পঞ্চগড় প্রতিনিধি, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: গ্রামের পথ দিয়ে হাঁটা দিলে চোখে পরবে বাড়ির আশপাশ ও আঙ্গিনা সবুজ চা পাতায় ছেয়ে আছে। রুপ নিয়েছে ছোট ছোট চা বাগানে। চাষিরা ব্যস্ত এসব চা বাগানের পরিচর্যায়। কেউ কেউ সাথী ফসল হিসেবেও চাষ করে সবুজ পাতায় আঙ্গিনা ভরে রেখেছেন।

এমন চিত্র পঞ্চগড় জেলার সব খানে। এভাবেই এখন এ জেলার বিভিন্ন এলাকায় বাড়ির আনাচে-কানাচে ক্ষুদ্র পর্যায় থেকে শুরু করে স্টেট পর্যায় পর্যন্ত বাড়ছে চা চাষের পরিধি। দেশের সর্ব উত্তরের জনপদ পঞ্চগড়ে সমতল ভূমিতে এই চা-চাষ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা পাশাপাশি স্বর্গরাজ্যে পরিনত হয়েছে পুরো পঞ্চগড় জেলা।

পার্বত্য ও সিলেট অঞ্চলের পর তৃতীয় বৃহত্তম চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে পঞ্চগড়। পঞ্চগড়কে অনুসরণ করে চা চাষে এগিয়ে আসছে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলো। এক সময়ের পতিত গো-চারণ ভূমি ও দেশের সবচেয়ে অনুন্নত জেলা পঞ্চগড় এখন চায়ের সবুজ পাতায় ভরে উঠেছে। সৃষ্টি হয়েছে চোখ জুড়ানো নৈসর্গিক সৌন্দর্য।

আন্তর্জাতিক মানের চা উৎপাদন হওয়ায় দেশের গন্ডি পেরিয়ে পঞ্চগড়ের চা প্রবেশ করছে আন্তর্জাতিক বাজারে। জেলার বিস্তির্ণ এলাকাজুড়ে চা-বাগানের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে উঠায় সৃষ্টি হয়েছে কর্মহীন মানুষের কর্মসংস্থান, সেই সাথে উন্নয়ন হয়েছে আর্থ-সামাজিক অবস্থার।

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চগড় সফরে এসে সমতল ভূমিতে চা চাষের সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। এর পর থেকেই পঞ্চগড়ের তৎকালীন জেলা প্রশাসক রবিউল ইসলামের চেষ্টায় স্বল্প পরিসরে পরিক্ষামূলক ভাবে শুরু হয় পঞ্চগড়ের সমতল ভূমিতে চা-চাষ।

প্রথমদিকে টবে, পরে পতিত জমিতে বাড়তে থাকে চা-চাষ। সেই সফলতা থেকেই বানিজ্যিক ভিত্তিতে বাড়তে থাকে চা-চাষের পরিধি। প্রথম দিকে ক্ষুদ্র পর্যায়ে শুরু হলেও ২০০১ সালে তেতুঁলিয়া টি কোম্পানি এবং পরে কাজী এন্ড কাজী টি স্টেট সহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি স্টেট পর্যায়ে চা-চাষ শুরু করে।

বাড়ির সামনে ১৬ শতক সুপারি বাগানটিতে চা চাষ করেছেন পঞ্চগড় সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নের মহারাজাদিঘী এলাকার স্কুল শিক্ষক আনোয়ারুল ইসলাম। পাঁচ বছর বয়সী ওই চা বাগানটি থেকে প্রতি ৪০ দিন পর পর ২০০ কেজিরও বেশি চা পাতা সংগ্রহ করতে পারেন তিনি।

এভাবে বছরে সাত বার পাতা সংগ্রহ করা যায়। ওই সুপারি বাগান ছাড়া তিনি আরও ৭৩ শতক জমিতে চা চাষ করেছেন। মোট ৮৯ শতক জমিতে পাতা সংগ্রহের প্রতি রাউন্ডে ১৮০০ থেকে ২১০০ কেজি পাতায় ৩৬ হাজার থেকে ৪২ হাজার টাকা পর্যন্ত সবুজ চা পাতা বিক্রি করেন তিনি। তার মতো অনেকেই চা এভাবে চাষ করে লাভবান হচ্ছেন।

বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয় সুত্রে জানা যায়, পঞ্চগড় জেলায় এ পর্যন্ত ২ হাজার ২৬৫ হেক্টর জমিতে চা-চাষ সম্প্রসারণ হয়েছে। জেলায় এ পর্যন্ত স্টেট পর্যায়ে ৮টি (২০ একরের উপরে), ক্ষুদ্রায়তন (স্মল হোল্ডার) ১৫টি (৫ থেকে ২০ একর) এবং ২৮০ জন ক্ষুদ্র চা চাষী (শুন্য থেকে ৫ একর) পঞ্চগড় চা বোর্ড কর্তৃক নিবন্ধিত হয়েছে। তবে নিবন্ধনের বাইরে আরও প্রায় দুই হাজার ক্ষুদ্র পর্যায়ের চা বাগান গড়ে উঠেছে বিভিন্ন এলাকায়। শুধুমাত্র ২০১৭ সালেই ৪২০ দশমিক ২৩ হেক্টর জমি নতুন করে চা চাষের আওতায় এসেছে।

