আফতাব চৌধুরী, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: সামনেই শীত মৌসুম। এ মৌসুমে শাক-সবজি চাষের জন্য প্রস্তুতির কাজও চলে পুরোদমে। আগাম বাজার ধরার জন্য কোন কোন চাষি ভাই কিছু কিছু সবজি ফসল আগেবাগেই লাগিয়েও থাকেন। এরকমই শীতকালীন ১০ টি সবজির রোগ-বালাই ও প্রতিকার নিয়ে জানব আজ।

আমন ধান: ধানে ‘মোড়’ আসার মুখে জমি আগাছা মুক্ত করে বিঘা প্রতি ৭ কেজি পরিমাণ ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে। যারা দেরিতে বেশি বয়সের, দেশি জাতের ধানের চারা রোপণ করে থাকেন, রোপণের ২৫-৩০ দিন পর জমির আগাছা পরিষ্কার করে বিঘা প্রতি সাড়ে চার কেজি পরিমাণ ইউরিয়া প্রয়োগ করে জমি ঘেটে দিতে হবে। সার দেয়ার আগে জমির পানি বের করে নিয়ে ২ ইঞ্চি পরিমাণ পানি বেঁধে রাখলে ভাল হয়।

এ সময়ে জমিতে ‘ইচি পোকা’ ‘মাজরা পোকা’, ‘চুঙ্গি পোকা’, ‘লেদা পোকা’ ইত্যাদির আক্রমণ হতে পারে। বিশেষ প্রয়োজনে বিঘা প্রতি ১০০ লিটার পানি ১৫০ মিলি পরিমাণ ‘থায়োডান’ বা ‘এন্ডোসালফন’ একই হারে মিশিয়ে সমস্ত গাছে ভালভাবে ছিটিয়ে দিলে এসব পোকার আক্রমণ কমে যাবে। খোলা ধ্বসা রোগ, ঝলসা রোগের আক্রমণও এ সময় লক্ষ্য করা যায়। প্রয়োজনে বিঘা প্রতি ১০০ লিটার পানি ২০০ গ্রাম পরিমাণ ‘ব্যভিস্টিন’ বা ‘কার্বেনডাজিম’ (৫০ ডবু পি) ভালভাবে মিশিয়ে ভালভাবে ছিটিয়ে দিলে এসব রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে কৃষি প্রযুক্তিবিদদের সঙ্গে পরামর্শ করা যায়।

আরো পড়তে পারেন: নভেম্বর-ডিসেম্বরে যেসব সবজি ও ফসল চাষ করবেন

পাট : ফুল আসার মুখে পাট কাটা ভাল। কাটার পর তা ২-৩ দিন জমিতে রেখে পাতা ঝরিয়ে নিয়ে মৃদু স্রোত সম্পন্ন পরিষ্কার জাঁকের ব্যবস্থা করতে হবে। জাঁক দেয়ার প্রয়োজনে কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে উপরে ইট, পাথর ব্যবহার করে নেয়াই উত্তম।

চীনাবাদাম : জমি আগাছামুক্ত রাখতে এবং পানি জমতে বা স্যাঁতস্যাঁতে অবস্থা হতে দেয়া যাবে না। এ সময় চীনাবাদাম-এর পাতায় কাল ছিট বা টিক্কা রোগ দেখা দিতে পারে। প্রয়োজনে বিঘা প্রতি ১০০ লিটার পানি ৩০০ গ্রাম পরিমাণ ‘ব-াইটক্স’ বা ‘ফাইটোলন’ বা ‘ডায়থেন-এম ৪৫’ -এর যে কোন একটি ওষুধ মিশিয়ে সমস্ত গাছে ভালভাবে ছিটিয়ে দিলে এ রোগের আক্রমণের সম্ভাবনা থাকে না।

মাসকলাই ও বরবটি : জমিতে পানি জমতে বা আগাছা হতে দেয়া যায় না। ‘জাব’ পোকার আক্রমণ হতে পারে। প্রয়োজনে বিঘা প্রতি ১০০ লিটার পানি ১৫০ মিলি পরিমাণ ‘ম্যালাথিয়ন’ মিশিয়ে সমস্ত গাছে ভালভাবে ছিটিয়ে দেয়া যায়। বরবটি সবজি হিসেবে ব্যবহার করলে, ওষুধ প্রয়োগের আগেই তুলে নিতে হবে অথবা ওষুধ প্রয়োগের ১০ দিনের মধ্যে কোনও বরবটি খাবার জন্য উঠানো ঠিক হবে না এতে বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা থাকে।

আরোও পড়ুতে পারেন: মাটি ছাড়াই যে প্রযুক্তিতে সবজি চাষ করছে জাপান

অড়হর : ‘ঢলে পড়া’ রোগের আক্রমণ হতে পারে। জমিতে পানি জমতে বা স্যাঁতস্যাঁতে অবস্থা হতে দেয়া যায় না। বিশেষ প্রয়োজনে প্রতি লিটার পানি ৩ গ্রাম পরিমাণ ‘ব-াইটক্স’, ‘ব-ুকপার’ বা ‘ফাইটোলন’ মিশিয়ে সমস্ত গাছে বিশেষ করে গাছের গোড়ার দিকে ভালভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। গুঁটি ছিদ্রকারী পোকা’ বা ‘লিক ইটিং ক্যাটার পিলার’-এর আক্রমণে প্রয়োজনে প্রতি লিটার পানি দেড় মিলি পরিমাণ ‘থায়োডান’ বা ‘এন্ডোসালফন’ বা অর্ধেক মিলি পরিমাণ ‘ডিমেক্রন’ এ হারে মিশিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে। ওষুধ প্রয়োগের ২১ দিনের মধ্যে কোন গুঁটি খাওয়ার জন্য তুলা ঠিক হবে না। জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।

