ডেস্ক প্রতিবেদন, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: এককালের সাদা সোনা নামে খ্যাত রাবার বর্তমানে অবহেলিত। বিদেশ থেকে আমদানি বাড়ার কারণে দেশীয় রাবার ক্ষতির মুখে। দাম কমে নেমে গেছে অর্ধেকে। ১৯৯০ সালের দিকে প্রতিকেজি রাবার ২৮০ টাকায় বিক্রি হলেও তা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা। ফলে আমদানি বাড়ায় দেশের রাবার শিল্প ক্ষতির মুখে পড়েছে বলে জানিয়েছে খাত সংশ্লিষ্টরা্।

সরকারের উদাসীনতা, পুরনো চাষ পদ্ধতি এবং শিল্পোদ্যোক্তাদের অনাগ্রহের কারণেও রাবারশিল্পের সঙ্কট ঘণিভূত হয়েছে বলে জানা গেছে। দেশে প্রায় ৭০ হাজার একর ভূমিতে রাবার চাষ হয়। দেশে বছরে ১৬ থেকে ২০ হাজার টন রাবার উৎপাদন হয়। আর দেশীয় বাজারে এই পণ্যের চাহিদা বছরে ৩০ হাজার টন।

উদ্যোক্তারা বলছেন, বিদেশ থেকে রাবার আমদানি বেড়ে যাওয়ায় দেশে উৎপাদিত রাবারের দাম কমে গেছে। এ ছাড়া রাবার কাঁচামাল কৃষি পণ্য হওয়া সত্ত্বেও শিল্প পণ্য হিসেবে দেশের বাজারে ভ্যাট দিতে হচ্ছে ১৫ শতাংশ। এ কারণে আরও বিপাকে পড়েছেন বাগানের উদ্যোক্তারা। লোকসান গুনছে সরকারি বাগানগুলোও।

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায় দুটি রাবার বাগান ছিল সুইট খানের। বাগানে উৎপাদিত রাবারের দাম না পেয়ে একটি বিক্রি করে দিয়েছেন বছর তিনেক আগে। আরেকটি আছে। তবে করোনাসঙ্কট শুরু হওয়ার পর সেটির কার্যক্রমও স্থবির ।করোনার কারণে গত মার্চ থেকে ক্রেতা নেই। ফলে গাছ থেকে কষ (লেটেক্স) সংগ্রহ বন্ধ রেখেছি। গাছেই কষ নষ্ট হচ্ছে।

তিনি বলেন, স্বাভাবিক অবস্থায়ও রাবারের দাম পাওয়া যায় না। উৎপাদন খরচও অনেক সময় ওঠে না। ফলে এই রাবার বাগান করায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন সব চাষীরাই।

একই উপজেলার বরমচালের কলিমউল্লা রাবার বাগানের সত্ত্বাধিকারী টিপু চৌধুরী বলেন, ‘৯০ সালে আমি বাগান শুরু করি। তখন ২৮০ টাকায় প্রতি কেজি রাবার বিক্রি করেছি। কিন্তু গত ১৫ বছর ধরে রাবারের দাম কমছে। বর্তমানে প্রতি লিটার রাবারের কষ বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকায়। চার লিটার কষে এক কেজি রাবার হয়। ফলে এক কেজি রাবার বিক্রি করে দাম পাচ্ছি ১০০ টাকা। অথচ এক কেজি উৎপাদনে খরচ পড়ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। তার উপর আছে ১৫ শতাংশ ভ্যাট। সব মিলিয়ে এই ব্যবসায় এখন লাভের চেয়ে লোকসানই বেশি।

সিলেট বিভাগের বিভিন্ন অ লের রাবার বাগানের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে একই ধরণের তথ্য জানা গেছে। সকলেই দাম না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। অব্যাহত লোকসানের কারণে অনেকেই গাছ কেটে ফেলছেন। বাগান বিক্রিও করে দিচ্ছেন কেউ কেউ।

