মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক: বৈশ্বিক খাদ্যশস্য উৎপাদন ও সরবরাহের প্রভাব পড়েছে বাজারে। করোনা পরবর্তীতে দানাশস্যের দাম তেমন না বাড়লেও বর্তমানে হঠাৎ বেড়েছে আটা ও ময়দার দাম। এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ২০ টাকা বেড়েছে আটা-ময়দার দাম। অতিরিক্ত দামকে পুঁজি করে একটি চক্র কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করায় অনেক দোকানে পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে বেশি দামে আটা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬২-৬৫ টাকা। একইসাথে ময়দা প্রতি কেজি ৭৫-৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কেউ কেউ এর চেয়ে বাড়তি দামেও বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে।

আটা ও ময়দার দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে হোটেল রেস্তোরাতেও। বেড়েছে রুটি, সিঙ্গাড়া, পুরিসহ বিভিন্ন মুখরোচক খাবারের দাম। উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ক্রেতারা। তারা বলছেন, আটা-ময়দার দাম বাড়তি হওয়ায় বেকারিপণ্যসহ আটা-ময়দা দিয়ে প্রস্তুতকৃত খাদ্যপণ্যের দামও বেড়ে গেছে। আটা আর চালের দাম প্রায় সমান হয়ে যাওয়ায় শঙ্কা আরও বাড়ছে। এভাবে বাড়তে থাকলে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হ!ে

আজ রোববার রাজশাহীর সাহেববাজার মাস্টারপড়া, উপশহর নিউমার্কেট, শিরোইল কাঁচাবাজারে একাধিক ক্রেতা ও মুদি দোকানির সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের খুচরা বাজারদর (মূল্য টাকায়) প্রকাশ করে ট্রেডিং কর্পোরেশন বাংলাদেশ (টিসিবি)। টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে খোলা আটার দাম বেড়েছে কেজিতে ৬.৯৬ শতাংশ। আজ রোববার ২০ নভেম্বর দাম ৪ দশমিক ৭ শতাংশ খোলা আটার দাম কমলেও বেশি দামেই বিক্রি হচ্ছে আটা। বছরের পুরো হিসেব কষে দেখা যায়, খোলা আটা এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৭৯ দশমিক ১০ শতাংশ। আর গত এক বছরের ব্যবধানে বাজারে আটার দাম ৭৯ দশমিক ১০ শতাংশ বেড়েছে। বছরের ব্যবধানে ময়দার দাম ৭০ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেড়েছে। খোলা ময়দার দাম গত বছরের এই সময়ে ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকার মধ্যে। আর সেই আটা ৬৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, এখন রাজধানীতে খোলা ময়দা বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে। গত সপ্তাহে এই ময়দার দাম ছিল ৬৮ টাকা কেজি। গত সপ্তাহে প্যাকেট ময়দার দাম ছিল ৭৭ টাকা কেজি। এখন বিক্রি হচ্ছে ৮২ টাকা কেজি দরে। আর গত সপ্তাহের ৬৮ টাকা কেজি দরের খোলা ময়দা এ সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকা কেজি দরে। টিসিবির হিসাবে গত এক সপ্তাহে খোলা আটার দাম বেড়েছে কেজিতে ৬.৯৬ শতাংশ। তবে তা আজকের বাজারদর অনুযায়ী ৬.৯৬ শতাংশ কমেছে। এসব দামে উঠানামাতে ভোক্তাদের কোন লাভ হয়না। কারণ তারা দাম উঠানামার বিষয়ে জানতে পারেন না।

দামে উঠানামার বিষয়ে রাজশাহীর সাহেববাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, একবস্তা আটা কিনে তা এককেজি-এককেজি করে বিক্রি করে কোন লাভ থাকে না। তাই আটা রেখেছি প্যাকেটের। খোলা আটা খুব কমই আছে বাজারে। দাম এতটাই বেড়েছে যে, আটা কিনে টাকা আটকিয়ে রেখে ব্যবসায়ীরা লাভ করতে পারবে না। আর কখন দাম পড়ে যাবে তার গ্যারান্টি নাই। অনিয়মিত হওয়ার কারণে দাম উঠানামা করছে।

