পোল্ট্রি ডেস্ক, এ্রগ্রিকেয়ার২৪.কম: অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়ে দেশজুড়ে হাজার হাজার মুরগি মারা যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের খামারে মুরগি মারা যাওয়ায় আতঙ্কে রয়েছেন খামারিরা।

খামারিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আক্রান্ত মুরগির হাত-পা, বুক শুকিয়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট হওয়া, লিভার ফুলে যাওয়, অন্ত্রে ঘা হওয়া, খাবার কম খাওয়া, ঝিমানো। আবার ১ থেকে ৪৫ দিন বয়সী মুরগির মধ্যে দেখা দেয়া আরেক রোগ গত ৮ মাসে বহু সোনালী, লেয়ার, ব্রয়লার খামার উজাড় করেছে। আক্রান্ত মুরগি বেঁচে থাকলেও পূর্ণাঙ্গ বয়সে আশানুরুপ ওজন হচ্ছে না।

নওগাঁ জেলার মান্দা থানার লেয়ার খামারি আসলাম,সাইদুর, ছেফাতুল্যাসহ বহু খামারি বলছেন, খাঁচার মধ্যে মুরগি মরে পড়ে থাকছে। রাতে মুরগিকে খেতে দিয়ে খামার থেকে আসলে পরেরদিন সকালে মুরগি মরে পড়ে থাকছে। আবার দিনের বেলায়ও মরছে।

ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার মোক্ষপুর ইউপির নিজবাখাইল গ্রামের রূপসী বাংলা এগ্রো কমপ্লেক্সের মালিক ইব্রাহীম খলিল জানান, ২০০৯ সালে ২ হাজার লেয়ার মুরগি নিয়ে খামার শুরু করেছিলেন। প্রথম থেকেই সীমিত লাভ দিয়ে ব্যবসা করে আসলেও ধুকে ধুকে চলে আসছিল। পরের বছর পরিধি বাড়িয়ে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার লেয়ার মুরগির খামার করেন। এর মধ্যে ২ হাজারের অধিক মুরগি ডিম দিচ্ছিল। এভাবেই ২০১৩ সালের দিকে পরিধি আরো বাড়িয়ে আরো দুইটি নতুন সেড নির্মাণ করে ৪টি সেডে প্রায় ৯ হাজারের অধিক লেয়ার মুরগির খামার চালিয়ে আসছিলেন।

চলতি বছরের মাসের প্রথম দিকে অজ্ঞাত রোগের হানায় গত কয়েক দিনে তার প্রায় ৬ হাজার মুরগি মারা গেছে। বর্তমানে তার পুঁজিসহ সব শেষ হয়ে গেছে। লেয়ার মুরগি মরে খামারি ইব্রাহীম খলিলের প্রায় ৪০ লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে জানান।

একই এলাকার নজরুল ইসলাম ঢালীর প্রায় ৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। ত্রিশাল উপজেলার সদর ইউনিয়নে চিকনা গ্রামের স্বাধীন পোল্ট্রি খামারের মালিক নজরুল ইসলাম ঢালী ২ হাজারের অধিক লেয়ার মুরিগ পালন করে আসছিলেন। এতে প্রায় ২ হাজার মুরগি ডিম দিচ্ছিল। একই রোগে গত ১৫ দিনে তার প্রায় এক হাজারের অধিক মুরগি মারা গেছে।

এদিকে পাবনার আটঘরিয়া পৌর এলাকার কিরানীর ঢালু মহল্লার মো. গোলজার হোসেনে জানান, তিনি চারটি সেটে মুরগির খামার গড়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ অজ্ঞাত রোগে তিনটি সেটের প্রায় ৪ হাজার মুরগি মারা গেছে। দেবোত্তর ইউনিয়নের শ্রীকান্তপুর গ্রামের ফয়সাল হোসেন বলেন, আমার খামারে ৪২০ মুরগি ছিল। অজ্ঞাত রোগে ইতিমধ্যে প্রায় ৩০০ মুরগি মারা গেছে। কোনো উপায় না পেয়ে ডিম দেওয়া মুরগি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছি। ক্ষতিগ্রস্ত খামারি আটঘরিয়া পৌর মহল্লার বিশ্রামপুর গ্রামের আক্কাস আলী প্রাং, আনোয়ার হোসেন আনু বলেন, এই রোগের জন্য বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছে। কোনো ওষুধেই সুফল মেলেনি। এমন পরিস্থিতিতে প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে মিলছে না কোনো সহযোগিতাও।

