আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ, সহযোগী অধ্যাপক, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, শেকৃবি, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: শীতপ্রধান অঞ্চলের জনপ্রিয় সবজি ব্রাসেলস স্প্রাউট। আমাদের দেশে একেবারে আনকোরা। এটি এবারই প্রথমবারের মতো চাষ হলো শেকৃবি’র গবেষনা মাঠে।

উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. হাসনাত সোলায়মান ইংল্যান্ড থেকে এর বীজ এনে দেখতে চাইলেন, এদেশের আবহাওয়ার এটি আদৌ হয় কিনা! হ্যা সত্যি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ব্রাসেলস স্প্রাউট উৎপাদিত হলো। এটি গুনে- স্বাদে অনন্য এক পুষ্টিকর সবজি।

একটি নতুন সম্ভাবনার উঁকিঝুঁকি দেখতে গবেষনারত শিক্ষার্থী নওরিন অন্তরা আর তার গবেষণা সুপারভাইজার ড. হাসনাত সোলায়মানকে সাথে নিয়ে ব্রাসেলস স্প্রাউট এর মাঠে গেলাম। দেখলাম, জানলাম, শিখলাম। বুঝলাম – সম্ভাবনায় ভরপুর এ সবজির বানিজ্যিক চাষে আরো কিছু গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

ব্রাসেলস স্প্রাউট কপি জাতীয় সবজি। অনেকটা বাধাকপির মতো। প্রতিটি পাতার গোড়ায় বাধাকপির ন্যায় একটি করে ছোট কুড়ি হয়। এ কূড়ি বা বাড টি ব্রাসেলস স্প্রাউট, যা খাওয়া হয়। এমনিতেই কপিজাতীয় সবজিসমূহে ক্যান্সার প্রতিরোধী উপাদান বেশী থাকে।

ক্রুসেফেরী পরিবারের সবজিগুলোর মধ্যে ব্রাসেলস স্প্রাউট এ ক্যন্সার প্রতিরোধী উপাদান – গ্লুকোসিনোলেটস এর পরিমান সর্বাধিক। এছাড়াও অন্যান্য কপিজাতীয় সবজির তুলনায় এতে এন্টিএক্সিডেন্ট, ভিটামিন সি, এ, কে প্রচুর পরিমানে বিদ্যমান। পুষ্টিগুন ও স্বাধ বিবেচনায় তাই এই সবজিটি উন্নত বিশ্বে সকলের প্রছন্দ।

এটি শীতকালীন ফসল। তাই শীতকাল যত দীর্ঘ হবে, এ ফসলের ফলন তত বেশী হয়। সে বিবেচনায় দেশের উত্তরাঞ্চল বেশ উপযোগী হতে পারে। তাই আগাম চাষে ফলন অনেক বেশী হবে। তাপমাত্রা যত বাড়বে ততই বাড এর আকার ছোট হয় এবং বাডগুলো তুলনামূলক শক্ত হয়।

ব্রাসেলস স্প্রাউট এর চাষাবাদ পদ্ধতি অনেকটা বাধাকপির মতো। বীজও দেখতে বাঁধাকপির মতো। বীজ থেকে চারা হয়। এ চারা পরবর্তীতে মুল জমিতে লাগাতে হয়। গাছের উচ্চতা জাতভেদে ২-৪ ফুট বা তারও বেশী হতে পারে। ফসলের জীবনকাল জাতভেদে ৯০- ১৫০ দিন। সাধারনত দু মাস পর থেকে গাছে স্প্রাউট আসা শুরু হয়।

একটি গাছে ৪০-৬০ টি স্প্রাউট হয়। গাছে যতগুলো পাতা থাকবে ততগুলো স্প্রাউট হবে। স্প্রাউটগুলো ৭-১০ সেমি আকারের এবং ওজন ৫০-৭০ গ্রাম হতে পারে। স্প্রাউট আসার ১৫-২০ দিন পর সংগ্রহ করা যায়। সপ্তাহে ১-২ বার গাছ থেকে স্প্রাউট তোলা যায়।

