সীসার বিষক্রিয়ায় মরছে গবাদিপশু, ফাইল ছবি।

ইউসুফ আলী সুমন, মহাদেবপুর (নওগাঁ) প্রতিনিধি: নওগাঁর মহাদেবপুরে অবৈধভাবে সীসা উৎপাদন কারখানা মানুষ ও গবাদিপ্র্রাণির জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। বিষাক্ত সীসার প্রভাবে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা। নষ্ট হচ্ছে জমির ফসল। সীসা কারখানার দূষণে বিষাক্ত ঘাস খেয়ে মরছে গবাদিপশু।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার খাজুর ইউনিয়নের শাহাজাতপুরে অবস্থিত মেসার্স হাজেরা রাইচ মিলের চারপাশে টিন দিয়ে ঘেরা সীসা কারখানা। কোনো সাইনবোর্ড না থাকলেও ভেতরে রয়েছে একটি সীসা কারখানা। এখানে পুরনো ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা উৎপাদনের কাজ চলে রাতের অন্ধকারে। কারখানায় ধোঁয়ার কারণে আশপাশের এলাকায় মানুষের শ্বস-প্রশ্বাসে সমস্যাসহ বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে আশেপাশের জমির বিষাক্ত ঘাস খেয়ে এ পর্যন্ত স্থানীয় ৪ জন কৃষকের ৬টি গরু ও ২টি ছাগল মারা গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

স্থানীয় শাহজাদপুর গ্রামের কৃষক মোবারক হোসেন এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে জানান, ২০ দিন পূর্বে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি গরু কিনেছেন মোটাতাজা করার জন্য। গত ১২ নভেম্বর সকালে গরু ও ছাগল ওই কারখানার পাশে জমিতে ঘাস খাওয়ানোর প্রায় দুই ঘন্টা পর হটাৎ গরুর মুখ দিয়ে ফেনা উঠতে থাকে। তারপর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর গরুটি মারা যায়। এর কিছুক্ষণ পর ছাগলটিও বমি করতে করতে মারা যায়। এত দ্রুত মারা যায় যে গরুটির চিকিৎসা করানোর সময়ই পাওয়া যায় না।

মোবারক হোসেন বলেন, ‘আমি গরীব মানুষ দুই ছেলে ভ্যান চালিয়া জীবিকা নির্বাহ করে। খুব অভাবের সংসার। অনেক কষ্ট করে জমানো টাকা দিয়ে গরুটি কিনেছিলাম। আর ছাগল গত এক মাস পূর্বে ৩ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছিলাম। কিছুদিন মোটাতাজা করে বাজারে গরু-ছাগলকে বিক্রি করবো যাতে কিছু টাকা আয় হয়। কিন্তু আমার আয়ের সম্বল শেষ হয়ে গেল। সুস্থ সবল গরু-ছাগল মাঠে ঘাস খাওয়ানোর পরেই মারা গেছে। এর একটিই কারন ব্যাটারি গলানোর কারনে বিষাক্ত ধোঁয়া জমির ঘাসের সাথে মিশে যায় সেটা খাওয়ার কারনেই গরু-ছাগল মারা গেছে। আমি এর বিচার চাই।’

একই এলাকার শামসুদ্দিন এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, গত ১৬ নভেম্বর সকালে সীসা কারখানার পাশের জমিতে আমার তিনটি গরুকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যাই। দুপুরে গরু বাড়িতে নিয়ে আসার কিছুক্ষণ পর গরু তিনটির মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে থাকে। এর ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আমার তিনটি গরু মারা যায়। যার বাজার মূল্য প্রায় দেড় লাখ টাকা।

স্থানীয় মুক্তি চন্দ্রা বলেন, গত সোমবার আমার একটি গরু-ছাগল মারা যায় কারখানার ওখানে জমির ঘাস খেয়ে। কোন রোগ ছিলনা। ঘাস খাওয়ার পর মুখে ফেনা ওঠে মারা যায়। গরু-ছাগল মিলে প্রায় ৬০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।

