ফসল ডেস্ক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার দাউনিয়াফাদ গ্রামে প্রথম চাষ হয় অত্যন্ত উচ্চমানের সুগন্ধি ধানের জাত তুলসীমালা। এই ধানের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য ধানের ফুল আসার পর থেকে পাকা পর্যন্ত পাঁচ বার রং পালটায়।

স্থানীয় প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় এ ধান শখের বশে অতিথি আপ্যায়নে চাষ করে থাকেন ময়মনসিংহ বিভাগের শেরপুর জেলা ও আশপাশের কিছু এলাকায় চাষিরা।

ধানের গুনগত মানের কারণে গত আমন মৌসুমে প্রথম চাষ হয় পদ্মার এপার ২০টি জেলার মধ্যে। এই জাতটি গত আমন মৌসুমে প্রথম চাষ হয় বটিয়াঘাটার দাউনিয়াফাদ গ্রামে। পাশের গুপ্তমারী গ্রামের রণজিৎ মণ্ডল পাঁচ শতক জমিতে এই ধান চাষ করেন।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক এস এম আতিয়ার রহমান শখের বশে শেরপুর থেকে এই ধানের মাত্র দুই কেজি বীজ সংগ্রহ করে ঐ কৃষককে দেন এবং চাষ তত্ত্বাবধান করেন।

এই ধান চাষ বিষয়ে তিনি বলেন, এই ধানটি লবণাক্ত উপকূলীয় এলাকায় হবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল। কিন্তু বাস্তবে ভালো হয়েছে। তুলসীমালা এতটাই ছোট আকারের এবং রং পাকলে ধানের ছড়া দেখে সত্যিই মনে হয় তুলসীর কাঠ দিয়ে গাঁথা মালার মতো।

তিনি জানান, এই ধানের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য ধানের ফুল আসার পর থেকে পাকা পর্যন্ত পাঁচ বার রং পালটায়। প্রথমে হালকা সবুজাভ, এরপর কিছুটা ছাইরঙা, এরপর হালকা জাম রং, এরপর গাড় জাম রং এবং শেষে কালো ও ছাই রং মিলিয়ে নতুন একটি রং ধারণ করে। ধানের গাছের উচ্চতা ৫০-৫২ ইঞ্চির মতো। ধানের আয়ুষ্কাল ১১০-১২০ দিন। একটি শিষে ৯০-১২০টি ধান পাওয়া যায়। পাঁচ শতক জমিতে দেড় মণ ধান পাওয়া গেছে। সে হিসেবে একর প্রতি ৩০ মণ ধানের ফলন হয়েছে। সবটুকু ধানই বীজ হিসেবে আগামী আমন মৌসুমে লাগানোর জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে।

তুলশীমালা ধান দেখে অনেকেই চাষ করতে বীজের চাহিদা জানিয়েছেন। অত্যন্ত প্রাচীন জাতের স্থানীয় জলবায়ু সহিষ্ণু এই ধানের চাল অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। এছাড়াও মূল্যবান ভিটামিন ও মিনারেলসহ অন্যান্য গুণ রয়েছে। বাজারে তুলসীমালা ধানের চাল খুব কম পাওয়া যায়। তবে ঢাকা-ময়মনসিংহ বিভাগে পাওয়া যায় বেশি। প্রতি কেজি চাল ১২০-১৪০ টাকা দরে বিক্রি হয়। তুলসীমালা ধানের চালই দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হয়।

কৃষি বিভাগের তথ্য অনুসারে, দেশে মাত্র ২০-২৫ হাজার হেক্টর জমিতে এই ধান চাষ হয়। এর শতকরা ৫০ ভাগই আবাদ হয় শেরপুর জেলায়। উচ্চফলনশীল না হলেও এই ধানের চালের কদর এখনো বেশি। সুগন্ধি কালোজিরা ধানের চালের চেয়েও আকারে ছোট সুগন্ধি তুলসীমালা ধানের চালের যে কোনো পদের খাবার অত্যন্ত সুস্বাদু হয়। ধান, ধানের খড় থেকে শুরু করে মাঠময় সুগন্ধ ছড়ায়।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. মো. মনিরুল ইসলাম তার ল্যাবে এই ধান নিয়ে অধিকতর গবেষণা করে চালের কিছু বৈশিষ্ট্য অন্য কোনো জাতে প্রবেশ করানো যায় কি না, সে ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন।

