চলতি মাসের কৃষি ডেস্ক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: সবাইকে নবান্নের শুভেচ্ছা। নবান্নের উৎসবের সাথে সমান্তরালে উৎসবমুখর থাকে বৃহত্তর কৃষি ভুবন। এ মৌসুমটাই কৃষির জন্য তুলনামুলকভাবে নিশ্চিত একটি মৌসুম। অগ্রহায়ণ মাসে ফসল, প্রাণি ও মৎস্যে সফলতা পেতে যা করতে হবে তা নিচে তুলে ধরা হলো।

আমন ধান: এ মাসে অনেকের আমন ধান পেকে যাবে তাই রোদেলা দিন দেখে ধান কাটতে হবে। ঘূর্ণিঝড় প্রবন এলাকায় আমন ধান শতকরা ৮০ ভাগ পাকলে কেটে ফেলতে হবে।

আমন ধান কাটার পরপরই জমি চাষ দিয়ে রাখতে হবে, এতে বাস্পীভবনের মাধ্যমে মাটির রস কম শুকাবে। উপকূলীয় এলাকায় রোপা আমন কাটার আগে রিলে ফসল হিসেবে খেসারি আবাদ করা যায়।

আগামী মৌসুমের জন্য বীজ রাখতে চাইলে প্রথমেই সুস্থ্য সবল ভালো ফলন দেখে ফসল নির্বাচন করতে হবে। এরপর কেটে, মাড়াই-ঝাড়াই করার পর রোদে ভালমত শুকাতে হবে। শুকানো গরম ধান আবার ঝেড়ে পরিস্কার করতে হবে এবং ছায়ায় রেখে ঠান্ডা করতে হবে।

পরিস্কার ঠান্ডা ধান বায়ু রোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ রাখার পাত্র টিকে মাটি বা মেঝের উপর না রেখে পাটাতনের উপর রাখতে হবে। পোকার উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে হলে ধানের সাথে নিম, নিসিন্দা, ল্যান্টানার পাতা শুকিয়ে গুড়ো করে মিশিয়ে দিতে হবে।

বোরো ধান: আগ্রহায়ণ মাস বোরো ধানের বীজতলা তৈরির উপযুক্ত সময়। রোদ পড়ে এমন উর্বর ও সেচ সুবিধাযুক্ত জমি বীজতলার জন্য নির্বাচন করতে হবে।

চাষের আগে প্রতি বর্গমিটার জায়গার জন্য ২-৩ কেজি জৈব সার দিয়ে ভালোভাবে জমি তৈরি করতে হবে। পানি দিয়ে জমি থকথকে কাদা করে এক মিটার চওড়া এবং জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে লম্বা করে ভেজা বীজতলা তৈরি করতে হবে।

যেসব এলাকায় ঠান্ডার প্রকোপ বেশি সেখানে শুকনো বীজতলা তৈরি করতে পারেন। প্রতি দুই প্লটের মাঝে ২৫-৩০ সেমি. নালা রাখতে হবে।

যেসব এলাকায় সেচের পানির ঘাটতি থাকে সেখানে আগাম জাত হিসেবে ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৪৫ এবং ব্রি ধান৫৫, উর্বর জমি ও পানি ঘাটতি নাই এমন এলাকায় ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫০, ব্রি ধান৫৮, ব্রি ধান৫৯, ব্রি ধান৬০, ব্রি হাইব্রিড ধান১, ব্রি হাইব্রিড ধান২ ও ব্রি হাইব্রিড ধান৩, ঠান্ডা প্রকোপ এলাকায় ব্রি ধান৩৬, হাওড় এলাকায় বিআর১৭, বিআর১৮, বিআর১৯, লবণাক্ত এলাকায় ব্রি ধান৪৭, ব্রি ধান৫৫, ব্রি ধান৬১ চাষ করতে পারেন।

বীজ বপন করার আগে ৬০-৭০ ঘন্টা জাগ দিয়ে রাখতে হবে। এসময় ধানের অঙ্কুর গজাবে। অঙ্কুরিত বীজ বীজতলায় ছিটিয়ে বপন করতে হবে। প্রতি বর্গমিটার বীজ তলার জন্য ৮০-১০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।

গম: অগ্রহয়ণের শুরু থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ পর্যন্ত গম বোনার উপযুক্ত সময়। এরপর গম যত দেরিতে বপন করা হবে ফলনও সে হারে কমে যাবে।