সীসা কারখানার মালিক (বগুড়া সদররের বাসিন্দা) আরিফ হোসেন এর সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমরা তো মাত্র চলতি মাসের (নভেম্বর) শুরুর ৭ দিন ব্যাটারি গলিয়ে সীসা উৎপাদন এর কাজ করছিলাম। জাহেরা রাইচ মিলের মালিক এর নিকট থেকে ভাড়া নিয়ে কাজ করছিলাম। পরে স্থানীয়দের নানা অভিযোগের কারনে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছি। তবে আমার ব্যাটারি গলানোর ধোঁয়া জমির ঘাসে মিশে যাওয়ার কারনে গবাদি পশু সেই ঘাস খেয়ে মারা গেছে তা জানা নেই।

সীসা কারখানা চালানোর জন্য প্রশাসনিক অনুমতি ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেকেই তো নিয়মনীতির বাহিরে করছে।

অবৈধ সীসা কারখানার দূষণে মরছে গবাদিপশু বিষয়ে জানতে চাইলে জাহেরা রাইচ মিলের মালিক হেমায়েত হোসেন ঝন্টু এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, স্থানীয়দের গবাদি পশু মারা যাচ্ছে সেই সাথে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে এমন অভিযোগ স্থানীদের কাছ থেকে পাওয়ার পর গত বৃহস্পতিবার ব্যাটারি গলানো বন্ধ করে দেই। যেহেতু রাইচ মিল বন্ধ ছিল আর যারা ব্যাটরি গলানোর জন্য (আরিফ হোসেন) বলেছিল কাগজপত্র বা অনুমতি নেয়া আছে প্রশাসনের কাছ থেকে। অনুমতি নেয়া তাই আমি বিশ্বাস করে কাগজপত্র না দেখেই ভাড়া দিয়েছিলাম। বর্তমানে কারখানা বন্ধ আছে।

খাজুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বেলাল এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, অবৈধভাবে ব্যাটারি গলিয়ে সীসা উৎপাদন হচ্ছে জানার পর ৮নং ওয়ার্ডের মেম্বার আরিফুল ইসলামকে সেই সীসা কারখানায় কয়েকদিন আগে পাঠালে কারখানার সবাই পালিয়ে যায়। আর যাদের গরু-ছাগল মারা গেছে তারা কেউই যোগাযোগ করে নাই। তারপরও আমি খোঁজ নিয়ে বিষয়টি দেখবো।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. মহির উদ্দিন এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, পর্যাপ্ত নিয়মকানুন না মেনে খোলা পরিবেশে ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা উৎপাদনের কারনে সেটার ধোঁয়া পরিবেশে যায়। যা পরিবেশ, মানুষ ও গবাদি পশু-পাখির জন্য মারাত্বক ক্ষতি সাধান করে। গত কিছুদিন পূর্বে জেলার ধামুইরহাটে অবৈধভাবে ব্যাটারি গলিয়ে সীসা উৎপাদনের কারনে সেখানকার ধোঁয়া জমির ঘাসে মিশে বিষাক্ত হয়ে যাওয়ায় সেই ঘাস গরু খেয়ে মারা যায়। নওগাঁতে গরুর রোগ নিয়ন্ত্রণ এর জন্য পরীক্ষাগার নাই। পাশ্ববর্তী জেলা জয়পুরহাটে আছে। তবে যেখানে অবৈধভাবে নিয়ম না মেনে ব্যাটারি গলিয়ে সীসা উৎপাদন করা হবে, সেখানকার আশে পাশের জমির ঘাস যদি গবাদিপশু যদি খায় তবে অবশ্যই গবাদিপশুর মারাত্বক ক্ষতি হবে। এমন কি প্রাণহানিও হতে পারে কারন সেটা বিষাক্ত হয়ে যায়।

অবৈধ সীসা কারখানার দূষণে মরছে গবাদিপশু বিষয়ে মহাদেবপুর উপজেলা নিবার্হী অফিসার (ইউএনও) মো. মিজানুর রহমান মিলন এগ্রিকেয়ার২৪.কম কে জানান, অবৈধ সীসা কারখানার বিষয়ে জানা নেই। অভিযোগ পেলে অবশ্যই প্রযোজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