অথচ এককালে ‘সাদা সোনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিলো রাবার শিল্পকে। ‘৮০ দশকে সরকারি তরফে রাবার উৎপাদনে ব্যাপক উৎসাহ প্রদান করা হয়। সে সময় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠে অনেকগুলো রাবার বাগান।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে সরকারি রাবার বাগান ১৮টি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জোনে নয়টি, টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ জোনে পাঁচটি, সিলেট জোনে চারটি বাগান রয়েছে।

সিলেট অ লের ভাটেরা, সাতগাঁও, শাহজী বাজার ও রূপাইছড়া বাগানে মোট আট হাজার ৪৪২ একর জমিতে রাবার চাষ হয়। এ ছাড়া সিলেট অ লে বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন শতাধিক রাবার বাগান রয়েছে।

বাগান থেকে সংগৃহীত কষ সিলেট অঞ্চলের প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করে রাবারের শিট তৈরি করা হয়। এরপর তা চলে যায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন কারখানায়। রাবার দিয়ে গাড়ির টায়ার, টিউব, জুতার সোল, ফোম, রেক্সিন, হোসপাইপ, গাম, খেলনাসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি হয়।

বেসরকারি কয়েকটি রাবার বাগানের মালিকরা জানান, ২০১০-১২ সালে রাবারের দাম ছিল কেজি প্রতি ২৮০-৩২০ টাকা, ২০১৩-২০১৪ সালে এসে দাঁড়ায় ১২০-১৩০ টাকা। বর্তমানে প্রতি কেজি রাবার ১০০-১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বছর তিনেক আগে নিজের বাগানের গাছ কেটে ফেলেছেন কুলাউড়ার বাগান মালিক আবদুল মতলিব। তিনি বলেন, প্রায় পাঁচ বছর ভর্তুকি দিয়ে বাগান চালু রেখেছিলাম। দাম বাড়ার আশায় ছিলোম। কিন্তু দিন দিন দাম কমছেই। ফলে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। এ কারণে সব গাছ কেটে বিক্রি করে ফেলেছি।

এদিকে, সিলেট অ লের সরকারি বাগানের বেশিরভাগ গাছেরই আয়ুস্কাল ফুরিয়েছে অনেক আগেই। নতুন গাছ আমদানি বা রোপনের উদ্যোগ নেই। এ ছাড়া বনবিভাগও রাবার বাগানের জন্য নতুন জমি দিতে আগ্রহী নয়। সরকারি বাগানগুলোর এক লাখ ৩২ হাজার রাবার গাছের অর্থনৈতিক জীবনচক্র এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। আয়ুষ্কাল হারানো গাছগুলোর কাঠ আহরণের জন্য শ্রীমঙ্গলে স্থপন করা হয়েছে রাবার কাট প্রেসার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট।

ট্রিটমেন্ট প্লান্ট সূত্রে জানা গেছে, এখানে অর্থনৈতিক জীবনচক্র হারানো রাবার গাছের কাঠকে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী টেকসই কাঠে রূপান্তর করা হয়। প্লান্টটি প্রতিদিন ১৬০ ঘনফুট হিসেবে বছরে ৪৮ হাজার ঘনফুট কাঠ প্রক্রিয়াজাত করতে সক্ষম।

ভাটেরা সরকারি রাবার বাগানের ব্যবস্থাপক মকবুল হোসেন বলেন, সিলেট জোনের চারটি সরকারি বাগানই পুরাতন। এসব রাবার বাগানে উৎপাদন ভালো কিন্তু বিক্রয়মূল্য কম হওয়াতে লোকসানের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

রাবার শিল্পের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা বলতে বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন (বাশিউক) রাবার বিভাগ, সিলেট অঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক ওয়ালিউর রহমানের সঙ্গে গত রোববার বিজনেস স্ট্যা্ডার্ড আলাপ করতে চাইলে তিনি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুপতি ছাড়া কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। এ ব্যাপারে পরদিন যোগাযোগের অনুরোধ করেন তিনি। সোম ও মঙ্গলবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি।

আমদানি বাড়ায় দেশের রাবার শিল্প ক্ষতির মুখে শিরোনামে সংবাদের তথ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।