দো-আঁশ মাটিতে গম ভাল হয়। অধিক ফলনের জন্য গমের আধুনিত জাত যেমন- শতাব্দী, সুফী, বিজয়, প্রদীপ, আনন্দ, বরকত, কাঞ্চন, সৌরভ, গৌরব, বারি গম-২৫, বারি গম-২৬ এসব বপন করতে হবে।

বীজ বপনের আগে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক দ্বারা বীজ শোধন করে নিতে হবে। সেচযুক্ত চাষের জন্য বিঘাপ্রতি ১৬ কেজি এবং সেচবিহীন চাষের জন্য বিঘা প্রতি ১৩ কেজি বীজ বপন করতে হবে।

গমের ভাল ফলন পেতে হলে প্রতি শতক জমিতে ৩০-৪০ কেজি জৈব সার, ৬০০-৭০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৬০০-৭০০ গ্রাম টিএসপি, ৩০০-৪০০ গ্রাম এমওপি, ৪০০-৫০০ গ্রাম জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে।

ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার জমি তৈরীর শেষ চাষের সময় এবং ইউরিয়া তিন কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে।

গমে তিনবার সেচ দিলে ফলন বেশি পাওয়া যায়। বীজ বপনের ১৭-২১ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ , ৪৫-৬০ দিনে দ্বিতীয় সেচ এবং ৭৫-৮০ দিনে ৩য় সেচ দিতে হবে।

ভুট্টা: ভুট্টা গত মাসে আবাদ না করে থাকলে এ মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে জমি তৈরি করে বীজ বপন করতে হবে। ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো বারি ভুট্টা-৬, বারি ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৬, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৮, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৯, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১০, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১১ এসব।

এক হেক্টর জমিতে বীজ বপনের জন্য ২৫-৩০ কেজি ভুট্টা বীজের প্রয়োজন হয়। তবে খই ভুট্টা বা হাইব্রিডের ক্ষেত্রে বীজের মাত্রা এর অর্ধেক হবে।

ভাল ফলনের জন্য সারিতে বীজ বপর করতে হবে। এক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৭৫ সেমি এবং বীজ থেকে বীজের দূরত্ব ২৫ সেমি রাখতে হবে।

মাটি পরীক্ষা করে জমিতে সার প্রয়োগ করলে কম খরচে ভাল ফলন পাওয়া যায়। তবে সাধারণভাবে প্রতি শতাংশ জমিতে ইউরিয়া ১-১.৫ কেজি, টিএসপি ৭০০-৯০০ গ্রাম, এমওপি ৪০০-৬০০ গ্রাম, জিপসাম ৬০০-৭০০ গ্রাম, দস্তা ৪০-৬০ গ্রাম, বরিক এসিড ২০-৩০ গ্রাম এবং ১৬-২০ কেজি জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।

সরিষা অন্যান্য তেল ফসল: তেল ফসলের মধ্যে সরিষা অন্যতম। তাছাড়া রয়েছে তিল, তিসি, সূর্যমুখী এসব আবাদ করতে পারেন।

সরিষা গাছের বয়স ২০-২৫ দিন হলে শতাংশপ্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। উপরি সার প্রয়োগের পর হালকা একটি সেচ দিতে হবে। মাটিতে রস কমে গেলে ২০-২৫ দিন পর আবারো একটি সেচ দিতে হবে।

আলু: উপকূলীয় অঞ্চলে এ মাসেও আলু আবাদ শুরু করা যায়। অন্যান্য স্থানে রোপণকৃত আলু ফসলের যত্ন নিতে হবে।

মাটির কেইল বেঁধে দিতে হবে এবং কেইলে মাটি তুলে দিতে হবে। সারের উপরি প্রয়োগসহ প্রয়োজনীয় সেচ দিয়ে আগাছা পরিস্কার করতে হবে।

ডাল ফসল: ডাল আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। মাঠে এখন মসুর, মুগ, মাষ, মটর, খেসারি, ছোলা, ফেলন, সয়াবিন প্রভৃতি ডাল ফসল আছে।

সারের উপরিপ্রয়োগ, প্রয়োজনে সেচ, আগাছা পরিস্কার, বালাই ব্যবস্থাপনাসহ সবকটি পরিচর্যা সময়মত যথাযথভাবে করতে পারলে কাংখিত ফলন পাওয়া যাবে।

