নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা: বৈশ্বিকভাবে জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় সংরক্ষিত বনের লক্ষ্যমাত্রা ৩০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বে সংরক্ষিত বনের হার ১৭ শতাংশ। আর বাংলাদেশে সংরক্ষিত বনের হার ১২ শতাংশ। প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে আন্ত:সম্পর্কের মাধ্যমে কাজ করলে বাংলাদেশে সংরক্ষিত বনের বৈশ্বিক এই ৩০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা দ্রুত অর্জন সম্ভব। এ পদ্ধতিটি সবচেয়ে টেকসই ও যুগযোপোগী।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারপারসন অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর এসব তথ্য জানিয়েছেন।

শনিবার (২৮ অক্টোবর) রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে আয়োজিত ‘‌দি ইমপ্লিমেনটেশন অ্যান্ড মনিটরিং অব দ্য কুনমিং-মন্ট্রিল গ্লোবাল বায়োডাইভার্সিটি ফ্রেমওয়ার্ক: কমিউনিটি বেসড সলিউশন অ্যান্ড কন্ট্রিবিউশনস টু দ্য গ্লোবাল বায়োডাইভার্সিটি টার্গেটস’ শীর্ষক এক কর্মশালায় তিনি এ তথ্য তুলে ধরে। সুইডবায়ো, বন অধিদপ্তর, ফরেস্ট পিপল প্রোগ্রাম (এফপিপি) ও উন্নয়ন অন্বেষণের যৌথ উদ্যোগে এ কর্মশালার আয়োজন করা হয়।

তিন সেশনে অনুষ্ঠিত এ কর্মশালায় উদ্বোধনী সেশনে স্বাগত বক্তব্য দেন অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। তিনি সুন্দরবনের বর্তমান পরিস্থিতির ওপর তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেন। চার কৌশলের মাধ্যমে সংরক্ষিত বনের লক্ষ্যমাত্রা পূরুণ সম্ভব বলে জানান তিনি।

অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, বর্তমান যে প্রক্রিয়ায় সংরক্ষিত বনের কাজ হচ্ছে সেই প্রক্রিয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হয় নি। কারণ পদ্ধতিটি খুব বেশি কাজে লাগে নি। আমরা কাজ করে দেখেছি যে, দেশের বন সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা পূরুণ করতে হলে বর্তমান পদ্ধতির পরিবর্তন করতে হবে। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির আত্ম সম্পর্কের মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে সংরক্ষিত বনের লক্ষ্যমাত্রা পূরুণ করা সম্ভব। যেটা আমাদের ফ্রেমওয়ার্কে দেখিয়েছি। যাকে আমরা বলছি হিউম্যান নেচার সোস্যালিটি অর্ক। এটাই হচ্ছে মূল জিনিস।

দ্বিতীয় নম্বর কৌশলের অংশ হিসেবে লোকজ ও ঐতিহ্যগত জ্ঞান ব্যবহারের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে কমিউনিটি এরিয়ার দিকে যেতে হবে।

তিন নম্বর বার্তা হচ্ছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তিনটা বড় রকমের সংকট আছে। এর মধ্যে রয়েছে জীবন যাত্রার ব্যয় নির্বাহের সংকট, জীববৈচিত্রের ক্রমাগত হ্রাস ও জলবায়ুগত সংকট। এই তিন সংকট মোকাবেলায় ম্যানগ্রোভ অর্থাৎ শ্বাসমূল বন বড় রকমের ভূমিকা রাখতে পারে। এবং সুন্দরবন হচ্ছে পৃথিবীর বড় শ্বাসমূল বন। ইতিমধ্যেই আমরা চকোরিয়ার সুন্দরবন হারিয়েছি। তাই আমাদের বসে থাকার সুযোগ নাই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা বেড়ে গেছে। এছাড়া প্রাকৃতিক দূর্যোগও বেড়ে যাচ্ছে। তাই আমাদের শ্বাসমূল বন অর্থাৎ সুন্দরবনকে রক্ষায় ভালো পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।

চার নম্বর হলো, বিজ্ঞান এবং লৌকিক জ্ঞান ব্যবহার করা। বিজ্ঞানটা হবে শ্বাসমূল বিজ্ঞান। আর লৌকিক জ্ঞান হচ্ছে কীভাবে আপনি সংরক্ষণ করবেন। এই দুইটার মাধ্যমে সম্বনয় করে সংরক্ষিত বনের লক্ষ্য মাত্রায় পৌঁছানো যাবে।

অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, আমরা মাঠে কাজ করে দেখেয়েছি কীভাবে এসব কৌশল অবলম্বন করে সংরক্ষিত বনের কাজ করা যায়। আমরা একটা নতুন সলিডারিটির মডেল তৈরি করেছি। একটি মডেল স্থানীয় গোষ্ঠীদের নিয়ে কয়রায় আরেকটি আদিবাসীদের নিয়ে করেছি। এসব মডেলে তারা দেখিয়েছে কীভাবে বনভূমি পুনরায় স্থাপন করা যায়। কীভাবে লৌকিক জ্ঞানের মাধ্যমে মাছ ও মধু সংরক্ষণ করা যায়।

সবমিলিয়ে আমরা দেখেছি প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে আন্ত:সম্পর্কের মাধ্যমে বৈশ্বিক সংরক্ষিত বনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব। এ মাধ্যমটি ব্যবহারে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। আমরা এসব নিয়েই কাজ করছি। আমরা স্থানীয় নারী, যুবক, আদিবাসীদের পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে লোকদের নিয়ে কাজ করছি।

কর্মশালায় কি নোট উপস্থাপন করেন এফপিপির সিনিয়র পলিসি উপদেষ্টা ড. মাওরিজিও ফারহান ফেরারি। বন সংরক্ষণের নানা উদ্যোগ তুলে ধরে বক্তব্য দেন প্রধান বনসংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী। আলোচনা শেষে সুন্দরবনের ওপর একটি আলোকচিত্র প্রদর্শন করা হয়। দ্বিতীয় সেশনে বক্তব্য দেন এফপিপির গ্লোবাল পার্টনারশিপ কো-অর্ডিনেটর ক্যারেলিন ডি ঝং এবং বন বিভাগের উপপ্রধান বনসংরক্ষক মো. জাহিদুল কবির। এ সেশনের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা তাদের আঞ্চলিক অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সঞ্জয় কুমার ভৌমিক বলেন, ‘‌আমরা জাতীয় জীববৈচিত্র্য অভিযোজন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। এ নিয়ে সব মানুষ চিন্তিত। বিশেষ করে ক্ষুদ্র নৃতাত্বিক গোষ্ঠীর সদস্যরা প্রকৃতিনির্ভর সমাধান পেতে চান।’

প্রসঙ্গত, গত বছর মন্ট্রিয়লে কপ-১৫ সম্মেলনে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সবাই মতৈক্যে পৌঁছেছে। কুনমিং-মন্ট্রিয়েল গ্লোবাল বায়োডাইভার্সিটি ফ্রেমওয়ার্ক পাসের পর জাতিসংঘ-সমর্থিত কপ-১৫ নেতারা হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানান। বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্য ফ্রেমওয়ার্ক ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর এক–তৃতীয়াংশ রক্ষায় সবাই সম্মত হন। এতে ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ ভূমি ও জলভাগ সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্তও চূড়ান্ত করা হয়। বর্তমানে যা ১৭ শতাংশ ভূমি ও ১০ শতাংশ সামুদ্রিক অঞ্চল সুরক্ষিত।

অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ‘‌সুন্দরবনের জলাধার কমেছে। ২০১০ সালে যেখানে ছিল ৪৪৮ হেক্টর, ২০২০ সালে তা ৩২২ হেক্টরে এসে দাঁড়িয়েছে। কাঁকড়া বিচরণস্থল ৩ হাজার ১১৫ হেক্টরে থেকে কমে ১ হাজার ৬৩৪ হেক্টরে এসে নেমে এসেছে। তিনি আরো বলেন, ‘‌সুপার সাইক্লোন সিডরের আঘাতে সুন্দরবনের ১০ শতাংশ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে।’

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, ‌সুন্দরবনের আয়তন কমার পাশাপাশি কমছে মৎস্যসম্পদও। সুন্দরবনকে বাঁচাতে হলে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে সমাধান খুঁজতে হবে। সুন্দরবনে পরিকল্পিতভাবে গোলপাতার গাছ রোপণ করে এটাকে বাড়তে দিতে হবে। এখানকার জেলেরা যেন নিয়ম মেনে মাছ ধরেন সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। সব ধরনের মাছ ধরা যাবে না। যে মাছগুলো বিপন্ন সেগুলো ধরা থেকে জেলেদের বিরত রাখতে হবে। আর জেলেদের জালের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নিয়ম মেনে চলতে হবে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ/২০২৩