আব্দুল হাকিম, রাজশাহী: প্রথম লকডাউনে দেড়শ লিটার দুধ নিয়ে কি করব ভেবে বসে বসে কেঁদেছি। মিষ্টির কারখানা বন্ধ, রাস্তায় কাউকে বের হতে দেয় না। পুলিশি বাঁধার মুখে টেকা দায়। আমি মহিলা মানুষ; দুধ নেওয়ার কেউ না থাকায় পাশের বাজারে গিয়ে বসে এক লিটার-এক লিটার করে বিক্রি করে টিকে আছি। এখন ভেবে অবাক হই,আমি বাজারে গিয়ে দুধ বিক্রি করেছি!”

চোখের কোনে জল নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহীর পবা উপজেলার মাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা মোছাঃ সাথী আক্তার (৩২)। ৫ বোনের মধ্যে দ্বিতীয় হওয়ায় বিয়ে হয়েছে ২০০০ সালে। স্বামীর সংসারে যাওয়ার সময় মায়ের দেওয়া একটা গাভী আর সাথে বাছুর সঙ্গী হয়। সেইথেকে আজ ২৬টি গরুর মালিক সাথী আক্তার। গড়েছেন খামার, করেছেন বাড়ি। এখন মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা আয় করছেন তিনি। সেইসাথে হয়েছেন রাজশাহী ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি। এলাকার কাছে পরিচিত মুখ “সাথী ডেইরি ফার্মের” মালিক হিসেবে।

দেখুন ভিডিও: https://www.facebook.com/320632075085761/videos/361508262212705

সফলতার পেছনের গল্প শুনাতে গিয়ে বলেন, প্রথমে খামারের বিষয়টা মাথায় ছিলনা। কারন জানতাম অনেকটা কঠিন বিষয় এটা। মায়ের দেওয়া গরু থেকে একটা বাছুর যখন বড় হলো তখন আমার স্বামীও দেখভাল শুরু করলেন। তারপর বছরে একটা লোন নিয়ে গরু কিনি এরপর দুধ বিক্রি করে লোন শোধ করি। এভাবে সাতটা গাভী করেছিলাম। সেই থেকেই মূলত শুরু। তবে রোগ বালাই খামার ব্যবস্থাপনা না জানার কারণে ২টা গাভী ও ৩ টা বাছুর মারা গিয়েছিল। একটা বিক্রি করে দিতে হয়েছিল। তারপরেও আমি দমে যাইনি। এখন ১২ বছর ধরে আমার খামারে আর কোন অসুখ নাই। গাভী পালনে প্রাণিসম্পদ থেকে ট্রেনিং নিয়েছি আমি এবং আমার স্বামী।

তিনি আরো বলেন, প্রথমে দুধের খামারের সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা লাগে এটা আগে জানতাম না। তাই রোগবালাই বেশি হতো। এখন আমরা সব জানি কখন কি করতে হয়। কখন অসুখ-বিসুখ হয় আমরা এখন বুঝতে পারি। মহামারি করোনা সংক্রমণ রোধে দফায় দফায় লকডাউন দিতে বাধ্য হচ্ছে সরকার। এতে ক্ষতির মুখে পড়ছে খামারিরা। প্রতিদিনের সংগৃহীত দুধ বিক্রি করতে না পারায় ক্ষতির মুখে পড়ছেন এ অঞ্চলের প্রায়  আড়াই’শ খামারি।

এ বিষয়ে সাথী আক্তারের সাথে কথা হলে তিনি জানান, প্রতি লিটার দুধ ৪০-৪৫ টাকা দরে বক্রিি করে উৎপাদন খরচ তুলতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। খামারে ২৩ টি গরুর মধ্যে দুধ দেয় ১২ টি। প্রতিদিন ১২০ লিটার দুধের মধ্যে ২০ থেকে ৩০ লিটার দুধ অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে। নিজের একটা দোকান আছে সেখানে বিক্রি করছি। তবে বর্তমানে কম দামে বিক্রি হলেও সব দুধ বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু কিছু থাকলে ব্যাংকের কর্মকর্তারা নিয়ে বিক্রি করে দেন।

