ডা: সুচয়ন চৌধুরী, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: মানুষ নিজের অজান্তেই মানুষ নিজের মধ্যে গড়ে তুলেছে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধী দুর্গ। অন্যান্য খাবারের ন্যায় গরুর দুধের মধ্যে এমন কিছু উপাদান আছে যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।

দুধের এ রকম একটি উপাদান হলো কেসিন, যা দুধের মূল প্রোটিন অংশ। এই কেসিন প্রোটিন এবং তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ বা পলি পেপটাইটগুলোও ভাইরাসবিরোধী কাজ করে। এরা শরীরের রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে মূলত দুই উপায়ে। যথা: প্রথমত একটি  হলো শরীরের ভিতরে বহিরাগত ভাইরাসকে মেরে ফেলার যে প্রক্রিয়া চলে তাকে ত্বরান্বিত করে।

দ্বিতীয়ত শরীরের মারাত্মক আত্মঘাতী কিছু কার্যক্রম (যেমন: পচন বা ঝবঢ়ংরং) কে সে কমিয়ে আনে বা প্রশমিত করে। তাছাড়া শরীরের ভিতরে  বি-লিম্পোসাইট এবং টি-লিম্পোসাইটগুলো সচল করে দেয় এবং সচলগুলোর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে দেয়। দুধের আরেকটি প্রোটিন হলো ল্যাক্টোফেরন যা সরাসরি ভাইরাসের উপর কাজ করে।

আলফা ল্যাকটো অ্যালবুমিন (α খধপঃড় ধষনঁসরহ) নামের দুগ্ধ প্রোটিনটিও ভাইরাসবিরোধী কার্যক্রমের সাথে জড়িত। সাথে সাথে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি করে। গবেষণায় দেখা গেছে লেকটোফেরন এবং এর থেকে উৎপন্ন পেপটাইটগুলো মূলত ভাইরাস তার পোষক দেহের কোষের সাথে যেখানে ক্রিয়া বিক্রিয়া করে সেখানেই হস্তক্ষেপ করে। পোষক কোষের (ঐড়ংঃ পবষষ) প্রাচীরে যে ঋণাত্মক চার্জধর্মী হেপারেন সালফেট (যবঢ়ধৎরহ ঝঁষঢ়যধঃব) থাকে তার সাথে মিথস্ক্রিয়া করে ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক অবস্থা তৈরি করে। ফলে ভাইরাস আর পোষকের কোষের অভ্যন্তর প্রবেশ করতে পারে না।

অন্যদিকে বিটা-ল্যাকটোগ্লোবিউওলিন বা আলফা ল্যাকটোএলবুমিন জাতীয় দুগ্ধ প্রোটিনের বাইরের আবরণীতে ঋণাত্মক ধর্মী অংশ (অহরড়হরপ ঢ়ধঃপয) থাকে কিন্তু ক্যাসিনের বাইরের দিকে ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক ধর্মী অংশ আছে। তাই দুধের এই দুই ধরনের বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে এর ভাইরাস এবং পোষকের দেহের মিথস্ক্রিয়ায় জোরালোভাবে বাধা প্রদান করতে পারে।
সাধারণত একটি ভাইরাস তার জীবন চক্রে বেশ কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে ।

যেমন : পোষক কোষের সাথে যুক্ত হওয়া, তারপর উক্ত কোষের মধ্যে ডুকে যায়, ভাইরাসের জিনোমের রেপ্লিকেশন সম্পন্ন হয়, ভাইরাস নিজস্ব প্রোটিন তৈরি করে নিজেদের বংশবিস্তার করে এবং আক্রান্ত কোষ থেকে বের হয়ে আসে। এই ধাপগুলো যেকোন পর্যায়ে দুগ্ধজাত প্রোটিন বা ভাইরাসরোধী উপাদান কাজ করে।

ভাইরাসের গাঠনিক প্রোটিনের সাথে যুক্ত : যেই ভাইরাসগুলোর বাইরে কোন আবরণী পর্দা  থাকে না (ঘড়হ ঊহাবষড়ঢ়বফ) সেগুলোর বাইরের দিকে গাঠনিক প্রোটিনগুলো অনেক সময় কাঁটা বা আঁশের মত বাইরের দিকে বের হয়ে থাকে যা পোষক কোষের সাথে প্রাথমিকভাবে যুক্ত হতে সাহায্য করে। আর সমস্ত ভাইরাসের বাইরে পর্দা থাকে (ঊহাবষড়ঢ়বফ) তারা পোষক কোষের রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হয়।

দুধের এমন কিছু প্রোটিন আছে যা এই দুই ধরনের ভাইরাস প্রোটিনের সাথে যুক্ত হয় ভাইরাসকে পোষক কোষের সাথে যুক্ত হতে বাধা দেয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের আবরণীতে হিমাগ্লুটিনিন নামে একধরনের প্রোটিন পাওয়া যায়, যা ভাইরাসকে পোষক কোষের সাথে যুক্ত হতে এবং ভাইরাসের জিনোম ঐ কোষের ভেতরে প্রবেশ করতে সহায়তা করে। দুধে কিছু প্রোটিন এই হিমাগ্লুটিনিনের সাথে যুক্ত হয়ে হিমাগ্লুটিনেশোনের মাধ্যমে এর কার্যকারিতা ধ্বংস করে দেয় ফলে ঐ ভাইরাস আর পোষক কোষে প্রবেশ করতে পারে না।

