মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী: গাছে গাছে ঠিকরে পড়ছে সোনালী মুকুল। আম গাছগুলো যেন তাদের উঠতি যৌবন লুকিয়ে রাখতে পারছে না। কান্ডের শীর্ষ ছাড়াও ডাল ফেটে বের হয়েছে তারা। সময়ের সাথে পরিপক্ক হয়ে এই মুকুলই যে চাষিদের সবকিছু নির্ভর করবে। তাই শিশু মুকুলের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন বুনছেন রাজশাহীর চাষিরা।

গাছে মুকুল আসার আগ থেকেই পরিচর্যা শুরু হয় রাজশাহীর আম চাষিদের। মুকুলের পর সবুজ গুটিগুলো যেন আম চাষির অন্যতম ভরসার জায়গা দখল করে। গুটি যত বড় হয় ততই বাড়ে চাষির মনের আনন্দ। চলতি বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ভালো ফলনের আশা করছেন তারা।

কৃষকরা বলছেন, কৃষি বিভাগের পরামর্শে বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। আশা করছেন বড় কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে আমের বাম্পার ফলন হবে। গাছে গুটি আসার আগে থেকেই গাছগুলোর পরিচর্যা এবং পরামর্শ অনুযায়ী মুকুল আসার পর থেকে বিভিন্ন রোগবালাই দমনের ব্যবস্থা করতে হয়।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে রাজশাহী জেলায় আম চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমি। এরআগে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৭ হাজার ৫৭৩ হেক্টর জমি। বেড়েছে ৩৭৩ হেক্টর জমি। গত তিন বছরের তুলনায় এবার বেড়েছে আম চাষের লক্ষ্যমাত্রা। জেলায় চলতি মৌসুমে ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে আমের বাগান রয়েছে। প্রতি হেক্টরে ১২ মেট্রিক টন ফলন হয়। অর্থাৎ ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে ২ লাখ ১৬ হাজার মেট্রিক টন আম। আর গতবারের ফলনই চলতি মৌসুমের লক্ষ্যমাত্রা।

সেই হিসাবে রাজশাহীতে এবার ২ লাখ ১৬ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন ফলন ভাল হলে এ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। এখন পর্যন্ত আমের ফলনের জন্য আবহাওয়া অনুকূলে রয়েছে। এবার রাজশাহীতে ৮০০ কোটি টাকার আমের ব্যবসা হবে বলে আশা করছেন কৃষি বিভাগ।

সেইসাথে চাষীদের প্রয়োজনমতো পরামর্শ প্রদান করছেন কৃষি বিভাগ। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা উম্মে ছালমা বলেন, ‘এবার আবহাওয়া ভালো আছে। কিছুদিন আগে হাল্কা বৃষ্টি হয়েছে। কিছু ফসলের ক্ষতি হলেও আমের বেশ ভালো হয়েছে। অন্যান্য বছরের মতো এবারও আমরা নিয়মিত চাষীদের পরামর্শ দিয়ে পাশে থাকছি। রাজশাহীর কৃষক আম চাষে অভ্যস্ত। তারা পোকা বা ছত্রাকজনিত বিভিন্ন সমস্যায় বালাইনাশক প্রয়োগ করে এবং করছে। সামনে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে আমের বাম্পার ফলনের আশা করা হচ্ছে।’

আম চাষের পরামর্শ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রিভেন্টিভ হিসেবে ডিসেম্বর মাসে (মুকুলের রস চুষে খাওয়া) হপার পোকার জন্য ইমিটাক্লোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক ব্যবহার করতে বলা হয়। মুকুল বের হওয়ার আগে বা গুটি মটর দানার মতো হলে ম্যানকোজেব এবং মুকুল যদি কালো হয়ে আসে বা দাগ দেখা যায় তাহলে ট্রুপার জাতীয় বালাইনাশক ব্যবহার করতে পরামর্শ দেওয়া হয়। সবকিছু মিলিয়ে বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে।

রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় আড়াইশ জাতের আম উৎপন্ন হয়। এগুলোর মধ্যে এ বছর ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ক্ষিরসাপাতি, বোম্বাই, হিমসাগর, ফজলি, আম্রপালি, আশ্বিনা, বৃন্দাবনী, লক্ষণভোগ, কালীভোগ, তোতাপরী, দুধসর, লখনা ও মোহনভোগ জাতের আমের চাষ বেশি হয়েছে।

রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলীম উদ্দীন জানান, চলতি মৌসুমে আমের মুকুল বেশি হয়েছে। সাধারণত আমগাছে মুকুল আসার পর হপার পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। সে ক্ষেত্রে নিয়মানুযায়ী পোকা মারা কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহার করেছেন চাষীরা। ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাক নাশক এবং ইমিটাক্লোপিড জাতীয় কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে (ম্যানকোজেব ২ গ্রাম ও ০.৫ মিলি ইমিটাক্লোপিড) তিন বার স্প্রে করার পরামর্শ দেওয়া হয়। একবার মুকুল আসার আগে, মুকুল ফোটার আগে এবং আম মটর দানার মতো হলে। রাজশাহীর আম চাষীরা আগে থেকেই যেহেতু অভিজ্ঞ সেহেতু তারা খুব সহযেই আমের যত্ন নিতে পারেন বলে জানান এই কর্মকর্তা।

রাজশাহীর সবকটি উপজেলায়ই আম চাষ হয়। ৯টি উপজেলার বাঘায় সবচেয়ে বেশি আম চাষ হয়। এখন আমের বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন আম চাষীরা। বাঘার পাকুড়িয়া এলাকার চাষী আরমান হোসেন জানান, ‘এ বছর আমের বাগানে একটু কম মুুকুল মনে হচ্ছে। যারা বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ করে তাদের বাগানে ভালো মুকুল আছে। গেরস্ত চাষিরা টিএসপি সার কিনতে পারেনি। গাছের পরিচর্যা কম থাকায় মুকুল কম। ফলন কম হবে। সামনে আবার কালবৈশাখী ঝড় আছে। ঝড়ের পর আসলে বোঝা যাবে কি হবে।

পবা উপজেলার আম ব্যবসায়ী ও আম চাষী মোর্তজা আহম্মেদ জানান, ‘আমি প্রতিবছরই আম চাষ করি। এবারও আশা করি ভালো ফলন হবে। আমরা চাষীরা মুকুল আসার আগে থেকেই গাছের পরিচর্যা করছি। তবে, ১৫’শ টাকা টিএসপি সার এবার ২৭-২৮’শ টাকা বস্তা কিনতে হয়েছে। এজন্য অনেকে আম বাগানের পরিচর্যা ঠিকমতো করতে পারেন নি।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