অজ্ঞাত রোগে খামারের মুরগি মারা যাওয়ায় অনেক খামারিই নিঃস্ব হয়েছেন। প্রায় আট মাস ধরে অজ্ঞাত এক রোগে কোনো না কোনো খামারে মরে যাচ্ছে সব মুরগি। বেঁচে গেলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী ওজন বাড়ছে না। লোকসানের ভয়ে কম ওজনের মুরগিই বিক্রি করে দিচ্ছেন খামারিরা। দ্রুত শনাক্ত করতে না পারলে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ময়মনসিংহের রূপগঞ্জের সফিকুল ইসলাম দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে মুরগির ব্যবসা করছেন। অজ্ঞাত রোগে গত মাসে তার খামারের ৮ হাজার মুরগি মারা গেছে। অজানা রোগের পুঁজি হারিয়ে এখন অন্যের খামারের চাকরি করছেন আরেক খামারি আবদুল মান্নান ।

ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. হারুনুর রশিদ বলেন, খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে, খামারিদেরকে বিভিন্নভাবে পরামর্শও দেয়া হচ্ছে। তবে উপজেলার সব খামারিদের ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। প্রান্তিক পর্যন্ত সেবা পৌঁছে দিতে কাজ করে যাচ্ছি।

পাবনার আটঘরিয়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আনিছুর রহমান বলেন, এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণেই দেখা দিয়েছে এই রোগ। তিনি আরও জানান, মারা যাচ্ছে সাধারণত কিছু ভাইরাসজনিত রোগে। রাণীক্ষেত রোগ, গামবোরো এই রোগগুলো সারা বছরই হয়। ঋতু পরিবর্তনের সময় কক্সিডিওসিস বেশি হয়। এই রোগগুলোতেই বেশি মারা যাচ্ছে। খামারিদের উচিত আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা ও পরামর্শ গ্রহণ করা। তারা যদি আমাদের অফিসে যোগাযোগ করে তাহলে ময়নাতদন্ত করে বা ল্যাবরেটরিতে নমুনা পাঠিয়ে রোগ নির্ণয় করে আমরা ব্যবস্থা নিব।

বাংলাদেশ ব্রাঞ্চের ওয়ার্ল্ড পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ফজলে রহিম খান শাহরিয়ার বলেন, খুবই খারাপ অবস্থা ছিল ফেব্রুয়ারি-মার্চে, এটার প্রকোপটা একটু কমে এসেছে। এটা কী ধরনের ভাইরাস সেটি শনাক্ত করে সেটার জন্য যে ভ্যাকসিনটা দরকার, সেটা বিদেশ থেকে আনার চেষ্টা করতে হবে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মোসাদ্দেক হোসেন জানান, যে খামারে এই রোগ দেখা দিয়েছে, সেখানে শতভাগ মুরগি মারা গেছে। আমাদের দেশে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা আছে তাদেরকে যদি বলা হয় যে খামারে এ সমস্যা হচ্ছে, তখন তারা এটি পরীক্ষা করে দেবে।

এর আগেও বার্ড ফ্লুর সময় তারা পরীক্ষা করে রোগ শনাক্ত করে দিয়েছিল। এ রোগে আক্রান্ত মুরগির হাত-পা, বুক শুকিয়ে যায়, শ্বাসকষ্ট হয়, লিভার ফুলে যায়, অন্ত্রে ঘা হয়। প্রচলিত কোনো ওষুধে এর উপশম হয় না।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