উত্তরবঙ্গে যে ২১ টি চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা নিবন্ধন  নিয়েছে তার মধ্যে শুধু পঞ্চগড় জেলায় ১২ টি কারখানা চালু রয়েছে। এই কারখানাগুলো চা-চাষীদের কাছ থেকে সবুজ চা পাতা কিনে তা থেকে চা তৈরি (মেড টি) করে। পঞ্চগড়ে উৎপাদিত এই চা দেশের একমাত্র চায়ের অকশন মার্কেট চট্রগ্রামে নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করেন চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানা মালিকরা। এছাড়া তারা ঋণ সহায়তা দিয়ে চাষিদের নতুন নতুন বাগান করতে আগ্রহী করে তুলছেন।

চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয় সুত্র আরো জানায়, মার্চ থেকে নভেম্বর মাস হলো চায়ের উৎপাদন মৌসূম। গত কয়েক বছর ধরে পর্যায়ক্রমে চায়ের উৎপাদন বাড়ছে। ২০১৪ সালে সবুজ চা পাতা (কাঁচা) উৎপাদন হয়েছে ৬৩ লক্ষ ২৭ হাজার ৪২৭ কেজি এবং তা থেকে তৈরি চা  (মেড টি) উৎপাদন হয়েছে ১৪ লক্ষ ২০ হাজার ৪৬৭ কেজি।

২০১৫ সালে সবুজ চা পাতা (কাঁচা) উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ১৮ লক্ষ ৬২ হাজার ২৬ কেজি এবং তা থেকে তৈরি চা (মেড টি) উৎপাদন হয়েছে ২৫ লক্ষ ২১ হাজার ৯২১ কেজি। ২০১৬ সালে সবুজ চা পাতা (কাঁচা) উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৪৫ লক্ষ ৭২ হাজার ৯৩৭ কেজি এবং তা থেকে তৈরি চা (মেড টি) উৎপাদন হয়েছে ৩২ লক্ষ ৬ হাজার ৪৬ কেজি।

র্সবশেষ ২০১৭ সালে সবুজ চা পাতা (কাঁচা) উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ৫১ লাখ ৫৬ হাজার ৮৬৯ কেজি এবং তা থেকে তৈরি চা  (মেড টি) উৎপাদন হয়েছে ৫৪ লাখ ৪৬ হাজার ৮১৪ কেজি। এবার ২০১৮ সালেও গত অর্থবছরের উৎপাদিত চায়ের পরিমানকে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন চা বোর্ড কর্তৃপক্ষ।

পঞ্চগড় সদর উপজেলার সোনাপাতিলা এলাকার চা চাষী মতিয়ার রহমান বলেন, এই চা-চাষে আমার পরিবার এবং আমার এলাকার চা শ্রমিকদের জীবন-যাত্রার মান উন্নয়ন হয়েছে। একসময় আমাদের সবুজ চা পাতা বিক্রি করতে কিছুটা সমস্যায় পড়তে হতো এখন সেটা নেই । এখন কারখানার লোকজন বাগান থেকেই পাতা নিয়ে যাচ্ছেন।

সদর উপজেলার মহারাজা দিঘী এলাকার চা চাষি আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, প্রথমদিকে চা কারখানা কম থাকায় আমাদের ক্ষুদ্র চাষিদের কিছুটা সমস্যা হয়েছিল। এখন কারখানার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আমাদের চাষিদের সুদিন ফিরে এসেছে। এখন কারখানারগুলোই আমাদের চা চাষের পরিধি বাড়ানোর জন্য নানা রকম সাহায্য সহযোগীতা করছে। আমাদের জন্য তারা সহজ শর্তে সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করছেন। আমি নিজেও মৈত্রি নামের একটি চা কারখানা থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি।

পঞ্চগড় নর্থবেঙ্গল সেন্ট্রাল টি কারখানার ব্যবস্থাপক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমরা চা চাষীদের কাছ থেকে প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতা ২৪ টাকা দরে ক্রয় করি। পরে আমাদের কারখানায় উৎপাদিত মেড টি চট্রগ্রাম অকশন মার্কেটে মান অনুযায়ী বিভিন্ন দামে বিক্রি হয়। সেখান থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডিং কোম্পানি তা ক্রয় করে তাদের নিজস্ব নামে সরবরাহ করে থাকে।

বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. মোহাম্মদ শামীম আল মামুন বলেন,  সমতল ভূমিতে চা চাষের জন্য পঞ্চগড় অত্যন্ত সম্ভানাময় এলাকা। চা চাষের উন্নয়নে আমরা নানা রকম পদক্ষে হাতে নিয়েছি। এর মধ্যে চা চাষিদের নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় মাসে চারটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমরা সব সময়ই চা চাষিদের বিটি সিরিজের (বাংলাদেশী প্রযুক্তির) ক্লোন বা চায়ের চারা রোপনের জন্য উদ্ধুদ্ধ করি এতে চাষীদের উৎপাদন আরও ভালো হবে।

তিনি আরও বলেন, উত্তরবঙ্গের চা বাগান ও ক্ষুদ্র চা চাষিদের বিজ্ঞানসম্মত কারিগরি ও প্রযুক্তি সেবা নিশ্চিতকরণ এবং চায়ের পেষ্ট ব্যবস্থাপনা বিষয়ক গবেষণা আরও বেগবান করার লক্ষে পঞ্চগড়স্থ বিটিআরআই উপকেন্দ্রে একটি আধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ পেষ্ট ম্যানেজম্যান্ট ও ফিল্ড ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে।

এতে চা বাগান ও ক্ষুদ্র চা চাষিরা তাদের পোকামাকড় ও রোগবালাই সংক্রন্ত সমস্যা হাতের কাছেই উপকেন্দ্র থেকে সমাধান করতে পারবেন।