ভাইরাসকে পোষক কোষের সাথে সংযুক্ত হতে বাঁধা প্রদান : ভাইরাস পোষক কোষের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য পোষক কোষের কোন রিসেপ্টরকে শনাক্ত করতে হয়। তার সাথে যুক্ত হয়ে পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু যদি ভাইরাস এই রিসেপ্টরকে খুঁজে না পায় তাহলে  সে তার জীবনের পরবর্তী ধাপগুলো অতিক্রম করতে পারে না। দুধের প্রোটিন এই রিসেপ্টর গুলোর সাথে ক্রিয়া করে নিষ্কিয় করে দেয়। যার কারণে ভাইরাস তাকে আর খুঁজে পায় না।

ভাইরাসের বংশ বিস্তারে (ৎবঢ়ষরপধঃরড়হ)  বাধা প্রদান করা : ভাইরাসের রেপ্লিকেশনের জন্য বিভিন্ন এনজাইম বা উৎসেক প্রয়োজন। দুগ্ধজাত বিভিন্ন প্রোটিন এই সমস্ত এনজাইমকে বাঁধা দিয়ে ভাইরাসের রেপ্লিকেশনকে বাধাগ্রস্ত করে ফলে ভাইরাস বংশবিস্তার করতে পারে না।

পোষক কোষের সহজাত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা: পোষক দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুই ধরনের। একটি হলো তার সহজাত (রহহধঃব) যা স্বাভাবিকভাবে তার শরীরে থাকে। আর অন্যটি হলো, যখন বাইরের থেকে শরীরের জন্য ক্ষতিকর কোনকিছু (ঋড়ৎবরমহ অহঃরমবহ) শরীরে প্রবেশ করে শরীরের অভ্যন্তরে বেশ কিছু প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। যার ফলে বিভিন্ন পদার্থ উৎপন্ন হয়ে উক্ত বিপদ মোকাবিলা করে। এটি হলো তার অভিযোজিত (অফড়ঢ়ঃরাব)  রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা।

শরীরে সহজাত রোগ প্রতিরোধের জন্য আছে বিভিন্ন ধরনের লিয়োকোসাইট। যেমন: ম্যাক্রোফেজ, ডেনড্রাইটিক সেল, কিলার কোষ ইত্যাদি। আবার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যখন নতুন শত্রু মোকাবিলায় অভিযোজিত হয় তখন মূল ভূমিকা পালন করে বি-লিম্পোসাইট এবং টি-লিম্পোসাইটের মতো কোষ গুলো। আর এই দুইটি পথকে একত্র করতে কাজ করে সাইটোকাইন কেমোকাইন নামক বিভিন্ন সংকেত প্রদানকারী পদার্থ।

ল্যাকটোফেরন প্রাকৃতিক কিলার কোষের (ঘধঃঁৎধষ করষষবৎ ঈবষষ) সাইটোটক্সিক ক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। সাথে সাথে পলিমরফোনিউক্লিয়ার লিউকোসাইটের গতিশীলতাও বাড়িয়ে দেয় এবং সুপার অক্সাইড উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। এটি ম্যাক্রোফেজগুলোকে সক্রিয় করে দেয় এবং বিভিন্ন ধরনের সাইটোকাইন উৎপাদনের জন্য উদ্দীপ্ত করে।

অন্যদিকে ল্যাকটোফেরন বিপদকালীন মহূর্তে লিম্পোসাইটের বৃদ্ধিকে উদ্দীপ্ত করে। যার ফলে অপরিণত বি-লিম্পোসাইট এবং টি-লিম্পোসাইটগুলো গঠনগত পরিবর্তন হয়। ফলশ্রুতিতে বি-লিম্পোসাইটগুলো এন্টিজেনকে টি-হেল্পার টাইপ ২ কোষগুলোর সামনে তুলে ধরতে পারে।

অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় নিয়োজিত কোষগুলোকে সক্রিয় করা থেকে শুরু করে এন্টিজেন বিরোধী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে দুগ্ধজাত ল্যাকটোফেরন সহযোগিতা করা মাধ্যমে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করে। দুগ্ধজাত বিভিন্ন পেপ্টাইটেট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ত্বরান্বিত  ল্যাকটোফেরন ছাড়াও বিভিন্ন দুগ্ধ জাত প্রোটিন এবং পেপটাইট ভাইরাসবিরোধী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করে।

ল্যাকটোফেরন থেকে তৈরি ল্যাকটোরিসিন ও ল্যাক্টোরেফেরাম্পিন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করতে কাজ করে। কেসিন পেপটাইট অধিক লিম্পোসাইট এর সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য উদ্দীপ্ত করে। সাথে সাথে শরীরে যে ম্যাকরোফেজ আছে তাদের কার্যকারিতা বাড়িয়ে দেয়। তাদের কাজ হলো শরীরের জন্য ক্ষতিকর এন্টিজেনকে খেয়ে ফেলা।

তাহলে বিষয়টি দাঁড়ালো, দুধের এমন অনেক প্রোটিন এবং পেপ্টাইট আছে যা ভাইরাসবিরোধী কাজ করে মূলত ভাইরাস রোগ তৈরির জন্য যে যে ধাপের মধ্য দিয়ে যায় সে সে ধাপে বাধা প্রদান করে। আবার এদের মধ্যে অনেকে আছে যারা এন্টি ভাইরাল ওষুধের কার্যকারিতা বাড়িয়ে দেয়। তবে এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন। দুধের প্রোটিনও হয়তো হতে পারে কোন এন্টি ভাইরাল ড্রাগের টেমপ্লেট।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় গরুর দুধ লেখাটির লেখক ডা: সুচয়ন চৌধুরী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, মানিকছড়ি, খাগড়াছড়ি। মোবাইল : ০১৭১৮৬৩০২৬৮।

 

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