ফসল ডেস্ক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার ব্যবহারে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। জমিতে কতটুকু পরিমাণ দিতে হবে এ বিষয়ে জানিয়েছেন রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা মতিয়র রহমান।

কেচোঁ মানুষের একটি অন্যতম উপকারী প্রাকৃতিক ক্ষুদ্র প্রাণী। বিশেষ প্রজাতির কেঁচো ব্যবহার করে কোন উদ্ভিদ বা প্রাণীর বর্জ্য ও দেহাবশেষকে প্রক্রিয়াজাতকরণের পর যে সার পাওয়া যায় তাই কেঁচো সার বা ভার্মি কম্পোস্ট নামে পরিচিত। জৈব পদার্থ খাওয়ার পর কেঁচো যে মল ত্যাগ করে তাই কেঁচো কম্পোস্ট বা ভার্মি কম্পোস্ট নামে পরিচিত।

কেঁচো কম্পোস্টের উপাদান:
কেঁচো কম্পোস্টে অন্যান্য কম্পোস্টের চেয়ে প্রায় ৭-১০ ভাগ পুষ্টিমান বেশি থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে একটি আদর্শ ভার্মিকম্পোস্টে ১.৫৭% নাইট্রোজেন, ১.২৬% ফসফরাস, ২.৬০% পটাশ, ০.৭৪% সালফার, ০.৬৬% ম্যাগনেশিয়াম, ০.০৬% বোরণ, ১৮% জৈব কার্বন, ১৫-২৫% পানি ও সামান্য পরিমাণ হরমোন রয়েছে।

প্রতি বিঘা জমিতে সার ব্যবহারে সতর্কতা:

দেশের সর্বোৎকৃষ্ট কেঁচো সার উৎপাদন রাজশাহীতে

ফসলের বুক চিরে অঁজপাড়াগায়ের দিকে ছুটে চলেছে আঁকাবাঁকা রাস্তা। রাস্তার শেষে হটাৎ দেখা মিলবে প্রায় ৫০ একর জমিতে বিশাল কর্মযজ্ঞ। পরিত্যক্ত উঁচু-নিচু লালমাটিতে ডজন খানেক প্রজেক্টের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার উৎপাদন প্রজেক্ট।

বলছি, রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার বাবুডাইং মহিষাথন এলাকার কথা। এখানেই জৈব পদ্ধতিতে দেশের সর্বোৎকৃষ্ট মানের কেঁচো সার উৎপাদন হয় বলে দাবি “এগ্রোগেট এগ্রো পার্ক” এর পরিচালক মো: ইউসুফ আলীর। উপজেলা কৃষি বিভাগ বলছে, জৈব সার উৎপাদনের ক্ষেত্রে মানের পরিবর্তন হয়।

পেশায় ইউসুফ আলী একজন পল্লিচিকিৎসক ও পেস্টিসাইড ডিলার। পাশাপাশি দীর্ঘদিন কাজ করছেন পরিবেশ নিয়ে। ২০১৫ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বনায়ন ক্যাটারিতে পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী পুরস্কার। এছাড়াও স্থানীয় ও বিভাগীয় পর্যায়ে পরিবেশ রক্ষায় ভ’মিকা পালনে পুরস্কারের ঝুলিতে জমা হয়েছে বেশ কয়েকটি।

এমনই উদ্যোমী মানুষ ৫ বছর আগে ২০১৬ সালের দিকে ভাবতে থাকেন- দৈনন্দিন জীবনে আমরা যেসব খাবার খাচ্ছি তার বেশিরভাগেই রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার হচ্ছে। রাসায়নিকের প্রভাবে দূরারোগ্য ব্যাধীতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। নষ্ট হচ্ছে অর্থ, বাড়ছে ভোগান্তি। এসব সমস্যার সহজ সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব কি না? খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে মিলে পেয়েও গেলেন। পরিবেশবান্ধব জৈব পদ্ধতিতে তৈরি কেঁচো সার ( ভার্মি কম্পোস্ট) উৎপাদন করবেন তিনি। যা রাসায়নিক ও কীটনাশকমুক্ত কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ভূমিকা পালন করবে।

ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। কঠোর মনোবল ও সুদৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে ২০১৭ সালে জুনে গঠন করলেন “বিষমুক্ত আম উৎপাদন ও রপ্তানিকারক সমবায় সমিতি”। সমিতিতে জুটে গেলো ৩০ জন সদস্য। প্রত্যেকের মাসিক চাঁদা ধরা হলো ১ হাজার টাকা। সেই টাকায় লিজ নেওয়া হলো আমবাগান। এক বছরের মাথায় সদস্য বেড়ে হলো সাড়ে ৩’শ। ২০১৮ সালের জুনের শেষে বাণিজ্যিকভাবে আম উৎপাদনে নামলেও পড়লেন সার সঙ্কটে। তাই বিষমুক্ত আম ও সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রায় ৩০ লাখ টাকায় গড়ে তুললেন ভার্মি কম্পোস্ট প্রজেক্ট। নাম দিলেন “বাস্ট ফার্টিলাইজার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড”।

২০১৮ সালের জুনে ১২ লাখ কেঁচো দিয়ে শুরু করলেও বর্তমানে এই খামারে রয়েছে এক কোটি কেঁচো। যার আনুমানিক বাজারদর ৬০ লাখ টাকা। প্রতিমাসে ৫০টি উৎপাদন চেম্বার বা ট্যাংক থেকে উৎপাদন হচ্ছে ১২টনের বেশি জৈব সার। যা বিক্রি করে মুনাফা মিলছে ২ লাখ টাকার বেশি।