আখ : আখ লাগানোর উপযুক্ত সময় শরৎকাল। দীর্ঘ দিনের ফসল তাই মাটি পরীক্ষার সুপারিশ অনুসারেই সার প্রয়োগ করতে হবে। গুড়ের জন্য ভাল জাতের মধ্যে রয়েছে সি ও -৯৯৭ এ, ৬২১৭৫, ৬৯-এ ৩৭ আর চিবিয়ে খাওয়ার জন্য, নং ১০৮, গেন্ডারি ইত্যাদি। বিঘা প্রতি ‘বিচন’ লাগবে প্রায় ৮ কুইন্টাল পরিমাণ। প্রতিটি ‘বিচনে’ তিনটি করে ‘চোখ’ থাকা দরকার। বিচন শোধনের আগে ২৪ ঘণ্টা পানিতে ডুবিয়ে নিলে অঙ্কুরোদগম ভাল হয়। পরে প্রতি লিটার পানি ১ গ্রাম ‘ব্যভিস্টিন’ এ হারে মিশিয়ে ত্রিশ মিনিট বিচন ভিজিয়ে রেখে ছায়ায় গুকিয়ে নেয়া দরকার। ‘ক্লোরাপাইরিফস’ এ হারে মিশিয়ে নিয়ে লাগানোর আগের দিন বালিতে ছিটিয়ে দেয়া ভাল। এ মাসে লাগনো আখের ‘সাথী’ ফসল হিসাবে ‘তোরিয়া’ চাষ করা লাভজনক

হলুদ : আদা, হলুদ চাষের জন্য জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে এবং প্রয়োজনে গাছের গোড়ায় মাটি টেনে দিলে উপকার হয়। পানি জমতে দেয়া ঠিক হবে না।

মুখী কচু : মুখী কচু তোলার সময় শীতকাল। যারা বীজ ‘মুখী’ রাখতে ইচ্ছুক তারা ফসল না তুলে জমিতেই থাকতে দিলে ভাল হয়। তবে পানি নিষ্কাশের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

শাক-সবজি : যারা শীতের শাক-সবজি যেমন ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, ওলকপি, পালং, শালগম ইত্যাদি চাষ করতে ইচ্ছুক তাদের উচিত শরৎকালে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে। বীজ তলার লম্বা ৯০ সেমি বা ২৫ সেমি উঁচু হওয়া সুবিধাজনক। পানি নিকাশের ভাল ব্যবস্থা রাখতে হবে। জমি তৈরির সময়ই মাটির বিভিন্ন ক্ষতিকর পোকা দমনে প্রতি লিটার পানি ৮ মিলি পরিমাণ ‘লেনরোপাইরিয়াস’ এ হারে মিশিয়ে বীজতলা তৈরির সময়ই মাটিতে ছিঁটিয়ে দেয়া যেতে পারে। তার জন্য বিঘা প্রতি কেজি বীজ ২ গ্রাম ‘ব্যভিস্টিন’ বা ৩ গ্রাম পরিমাণ ডায়থেন এম-৪৫ বা ‘ক্যাপটান’ দিয়ে পরিশোধন করে নিতে পারেন। শাক-সবজির ভাল জাতের বীজ এবং উন্নত চাষ প্রযুক্তি বিষয়ে কৃষি প্রযুক্তিবিদদের সঙ্গে যোগাযোগ ভাল বীজ পাওয়া যেতে পারে।

ফল চাষ : নারিকেলের সহ প্রায় সমস্ত গাছের জন্যই বর্ষার পরে যে সার দিতে হয় তার সময় হয়ে গেছে। গাছের বয়স, প্রকার, অবস্থান বৃদ্ধি ইত্যাদি চিন্তা করেই সারের মাত্রা ঠিক করতে হয়। নারিকেলের জন্য এ সময় কিছুটা ‘ম্যাগনেসিয়াম সালফেট’ ও ব্যবহার করা ভাল। এ বছর যারা নারিকেল চারা লাগিয়েছেন, বর্তমানে চারা প্রতি ১০৮ গ্রাম পরিমাণ ইউরিয়া, ১২৫ গ্রাম পরিমাণ রকফসফেট এবং ২৩০ গ্রাম পরিমাণ মিউরেট অব পটাশ মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে পানি সেচ করতে হবে। সাধারণভাবে ফল চাষে সুপার ফসফেটের বদলে রকফসফেট সার ব্যবহার করা অনেক বেশি লাভজনক।

ফুল চাষ : শীত মৌসুমে যারা গাঁদা, গে-ডিওলাস এবং অন্যান্য ফুলের চাষ করতে ইচ্ছুক প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়ার সময় এখনই। ভাল জাতের বীজ, চারা ও উন্নত কৃষি প্রযুক্তির জন্য কৃষি প্রযুক্তিবিদদের সঙ্গে এখনই যোগাযোগ করলে ভাল। আমাদের দেশে ইতিমধ্যেই ফুল বেশ অর্থকরী ফসল হিসেবেই স্থান করে নিয়েছে। বিদেশে রপ্তানির কথাবার্তাও হচ্ছে।

শীতকালীন ১০ টি সবজির রোগ-বালাই ও প্রতিকার নিয়ে লিখেছেন সাংবাদিক ও কলামিস্ট আফতাব চৌধুরী। বৃক্ষ রোপণে জাতীয় পুরস্কার (স্বর্ণপদক ১ম) প্রাপ্ত।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