রাজশাহীতে বোরো ধানে হিটশকে কপাল পুড়েছে কৃষকের

অতিরিক্ত গরমে মানুষ যেমন হিটস্ট্রোক করে ঠিক তেমনি তীব্র তাপমাত্রায় ধানগাছ শুকিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াকে হিটশক বলে। রাজশাহী অঞ্চলে মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া শুস্ক বাতাস ও ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে তাপমাত্রায় হিটশকে কপাল পুড়ছে কৃষকের।

দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়া ও তীব্র আবহাওয়ায় শুকিয়ে যাচ্ছে ধানগাছ। কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট এ পরিস্থিতিকে নতুন চ্যালেঞ্জ বলে দেখছেন ধান গবেষকরা।

কৃষকদের নতুন আতঙ্ক এই হিটশক! ধানের শীষগুলো সাদা হয়ে মারা যাচ্ছে। গত রোববার (৪ এপ্রিল) কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকা এবং নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, কুষ্টিয়া ও ময়মনসিংহ জেলাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছে হিটশকে। এ থেকে বাদ পড়েনি রাজশাহী অঞ্চল।

গত বুধবার (৭ এপ্রিল ২০২১) রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট আঞ্চলিক শাখা থেকে বিজ্ঞানীরা জেলার পবা উপজেলার আলিমগঞ্জ ও কসবা এলাকা পরিদর্শন করেছেন। এই দলে ছিলেন কৃষি বিভাগের প্রধান ডা. আউয়াল, ব্রি আঞ্চলিক কার্যালয়ের পিএসও ও প্রধান ড. মো. ফজলুল ইসলাম, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মনিরুজ্জামান, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. তাহমিদ হোসেন আনছারী ও ড. কাজী শিরিন আক্তার জাহান এবং উদ্ভিদ কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোসাদ্দেক হোসেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, রাজশাহীতে মোট ৬৬ হাজার হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ করা হয়েছে। গত ৪ তারিখে বৃষ্টি ও আদ্রতাহীন শুস্ক ঝড়ে দশমিক শূন্য ৪ হেক্টর জমি বোরো ধান আক্রান্ত হয়েছে বলে এখন পর্যন্ত জানা গেছে। যার পরিমাণ দাঁড়ায় ২৮ হেক্টর জমি। হেক্টর প্রতি ৬ মেট্রিকটন ধান হিসেবে ১৬৮ মেট্রিকটন ধানের ক্ষতিসাধন হয়েছে। এছাড়াও এ ক্ষতির পরিমাণ সামান্য বাড়তে বলে প্রাথমিক আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ব্রি রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান ড. মো. ফজলুল ইসলাম বলেন, এবারে বৃষ্টি নেই অনেকদিন। আবহাওয়া অত্যন্ত রুক্ষ। ৪ এপ্রিল সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টি ছাড়াই ঝড় শুরু হয়। সেদিন বাতাস ছিল অতিরিক্ত গরম। আদ্রতা ছিল শুন্যের কোটায়। ফলে ঐদিন যেসব ধানের শীষ বের হয়েছিল সেগুলোর ফুল ঝরে যায়। বাতাসের গতির সাথে আর্দ্রতার মিল না থাকায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গরম অনুভব হয়েছে। ডিহাইড্রেশন প্রক্রিয়ায় সদ্য ফোটা শীষ থেকে পানি বের হয়ে গিয়ে শীষ শুকিয়ে গেছে। তবে, বৃষ্টি হলে এমনটি হতো না। রাজশাহীতে ক্ষতির পরিমাণটা কম হয়েছে। হাওর অঞ্চলে হিটশকের প্রভাব পড়েছে বেশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. তাহমিদ হোসেন আনছারী বলেন, তাপমাত্রা বাড়লে কিংবা কমলে হিটশক বা হিট ইনজুরি হয়ে থাকে। দুটো কারণেই হতে পারে। গত ৪ তারিখে যে গরম বাতাসের ঝড়ে ধানের ক্ষতিসাধন হয়েছে। ধানে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা হলে হিটশক হয়। হিটশকে মারাত্মক ক্ষতি হয় ধানের ফ্লাওয়ারিং স্টেজে (ফলনের প্রাথমিক পর্যায়)। একদিন আগে কিংবা ঐদিন যেসব ধান পরাগায়ন হচ্ছিল সেই ধানের শিষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরাগায়ন করতে পারেনি এবং ফ্লাওয়ারিং স্টেজ চলার কারণে ওইসব ধানের শীষ থেকে পানি বেরিয়ে গেছে। সেইসাথে বৃষ্টি না হওয়ায়, পরের দিন রোদ উঠার পর শিষগুলো সাদা আকার ধারণ করে শুকিয়ে যায়।

কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের এটি একটি নতুন চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন এই বিজ্ঞানী। তিনি আরোও বলেন, ঝড়ের দিন ফুল ফোটা অবস্থায় থাকা জমির ৫-১০% ধান প্রথমে সাদা ও পরবর্তীতে কালো বর্ণ ধারণ করে চিটা হয়ে গেছে। তাছাড়া ঝড়ের কারণ পাতায় পাতায় ঘর্ষণে পাতা ফেটে গিয়ে ক্ষতস্থান দিয়ে ব্যকটেরিয়া প্রবেশ করে বিএলবি বা পাতাপোড়া রোগ সৃষ্টি হয়েছে। পাতার অগ্রভাগ ও কিনারা পুড়ে যাওয়ার মতো খড় বর্ণ ধারণ করেছে।

ধানের হিটশক বা তীব্র তাপমাত্রায় চাষিদের করণীয় বিষয়ে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট জানায়, ধানের দানা শক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত জমিতে ২-৩ ইঞ্চি পানি দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে। ধানের অগ্রভাগ বা পাতাপোড়া রোগ দেখা দিলে প্রতি ৫ শতাংশ জমিতে থিওভিট ও এমওপি ৬০ গ্রাম, ২০ গ্রাম দস্তা বা জিঙ্ক ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। সেইসাথে প্রতি বিঘা জমিতে ৫ কেজি পটাশ দিলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। ধানে ব্লাস্ট রোগ দেখা দিলে ট্রাইসাক্লাজল গ্রুপের ছত্রাকনাশক প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭-১০ দিন স্প্রে করলে ধানের ব্লাস্ট প্রতিরোধ করা যায়।

রাজশাহী অঞ্চলে চাষিদের পানি স্বল্পতার কারণে ধানে হিটশক হতে পারে কিনা জানতে চাইলে ইনস্টিটিউটের সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মনিরুজ্জামান বলেন, রাজশাহী অঞ্চলের ধান চাষিদের কোন সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ধানের ফ্লাওয়ারিং স্টেজ আসার আগে এবং এর পরবর্তী ১০-১২ দিন জমিতে ২-৩ ইঞ্চি পানি রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এখানকার কৃষকরা সেই মোতাবেক ধান চাষ করে আসছেন। গত ৪ তারিখে যা হয়েছে তা হটাৎ, প্রকৃতিক। যাদের সেচ দেওয়ার পরিস্থিতি বা সুযোগ আছে তারা দিবে। আর যাদের সেই সুযোগ নেই সেটা আলাদা ব্যাপার।

আবহাওয়া অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ৪ এপ্রিল বিকেল ৪ টার পর থেকে হঠাৎ গরম বাতাস শুরু হয়।তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপর ছিল। এছাড়াও গত দু-সপ্তাহ ধরে প্রায়ই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে রাজশাহীতে। যা ৩৫-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠানামা করেছে। ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং আর্দ্রতা না থাকায় ধানে ক্ষতি হয়েছে।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, এটা একটি নতুন সমস্যা। তবে আগেও হয়েছে। কিন্তু বড় ক্ষতি আগে হয়নি। দেশে এ বছর প্রচুর বোরো ধান হয়েছে। এ ক্ষতি সার্বিক উৎপাদনে কোনো প্রভাব পড়বে না।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ডা. আউয়াল বলেন, জেলায় এবার ৬৬ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। ৪ এপ্রিল ঘন্টাব্যাপী বৃষ্টিহীন ঝড়ো বাতাস প্রবাহিত হয়েছে। তাপমাত্রা বেশি হওয়ায় ও বাতাসে আর্দ্রতা না থাকায় বোরো ধানের ক্ষেতের শীষ মরে গেছে। জলীয় বাস্প কম থাকলে আমরা যে তাপমাত্রা পরিমাপ করি না কেন, এর চেয়ে অনুভব তাপমাত্রা অনেক বেশি হবে। তখন মনে হয় গায়ে লু-হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। সেদিনই মূলত এ ব্যাপারটা হয়েছিল। এখন পর্যন্ত দশমিক শূন্য ৪ হেক্টর জমি বোরো ধান আক্রান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। যার পরিমাণ ২৮ হেক্টর জমি। হেক্টর প্রতি ৬ মেট্রিকটন ধান হিসেবে ১৬৮ মেট্রিকটন ধানের ক্ষতিসাধন হয়েছে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