অন্যান্য কপিজাতীয় ফললের তুলনায় ব্রাসেলস স্প্রাউট এর জীবনকাল দীর্ঘ হওয়ায় সারের মাত্রা একটু বেশী লাগে। ইউরিয়া সার ৩-৪ বারে দিতে হয়। দ্রুত ফলন পেতে চাইলে চারা লাগানোর দু মাস পর গাছে মাথা ভেঙে দিতে হবে। একে টপিং বলে।

টপিং এর ফলে স্প্রাউট এর সংখ্যা কমে গেলেও স্প্রাউট এর আকার ও ওজন বাড়ে। ব্রাসেলস স্প্রাউটে রোগ বালাই অনেকটা বাধাকপির মতো। তাপমাত্রা বাড়লে গাছের বয়ষ্ক পাতায় অল্টারনারিয়া ছত্রাকজনিত দাগ ও ব্লাইট রোগ দেখা দেয়। আবার এক ধরনের লেদাপোকা অনেকসময় স্প্রাউটগুলো বাহির থেকে খেয়ে ফেলে। যথাযথ ছত্রাকনাশক ও কীটনাশক স্প্রে করে এগুলো সফলভাবে দমন করা যায়।

তবে ব্রাসেলস স্প্রাউট এর বানিজ্যিক চাষের আগে আরো কিছু গবেষণা প্রয়োজন রয়েছে। যেমন, চারা লাগানোর সময়কাল নির্বাচন, তাপসহনশীল জাতসমূহ নির্বাচন, স্বল্প জীবনকালের জাত উদ্ভাবন, টপিং এর সময়কাল নির্ধারন, ফলন বাড়াতে বিভিন্ন সারের ব্যাবহার ও মাত্রা নির্ধারন, হরমোন প্রয়োগে আগাম ফলন সম্ভাব্যতা যাচাই, রোগ বালাই নিয়ে গবেষনা, পেস্ট রিস্ক এনালাইসিস করা, উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবন, বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং সর্বোপরি উৎপাদন খরচের সাথে লাভের সম্ভাব্যতা যাচাই।

এই গবেষণাগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশে ব্রাসেলস স্প্রাউট চাষের লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন সম্ভব।

বাংলাদেশ সবজি বৈচিত্রে ভরপুর দেশ। আর সে বৈচিত্রের নতুন পালক ব্রাসেলস স্প্রাউট। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, দেশে ১৪২ ধরনের সবজি উতপাদিত হয়। আর জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা’র মতে, সবজি উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ বিশ্বে ৩য়।

সারাবছরব্যাপি এখন দেশে উল্লেখযোগ্য সবজি ফসল উৎপাদিত হয়। বিদেশী সবজির প্রতি নগরের জনসাধারণের বেশ আগ্রহ বিদ্যমান। তদুপরি দেশে এখন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশী নারী – পুরুষ কর্মরত রয়েছেন।

এছাড়াও শহর – নগরের রেষ্টুরেন্ট গুলোতে ভিন্ন স্বাদের খাবারের প্রতি মানুষের আগ্রহ রয়েছে। সে বিবেচনায় এই নতুন সবজির চাষাবাদ বেশ লাভজনক হতে পারে। ইতিপূর্বে শেকৃবি’র প্রফেসর ড. নাহিদ জেবা গবেষণার মাধ্যমে মেক্সিকোর সবজি ফসল টমাটিলো এদেশে সফলভাবে অবমুক্ত করেন।

আরও পড়ুন: মাশরুম চাষাবাদ: পর্ব-০১

আশাকরি ড. সোলায়মান এর হাত ধরে শেকৃবি’র গবেষনায় এই নতুন সবজি ফসলের চাষাবাদ প্রযুক্তি সারা দেশে সম্প্রসারিত হবে, সেই কামনা করছি। সবাইকে ধন্যবাদ।

লেখক: দেশে প্রথম ব্রাসেলস স্প্রাউট চাষ নিয়ে লিখেছেন আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ, সহযোগী অধ্যাপক, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। কৃতজ্ঞতা: প্রফেসর ড. আবুল হাসনাত মোঃ সোলায়মান ও কাজী নওরীন অন্তরা, এম এস শিক্ষার্থী।