মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে বিনা টাকায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের সবজি ও ইরি ধানে সেঁচ সুবিধার জন্য ২০১৮ সালে প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। কিন্তু ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত সৌর বিদুৎ চালিত ২০টি পাতকুয়া (ডাগওয়েল) কোন কোন কাজে আসছে না কৃষকের। এ প্রকল্পকে সরকারি টাকা অপচয়ের অভিনব কৌশল হিসেবেই দেখছেন কৃষকরা।

রাজশাহী বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) সূত্রে জানা যায়, “রাজশাহী জেলার বাঘা, চারঘাট ও পবা উপজেলায় জলাবদ্ধতা নিরসন এবং ভূ-পরিস্থ পানির প্রাপ্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ প্রকল্প” শুরু হয় ২০১৮ সালের অক্টোবরে। সম্পূর্ণ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ২৮ কোটি টাকা।

এরমধ্যে সৌর বিদুৎ চালিত ২০টি পাতকুয়া (ডাগওয়েল) নির্মাণ করা হয় ২ কোটি ৬০ লাখ টাকায়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ পায় বিএমডিএ। বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান তড়িঘড়ি করে কাজ শেষ করে ঢাকায় ফিরে যান ঢাকার সেগুনবাগিচার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান “সুপারস্টার রিনিউক্যাবল এনার্জি লিমিটেড”। কাজে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও বিন্দুমাত্র অনিয়ম হয়নি বলে দাবি বিএমডিএ’র।

সংশ্লিষ্টদের দাবি, পাতকুয়াগুলো ভূ-পরিস্থ পানির সংরক্ষণ, সেচ কাজে ব্যবহার ও ভূ-গর্ভস্থ পানির রিচার্জ বৃদ্ধিতে সহয়তা করছে। প্রকৃপক্ষে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পবা উপজেলার সবকটি পাতকুয়া কৃষকের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ। প্রতিটি পাতকুয়া থেকে মাত্র ২ জনেরও সুবিধা মিলছে না। সেইসাথে উদ্বোধনের ৪ মাস পরও সুবিধাভোগীদের কমিটি গঠন হয়নি। এলাকার প্রভাবশালীর নিজস্ব সম্পত্তি হিসেবেই পাতকুয়া ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ একাধিক কৃষকের।

সূত্র জানায়, চলতি বছরের জুন মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বেশিরভাগ পাতকুয়া কার্যকারিতা হারিয়েছে। ফলে প্রকল্পে উল্লেখিত ২৪২ হেক্টর জমির সেচ সুবিধা সম্প্রসারণের ফলে ১৪৫৭ হেক্টর জমি আবাদী করার কথা কাগজকলমে থাকলেও তা ধোঁয়াশায় রুপ নিয়েছে। এসব জমি থেকে ৮ হাজার ১৩ মেট্রিকটন অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন দাবি করলেও বাস্তবে তথ্যে কোন মিল পাওয়া যায়নি। নির্মাণের ১ বছর পার হতে না হতেই পাতকুয়ার কোনটি অকেজো আবার এরইমধ্যে কয়েকবার মেরামত করা হয়েছে কয়েকটি। মেরামতের জন্য কৃষকদের কাছ থেকে স্বল্প টাকা নেওয়ার কথা থাকলেও কৃষকরা জানেন না এ বিষয়ে। পাতকুয়ার সমস্যা দেখা দিলে “তাঁরাই” সারিয়ে দিয়ে যান বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। এক বছরের গ্যারান্টি থাকা যন্ত্রপাতি ৬ মাসের আগেই কি করে নষ্ট হয় প্রশ্ন তাদের।

চর মাজারদিয়া পূর্বপাড়া এলাকার চাষি ইসমাইল হক এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, “থালাবাসন ধোয়া, গোসল করার জন্য ভালো হয়। আবাদ করার জন্য এ ডিপ না। আমরা এটা থেকে আবাদ করার যে সুবিধা সেটা মোটেও পাইনা। ৫ বিঘার একটা দাগ আছে এই পাতকুয়া এতটুকু জমিতেই পানি দিতে পারে না। পাশে মসজিদ আছে, অজু করার জন্য কাজে লাগে। দু-একজন পাতকুয়ার পানি খায়।”

পবা উপজেলার চর মাজারদিয়া পশ্চিমপাড়া এলাকায় নির্মিত একটি পাতকুয়ার পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আলম শেখ এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, “এতো টাকার জিনিসে মাত্র ৫ বিঘা জমিতে আবাদ হবে এটা যুক্তিযোগ্য না। আমার নিজের জমিতেই সেঁচ দিতে পারিনা। জমির এই মাথায় পাতকুয়া ওই মাথায় শ্যালো মেশিন ফেলতে হয়েছে। ৩০ হাজার টাকায় শ্যালো মেশিন করেছি সেটা দিয়েই ১০ বিঘা জমিতে সেচ দিতে পারি। পাতকুয়ার পানি দিয়ে তো আর হয়না তাই শ্যালো দিয়েই ধানে সেচ দিয়েছি। এই পাতকুয়া তৈরিতে যে টাকা খরচ হয়েছে সেই টাকা দিয়ে ভালোমানের সেচ ব্যবস্থা করা যেত বলে মনে হয়।”

এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি আবুল কালাম। তিনি একই এলাকায় নির্মিত আরেকটি পাতকুয়ার পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। তাঁর ৭ বিঘা জমির এক কোনে বসেছে পাতকুয়া। জানতে চাইলে কালাম এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন,“ ২০ বিঘা জমিতে সেচ দেওয়া যায়। পেয়ারা, মাল্টা, সবজিতে সেচ দিই। ভালোভাবেই সেচ দেওয়া হয়। কোন সমস্যা নাই।”

আবুল কালামের বক্তব্য মিথ্যাচার বলে জানান একই এলাকায় চাষি সেলিম উদ্দিন। তিনি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, “এই পাতকুৃয়া দিয়ে ৪ বিঘা জমিতে ভালোভাবে সেচ দেওয়া যাবে। রোদ যতক্ষণ, পানি ততক্ষণ; রোদ শেষ, পানি শেষ। সরকার ব্যর্থ কাজ করেছে এটা। এই টাকা দিয়ে একটা ডিপ করা যেত। এখন যে অল্প জমিতে সেচ দেওয়া যাচ্ছে সেটা বেড়ে ২০০ বিঘা জমিতে সেচ দেওয়া যেত। সুইচ খুলে গিয়ে আছে, আমরা চালু করতে পারিনা। ”

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সেচ প্রকল্পের সৌর বিদুৎ চালিত “এলএসপি পাম্প” স্থাপন হয় উপজেলা হরিপুর ইউনিয়নের মাজারদিয়ার চর এলাকায়। এই এলএসপি পাম্পের দেখাশুনা করেন স্থানীয় প্রভাবশালী মেম্বারের ভাই মাবুদ। তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে বেশ কয়েকটি অভিযোগ।

কৃষকরা জানান, নদী থেকে পানি তুললেও তাঁরা নিয়মিত পানি পান না। জমিতে সেচ দিতে ২০০ টাকা ঘন্টা গুনতে হয় তাদের। আবার টাকা দিয়ে সেচ দেওয়ার পরও ধান উঠলে প্রতি বিঘায় ২ মণ ধান দাবি করেছেন তিনি। তাছাড়া, কৃষকদের পানি নেওয়ার কার্ড করে দেওয়ার জন্য ১ হাজার টাকা দাবি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

কথা হয় মাবুদের সাথে। অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, “আমার পাইটের ( পারিশ্রমিক) দাম আছে। ডিপের ( পাম্প) কার্ডে টাকা তোলার জন্য সারাদিন লস করে শহরে যেতে হয়। নদী পার হলেই ৪’শ টাকা খরচ হয়। তারপরেও টাকা বাঁকি রাখে। আমি ২০০ টাকা ঘন্টা নিই, অস্বীকার করব না।”

জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো: নাজিরুল ইসলাম এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, “ রাজশাহীতে চার উপজেলায় ২০ টি ডাগওয়েল হয়েছে। পবা উপজেলায় ১১টা, পুঠিয়া ২টা, বাঘা ২টা, চারঘাটে হয়েছে ৫টা। প্রতিটি ডাগওয়েল সাড়ে ৫ হেক্টর জমিতে সেচ দিতে পারবে এটা আমাদের টার্গেট। পাতকুয়াগুলো তার চেয়ে বেশি দিচ্ছে, ৭-৮ বিঘা পর্যন্ত।

পাতকুয়ার কার্যকাকারিতা ও পরিচালনা কমিটি গঠন নিয়ে প্রশ্ন তুললে অস্বীকার করেন তিনি। এই কর্মকর্তা বলেন, ‘ এটা আমার বিশ্বাস হয় না। আমার কাছে রিপোর্ট আছে। ৮-৯ জনের একটি করে পরিচালনা কমিটি আছে। রিপোর্টে সব আছে। রিপোর্ট তো আর এমনি দেয় না! মিনিস্ট্রির লোকজন সরেজমিনে গিয়ে দেখেছেন। প্রতিদিন ৮ ঘন্টা করে চলে। রোদ কম হলে সেদিন কম হবে। তাছাড়া ভালোই চলছে সব।”

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কে জে এম আব্দুল আউয়াল এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, “আমি এখানে নতুন এসেছি। ডাগওয়েল সম্পর্কে এ মূহুর্তে তথ্য নেই। তথ্য সংগ্রহ করে কথা বলতে হবে।”

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