একই বাজারের আমজাদ স্টোরের স্বত্তাধিকারী জানান, আটার দাম বেশি। চিনির দামে অবস্থা খারাপ। আগে ২৮ টাকা থেকে ৩৫ টাকা আটা বিক্রি করেছি। এখন ৭০-৮০ টাকা দাম। একটু লাভ না হলেও মুদিখানার দোকান তাই রাখতে হয়। তাছাড়া রাখতাম না।

শিরোইল বাজারের এক ব্যবসায়ী জানান, তাঁর ছোট দোকান তাই আটা-ময়দার মতো দামী পণ্য সে রাখে না। অল্প পুঁজির ব্যবসাতে বেশি দামের পণ্য রেখে লাভ কম হওয়ার কারণে আটা ময়দা বিক্রি করছেন না।

শিরোইল এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম এসেছিলেন বাজারে। আটা-ময়দার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আটা কিনতে যাই না। কারণ আমার গ্রামের বাড়ি থেকে একবারে ৪-৫ মণ করে গম কিনে নিয়ে আসি। তারপর ছাঁদে শুকিয়ে সেগুলোর আটা খাই। বাজারে এক কেজি আটার দাম ৮০ টাকা। এখন বাজারে কোন জিনিসের দামই ঠিক নাই। সবগুলোর দাম আগুন-বাতাস।

জানা গেছে, আটা ও ময়দা তৈরি হয় গম দিয়ে। বাংলাদেশে প্রতি বছর গমের চাহিদা ৭৫ লাখ টন। দেশে উৎপাদন হয় মাত্র ১০ লাখ টন। চাহিদার প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশের চাহিদার সিংহভাগ গম আমদানি করা হয় রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে। চলতি বছরের শুরুতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে প্রভাব পড়ে গম আমদানিতে। ফলে যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বাংলাদেশের গমের বাজারে দাম বাড়তে থাকে।

এদিকে বৈশ্বিক উৎপাদন ও সরবরাহ সংকটের কারণে গমের আন্তর্জাতিক বাজার অস্থিতিশীল কয়েক মাস ধরে। এর মধ্যে মে মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দাম বেড়ে রেকর্ড উচ্চে দাঁড়ায় । সেখান থেকে বর্তমানে কিছুটা কমে এলেও এখনো স্থিতিশীলতা ফেরেনি বাজারে। আন্তর্জাতিক বাজারের এ অস্থিরতার কারণেই দেশের বাজারে গম ও গমজাত পণ্যের দাম এখন ঊর্ধ্বমুখী বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, গত অর্থবছরেও দেশে গম আমদানি হয়েছে চাহিদার চেয়ে কম। এতে বাজারে এখন গমের সরবরাহ সংকট দেখা দিয়েছে। এরই প্রভাব পড়েছে আটা-ময়দার উৎপাদন খরচে, যার ধারাবাহিকতায় গত কয়েক সপ্তাহে দেশের বাজারে আটা ও ময়দার দাম বেড়েছে মণপ্রতি কয়েকশ টাকা।

অন্যদিকে ভারতে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে শীত ও গ্রীষ্ম মৌসুমে বপন করা গম ও ধানের ফলন বিপন্ন হয়েছে। এতে দেশটির খুচরা খাদ্যমূল্য ২২ মাসের সর্বোচ্চে দাঁড়িয়েছে। কৃষক এখন সরকারের কাছে কম মূল্যে খাদ্যশস্য বিক্রির চেয়ে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছেন। এতে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার মাত্র অর্ধেক শস্য সংগ্রহ করতে পেরেছে ভারত সরকার। চালের মজুদ দেশীয় চাহিদা পূরণে যথেষ্ট হলেও গমের মজুদ ১৪ বছরের সর্বনিম্নে দাঁড়িয়েছে। আর ভারত থেকে বাংলাদেশে আমদানি করা হয় গম। রাশিয়া, ইউক্রেন ও ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আমদানি মার্কেট।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