গত ৮ মার্চ ২০২১ কেঁচোসার উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়ে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ইউসুফ আলীর সাথে। তিনি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে জানান, বাংলাদেশে ৩-৪ প্রজাতির কেঁচো থেকে সার উৎপাদন হয়। “আফ্রিকান রেডওয়ান” প্রজাতির কেঁচো রয়েছে তাঁর খামারে। প্রাথমিক অবস্থায় সাতটি স্টোরেজ ট্যাংকে “ট্রাইকোডার্মা” নামক উপকারি ছত্রাক সহযোগে পঁচানো হয় গোবর, কলাগাছ, কচুরিপানা, ঘাস-লতাপাতা, মুরগির বিষ্টা। পচনশীল এসব দ্রব্য কেঁচোসার তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়।

৬০ ভাগ গোবর ও ৪০ ভাগ অন্যান্য কাঁচামাল। ৫ থেকে ৬ সপ্তাহ পর মিথেন গ্যাস মুক্ত হলে এগুলো কেঁচোর খাবার উপযোগী তৈরি হয়। তখন চেম্বার থেকে তুলে নিয়ে উৎপাদন চেম্বারে পরিমাণ মতো দিতে হয়। এসব খাবার কেঁচো খায় আর পর্যায়ক্রমে চেম্বারের তলদেশে চলে যায়। উপরে ঝুরঝুরে দানা জমা হয়। এটিই পরবর্তীতে চালুনিতে চেলে প্যাকেটজাত “কালো সোনা” তৈরি হয়। বিক্রি হয় প্রতিকেজি ১২ টাকা।

প্রতিমাসে উৎপাদিত এ বিপুল পরিমাণ সার কিভাবে বিক্রি বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, আমরা কোন সার ডিলারের কাছে সার বিক্রি করি না। যা উৎপাদন হয় এখানকার আমচাষি ও সবজি চাষি ভাইয়েরা কিনে নেন। চাহিদার তুলনায় দিতে হিমসিম খেতে হয়। মাসে ২ লাখ টাকার বেশি বিক্রি হয়। তবে, প্রজেক্ট আরো বৃদ্ধি করা হচ্ছে। তাই লাভের টাকা খরচ করছি না। সমিতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কিছু সমস্যা থাকায় কোম্পানি বানানোর জন্য আবেদন করা হয়েছে। সচেতনতার মাধ্যমে দেশের আনাচে কানাচে এই প্রযুক্তি পৌঁছে দিতে পারলে পরিবেশ বাঁচবে। বর্তমান ও অনাগতরা বিষমমুক্ত খাবার পাবে। আমরা সুস্থ থাকতে পারব সেইসাথে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বীও হওয়া যাবে।

এই উদ্যোক্তা বলেন, আমাদের লক্ষ্য ও উদ্যেশ্য হলো খাবারের পুষ্ঠিমান বাড়নো এবং রাসায়নিক বর্জন করে নিরাপদ উৎপাদন। সেইসাথে উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করা, মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা এবং সহজলভ্য করাই আপাতত লক্ষ্য। এখানকার কৃষি বিভাগ যথেষ্ট আন্তরিক। মাঝেমধ্যেই এখানে আসেন। সকলের সহযোগিতায় আমরা এগিয়ে যেতে চাই।

ভার্মি কম্পোস্ট প্রজেক্ট ম্যানেজার মো: তৈহিদুল ইসলাম এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে জানান, রাসায়নিক সার প্রয়োগ করলে জমির ক্ষতি হয়। পিএইচ মাত্রা কমবেশি হয়। লবনাক্ততা দেখা দিতে পারে। কিন্তু ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহারে জমির উর্বরতা বাড়ে। ক্ষতির শঙ্কা নাই। নাইট্রোজেন, পটাশ, ফসফরাস, সালফারসহ মাইক্রো নিউট্রিয়নস জমিতে প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না। কারণ এখানে যে মানের সার উৎপাদন হয় তাতে প্রায় ১৩ টি উপাদান থাকে। ফলে যারা এই সার ব্যবহার করছেন তারা রাসায়নিক সার ব্যবহার প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন।

দামে সাশ্রয়ী ও বিষমুক্ত উৎপাদন হওয়ায় কৃষকদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। কেউ বাড়িতে অল্প কেঁচো দিয়ে শুরু করতে চাইলে তৈরি করতে পারে। এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে এই ভার্মি কম্পোস্ট প্রজেক্ট। এছাড়াও রয়েছে পোল্ট্রি, ডেইরি, বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন কেন্দ্র, ম্যাংগো ইকো পার্ক, মাছ চাষ প্রজেক্ট, গাড়ল ও ভেড়া পালন এবং ফুল চাষ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি অফিসার শফিকুল ইসলাম এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, এগ্রোগেট এগ্রো পার্কের বিষয়ে জানি। নিয়মিত কৃষি কর্মকর্তারা পরিদর্শন করেন এবং পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এখানে উৎপাদিত সার সারাদেশের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট সার কি না এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কারণ, যেকোন সময় এর মান খারাপ হতে পারে। ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহারে শুধুমাত্র গাছের উন্নতিই হয় না বরং কিছু ক্ষতিকর পোকামাকড়ও দমন হয়। সবমিলিয়ে এই সার ব্যবহার নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব। কৃষকের মাঝে ক্রমেই ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ছে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