ঘাটতি থাকা স্বত্ত্বেও ভারতে সয়াবিন রপ্তানির কোন মানে হয়না। অপরদিকে বাংলাদেশ সরকার মুরগি, মাছ ও পশু খাদ্যের জন্য বিদেশ থেকে আনা সয়াবিনের ওপর কোনো শুল্ক রাখেনি। বিনা শুল্কে বিদেশ থেকে সয়াবিন এনে তা ফের ভারতে বিক্রি করা হলে বড় আকারে শুল্কও ফাঁকি দেওয়া হবে।

রাজশাহী বিভাগীয় ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো: রবিউল করিম বলেন, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত খামারিরা এখোনো দাঁড়াতে পারেনি। অন্যদিকে দফায় দফায় কোন কারন ছাড়াই খাদ্যের দাম বাড়নো হচ্ছে। পাবনা, সিরাজগঞ্জ এলাকায় ২৫-৩০ শতাংশ খামার বন্ধ হয়ে গেছে। অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে খাদ্যের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ করা হয়েছে , মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। খাদ্যের দাম বাড়ছে, দুধের দাম ৫ বছর আগের দামেই রয়ে গেছে।

সংশ্লিষ্ট খাতের তথ্য অনুযায়ী দাম বাড়তে থাকলে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম আর গরিবের নাগালে থাকবে না। মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ও ফিড মিলিয়ে এই খাতে বছরে ২ লাখ কোটি টাকার বাজার রয়েছে। এই খাতের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ এখনো দেশীয় কোম্পানির হাতে রয়েছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানের দাপট থাকায় মাত্র সাত থেকে আট টাকায় একটি ডিম পাওয়া যেত দেশে। আর ১৪০ টাকায় মিলত এক কেজি পোলট্রি মুরগির মাংস। কিন্তু গত কয়েক দিনে ডিমের দাম বেড়ে পিসপ্রতি ১১টাকা এবং পোলট্রি মুরগির মাংস কেজিপ্রতি ১৫০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। স্বল্প আয়ের মানুষের প্রোটিন ও আমিষের সব থেকে বড় জোগান এই দুটি খাদ্য থেকেই আসে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইমরান হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সয়াবিনের খইল ভারতে রপ্তানি হবে এমন খবরেই কেজিপ্রতি ১০ টাকা দাম বেড়ে গেছে। আর এখন রপ্তানি শুরু হওয়ায় দাম আরও বাড়বে। তাতে বাংলাদেশে ফিড উৎপাদনে খরচ বাড়বে। কেজিপ্রতি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাড়বে গরুর মাংসের দাম। মানুষকে বাড়তি দাম দিয়ে কিনতে হবে গরুর মাংস। সেইসঙ্গে বাড়বে পোলট্রি মুরগি, ডিম, দুধ ও মাছের দাম। আমিষের ঘাটতি মেটানো দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।’

হিসাব করে দেখা গেছে, এক কেজি সয়াবিনে ১৮ শতাংশ তেল, ৪ শতাংশ ওয়েস্টেজ (বর্জ্য) ও ৭৮ শতাংশ খইল হয়। ব্যবসায়ীরা বিনা শুল্কে বিদেশ থেকে সয়াবিন আনার সুযোগ পান। খইল বিক্রি হয় দেশের ফিড মিলগুলোতে। গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে কাঁচামালের দাম ৩৪ দশমিক ২২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফিড বানাতে অন্তত ১৬টি কাঁচামালের দরকার পড়ে। এর মধ্যে প্রতি কেজি মাছের (রাবিশ) গুঁড়ার দাম ৩২ টাকা, খুদ চালে ১২.১১ টাকা, ভুট্টায় ১২ টাকা, সয়াবিনের খইলে ১৬.২৫ টাকা ও সয়াবিন তেলের দাম লিটারে বেড়েছে ৫৫.৯০ পয়সা।

উল্লেখ্য, দেশে ৩০০ ফিডমিল থাকলেও চালু রয়েছে মাত্র ১০০টি। এরমধ্যে দেশীয় ফিডমিলগুলোর বড়রকম লোকসান টানার মতো ক্ষমতা নেই। যদি ফিড উৎপাদনে খরচ বাড়ে তাহলে অনেক ফিডমিল বন্ধ হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে বিদেশি বহুজাতিক ফিডমিলগুলো টিকে থাকতে পারবে লোকসান দিয়েও। অথচ এ খাতে এখনো দেশীয় ফিডমিলগুলো বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে আছে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