ডেইরি খামার পরিচালনায় সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা জানতে চাইলে তিনি জানান, খাদ্যের দাম বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা বেড়েছে। গমের ভুষি, ডালের কুড়া, এ্যাংকর ভুষি সবকিছুর দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ৬৮ টাকা এমনকি ১৫ টাকা পর্যন্ত। সে অনুযায়ী দুধের দাম নেই। ৪০ টাকা লিটার দুধ বিক্রি করে গরুর খাবারের দাম আসেনা। সরকারকে এ বিষয়টা দেখা উচিৎ।

নতুন খামারিদের পরামর্শ বিষেয়ে তিনি বলেন, আবেগে খামার করলেই হবে না। আগে রোগ ব্যবস্থাপনা, সমস্যা, দুধ বিক্রির বাজার কেমন সবকিছু দেখতে হবে। খরচ কমাতে নিজের হাতে খাবার করতে হবে। প্রশিক্ষণ নিয়ে এ পেশায় আসলে লাভ করা সম্ভব। নিজে তদারকি বিষয়টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আমার স্বামী তেমন কোনো কাজ করতো না আর্থিক সমস্যা টা ছিল। শশুর-শাশুড়ির কাছ থেকে তেমন কোন সাপোর্ট পায়নি বরং হেনস্থা হতে হয়েছিল। কিছুদিন পর তারা বাড়ি থেকে চলে আসতে বলেন। কিন্তু থাকারই জায়গা ছিল না। আমার বাবা মা যখন গোলটা দেয় তখন গরুটা রাখার জায়গা ছিল না। বাসায় ভাড়াটিয়া থাকতো। ভাড়াটিয়ারা ঢুকলে রাত দশটা এগারোটার পর আমি গরু ঘরে নিতাম। এবং ফজরের আগ দিয়েই গরু বের করে নিতাম যাতে করে কোনো সমস্যা না হয়। এছাড়া তারা ঘুম থেকে উঠার আগেই সবকিছু পরিষ্কার পরিছন্নতা করে রেখে থাকতে হতো। এরপর নানা প্রতিবন্ধকতা ছিল। আল্লাহর রহমতে আমি এখন সুখী।

জেলা প্রাণিসম্পদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জেলার ৯টি উপজেলা ও একটি মেট্রো অঞ্চল মিলিয়ে দেশী ও সংকর জাতের গাভী থেকে দুধ উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার ২৭ মেট্রিক টন। সদ্য বিদায়ী বছর ২০২০ সালে দুধ উৎপাদন হয়েছে ৩ লাখ ৫০ হাজার ২৬ মেট্রিক টন। ২০১৬ সালের তুলনায় জেলায় ৪ বছরে দুধ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১ লাখ মেট্রিক টন। পরের বছরগুলোতে পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকে দুধের উৎপাদন। করোনাকালে এ বিপুল পরিমাণ দুধ বিক্রির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভ্রাম্যমাণ দুধ বিক্রির ব্যবস্থা করলেও তা তেমন কার্যকর হয়নি।

সাথীর বিষয়ে রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ইসমাইল হক বলেন, সাথী একজন বড় ডেইরি খামারি। তাঁর যেকোন প্রয়োজনের আমাদের ফোন দিলে পরামর্শ দিই। তাড়াছা খামার পরিদর্শনও করেছি। একজন সফল নারী উদ্যোক্তা।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের এপ্রিলে দেওয়া লকডাউনে প্রতিদিন ১২০ লাখ থেকে ১৫০ লাখ লিটার দুধ অবিক্রীত থাকে ফলে প্রায় ৫৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয় প্রতিদিন।

 

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