শাকসবজি: মাঠে এখন অনেক সবজি বাড়ন্ত পর্যায়ে আছে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, মুলা এ সব বড় হওয়ার সাথে সাথে চারার গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে।

চারার বয়স ২-৩ সপ্তাহ হলে সারের উপরি প্রয়োগ করতে হবে। সবজি ক্ষেতের আগাছা, রোগ ও পোকা-মাকড় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ ব্যবহার করতে পারেন। এতে পোকা দমনের সাথে সাথে পরিবেশও ভাল থাকবে।

জমিতে প্রয়োজনে সেচ প্রদান করতে হবে। টমেটো গাছের অতিরিক্ত ডাল ভেঙে দিয়ে খুটির সাথে বেঁধে দিতে হবে। ঘেরের বেড়িবাঁধে টমেটো, মিষ্টিকুমড়া চাষ করতে পারেন।

অন্যান্য রবি ফসল: মাঠে এখন মিষ্টি আলু, চীনা, কাউন, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচসহ অনেক অত্যাবশ্যকীয় ফসলের প্রাথমিক বৃদ্ধি পর্যায়। এসময় ভালভাবে যত্ন পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে আশাতীত ফলাফল বয়ে আনবে।

এসব ফসলের কোনটি এখনো না লাগিয়ে থাকলে দেরি না করে চারা লাগাতে হবে। তবে এক্ষেত্রে অতিরিক্ত যত্ন নিতে হবে। এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত খরা সহনশীল ছোলা, মুগ, তিল, তিষি, যব এসব বপন করা যায়।

গাছপালা: এবারের বর্ষায় রোপণ করা ফল, ওষুধি বা বনজ গাছের যত্ন নিতে হবে। গাছের গোড়ায় মাটি আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছা পরিস্কার করে দিতে হবে। প্রয়োজনে গাছকে খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে।

গাছের গোড়ায় জাবরা প্রয়োগ করলে তা পানি ধরে রাখবে। মাটিতে রসের পরিমান কমে গেলে গাছের গোড়ায় সেচ প্রদান করতে হবে। এ সময় গাছের বাড়বাড়তি কম হয় তাই পারতপক্ষে এখন গাছের ডালপালা কাটা ঠিক হবে না।

প্রাণিসম্পদ: হাঁস-মুরগির ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর ভাল সময় এখন। তাছাড়া সামনে শীতকাল আসছে। শীতকালে পোল্ট্রিতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ বেড়ে যায় এবং রাণীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড,  বসন্ত রোগ, কলেরা এসব রোগ মহামারি আকারে দেখা দিতে পারে। এসব রোগ থেকে হাঁস-মুরগিকে বাঁচাতে হলে এ মাসেই টিকা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।

এ মাসে পশুখাদ্যের কোন অভাব থাকে না। বিশেষ করে কাঁচা ঘাসের। তাই আমন ধানের খরসহ অন্যান্য খাদ্য যেমন ভুট্টা, ডাল, ঘাস দিয়ে সাইলেজ তৈরি করে ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিতে পারেন।

এসময় গবাদি পশুর ক্ষুরা রোগ, তড়কা, গলাফুলা দেখা দিতে পারে। গবাদিপ্রাণিতে রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে প্রাণি চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নিতে হবে।

মৎস্যসম্পদ: মাছের খাবার হিসেবে উদ্ভিজ খাদ্য এবং প্রাণিজ খাদ্য তৈরিতে গোবড়/আবর্জনা পচা সার, রাসায়নিক সার বেশি উপযোগী। এসব পরিমাণমত প্রয়োগ করতে হবে।

জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। রয়োজনে মৎস্যবিদদের  সাথে পরামর্শ করে চুন বা তুঁতে প্রয়োগ করতে পারেন। পুকুরে রৌদ পড়া নিশ্চিত করতে পুকুর পাড়ের গাছের ডালপালা কেটে পরিস্কার করতে হবে।

পুকুরের ঢালে প্যারা, নেপিয়ার বা অন্যান্য ঘাসের চাষ করলে অতিরিক্ত ফসল পাওয়া যায় এবং কার্প জাতীয় মাছের খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।

এছাড়া মাছ সংক্রান্ত যে কোন পরামর্শের জন্য উপজেলা মৎস অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন। বিস্তারিত কৌশল জানার জন্য স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বা উপজেলা কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করতে হবে।