কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: শীতকালীন সবজি চাষ শুরু হয় মূল আম্বিন মাস থেকেই। আর আশ্বিন মাসে ফসল, প্রাণী ও মৎস্য চাষে সফলতা পেতে যেসব কৌশল রয়েছে তা না জানলে একজন কৃষক সঠিক সফলতা আনতে পারেন না। তাই কৃষক ভাইদের এসব বিষয়ে জানা একান্ত জরুরি।

আমন ধানে পরিচর্যা
আমন ধানের বাড়ন্ত পর্যায় এখন। ধান গাছের বয়স ৪০-৫০ দিন হলে ইউরিয়ার শেষ কিস্তি প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের আগে জমির আগাছা পরিষ্কার করে নিতে হবে এবং জমিতে ছিপছিপে পানি রাখতে হবে। এ সময় বৃষ্টির অভাবে খরা দেখা দিতে পারে। সেজন্য সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।সম্পূরক সেচ।

এ সময় বৃষ্টির অভাবে খরা দেখা দিতে পারে। খরায় ফলন অনেক কমে যায়। সুতরাং খরা দেখা দিলে সম্পূরক সেচ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নদী, পুকুর, খাল-বিল, ডোবা যেখানেই পানি পাওয়া যাবে সেখান থেকে পাম্প, নলকূপ, দোন, সেওতি দিয়ে সেচ দেয়া নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে সম্পূরক সেচ আমনের ফলন বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।

পড়তে পারেন: সফলতা পেতে প্রতি মাসে পুকুরের যেসব যত্ন জরুরি

রোগ ও পোকামাকড়
শিষ কাটা লেদা পোকা ধানের জমি আক্রমণ করতে পারে। প্রতি বর্গমিটার আমন জমিতে ২-৫টি লেদা পোকার উপস্থিতি মারাত্মক ক্ষতির পূর্বাভাস। তাই সতর্ক থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ সময় মাজরা, পামরি, চুঙ্গি, গলমাছি পোকার আক্রমণ হতে পারে। এছাড়া খোলপড়া, পাতায় দাগ পড়া রোগ দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে নিয়মিত জমি পরিদর্শন করে, জমিতে খুঁটি দিয়ে, আলোর ফাঁদ পেতে, হাতজাল দিয়ে পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাছাড়া সঠিক বালাইনাশক সঠিক মাত্রায়, সঠিক নিয়মে, সঠিক সময় শেষ কৌশল হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।

নাবি আমন
রোপণ নিচু এলাকায় অথবা কোনো কারণে আমন সময় মতো চাষ করতে না পারলে আশ্বিনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বিআর ২২, বিআর ২৩, বিনাশাইল বা স্থানীয় জাতের চারা রোপণ করা যায়। এক্ষেত্রে গুছিতে ৫-৭টি চারা রোপণ করতে হবে। সেসঙ্গে অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি ইউরিয়া প্রয়োগ ও অতিরিক্ত পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যায় এবং দেরির ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যায়।

পড়তে পারেন: চৈত্র মাসে সফলতায় ফসল, প্রাণি, মাছের যত্নে যা করতে হবে

আখের চারা উৎপাদন
আখের চারা উৎপাদন করার উপযুক্ত সময় এখন। সাধারণত বীজতলা পদ্ধতি এবং পলিব্যাগ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করা যায়। তবে পলিব্যাগে চারা উৎপাদন করা হলে বীজ আখ কম লাগে এবং চারার মৃত্যুহার কম হয়।  চারা তৈরি করে বাড়ির আঙিনায় সুবিধাজনক স্থানে সারি করে রেখে খড় বা শুকনো আখের পাতা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। চারার বয়স ১-২ মাস হলে মূল জমিতে রোপণ করতে হবে। কাটুই বা অন্য পোকা যেন চারার ক্ষতি করতে না পারে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।

বিনা চাষে ফসল / আবাদ  জমি তৈরি ও বীজ বপন
মাঠ থেকে বন্যার পানি নেমে গেলে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় বিনা চাষে অনেক ফসল আবাদ করা যায়। এ সময় ভুট্টা, গম, আলু, সরিষা, মাসকালাই বা অন্যান্য ডাল ফসল বিনা চাষে লাভজনকভাবে অনায়াসে আবাদ করা যায়। সঠিক পরিমাণ বীজ, সামান্য পরিমাণ সার এবং প্রয়োজনীয় পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে লাভ হবে অনেক। জমির জো বুঝে এবং আবহাওয়ার কথা খেয়াল রেখে বিনা চাষে ফসল করলে খরচ খুব কম হয় এবং দ্রুত একটি ফসল পাওয়া যায়।

পড়তে পারেন: শ্রাবন মাসে কি কি সবজি চাষ করবেন, জানুন বিস্তারিত

শাকসবজি/ আগাম জাতের শীতকালীন সবজি চাষ
জমির মাটি এখনও ভেজা এবং স্যাঁতসেঁতে। আগাম শীতের সবজি উৎপাদনের জন্য উঁচু জয়গা কুপিয়ে পরিমাণ মতো জৈব ও রাসায়নিক সার বিশেষ করে ইউরিয়া দিয়ে শাক উৎপাদন করা যায়। শাকের মধ্যে মুলা, লালশাক, পালংশাক, চিনাশাক, সরিষাশাক অনায়াসে করা যায়। তাছাড়া সবজির মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, টমেটো, বেগুন, ব্রোকলি বা সবুজ ফুলকপিসহ অন্যান্য শীতকালীন সবজির চারা তৈরি করে মূল জমিতে বিশেষ যতেœ আবাদ করা যায়।

কলা/ চারা রোপণ
অন্যান্য সময়ের থেকে আশ্বিন মাসে কলার চারা রোপণ করা সবচেয়ে বেশি লাভজনক। এতে ১০-১১ মাসে কলার ছড়া কাটা যায়। ভালো উৎস বা বিশ্বস্ত চাষি ভাইয়ের কাছ থেকে কলার অসি চারা সংগ্রহ করে রোপণ করতে হবে। কলার চারা রোপণের জন্য ২-২.৫ মিটার দূরত্বে ৬০ সেমি. চওড়া এবং ৬০ সেমি. গভীর গর্ত করে রোপণ করতে হবে। গর্তপ্রতি ৫-৭ কেজি গোবর, ১২৫ গ্রাম করে ইউরিয়, টিএসপি ও এওপি সার এবং ৫ গ্রাম বরিক এসিড ভালোভাবে মিশিয়ে ৫-৭ দিন পর অসি চারা রোপণ করতে হবে। কলা বাগানে সাথি ফসল হিসেবে ধান, গম, ভুট্টা ছাড়া যে কোনো রবি ফসল চাষ করা যায়। এতে একটি অতিরিক্ত ফসলের এবং সে সঙ্গে অর্থও পাওয়া যায়।

পড়তে পারেন: গম ছেড়ে সবজি চাষে ঝুঁকছে রাজশাহীর চাষিরা

গাছপালা/নতুন চারার যত্ন ও সার প্রয়োগ
গাছের চারা রোপণের কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। তবে রোপণ করা চারা কোনো কারণে মরে গেলে সেখানে নতুন চারা রোপণের উদ্যোগ নিতে হবে। রোপণ করা চারার যত্ন নিতে হবে এখন। যেমন- বড় হয়ে যাওয়া চারার সঙ্গে বাঁধা খুঁটি সরিয়ে দিতে হবে এবং চারার চারদিকের বেড়া প্রয়োজনে সরিয়ে বড় করে দিতে হবে।

মরা বা রোগাক্রান্ত ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। চারা গাছসহ অন্যান্য গাছে সার প্রয়োগের উপযুক্ত সময় এখন। গাছের গোড়ার মাটি ভালো করে কুপিয়ে সার প্রয়োগ করতে হবে। দুপুর বেলা গাছের ছায়া যতটুকু স্থানে পড়ে ঠিক ততটুকু স্থান কোপাতে হবে। পরে কোপানো স্থানে জৈব ও রাসায়নিক সার ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে । গাছের জাত ও বয়সের কারণে সারের মাত্রাও বিভিন্ন হয়।

পড়তে পারেন: ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষে ৫ গুণ বেশি ফলন

প্রাণিসম্পদ/হাঁস-মুরগির যত্ন
হাঁস-মুরগির কলেরা, ককসিডিয়া, রানীক্ষেত রোগের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। প্রাথমিকভাবে টিকা প্রদান, প্রয়োজনীয় ওষুধ খাওয়ানোসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক। এ মাসে হাঁস-মুরগির বাচ্চা ফুটানোর ব্যবস্থা নিতে পারেন। বাচ্চা ফুটানোর জন্য অতিরিক্ত ডিম দেবেন না। তাছাড়া ডিম ফুটানো মুরগির জন্য অতিরিক্ত বিশেষ খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

গরু-বাছুরের যত্ন
আশ্বিন মাসে গবাদিপশুকে কৃমির ওষুধ খাওয়ানো দরকার। গবাদিপশুকে খোলা জায়গায় না রেখে রাতে ঘরের ভেতরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। পানিতে জন্মানো পশু খাদ্য এককভাবে না খাইয়ে শুকিয়ে খড়ের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। এ সময় ভুট্টা, মাসকলাই, খেসারি বুনো ঘাস উৎপাদন করে গবাদিপশুকে খাওয়াতে পারেন। গর্ভবতী গাভীকে, সদ্য ভূূমিষ্ঠ বাছুর ও দুধালো গাভীর বিশেষ যত্ন নিতে হবে। এ সময় গবাদি প্রাণীর মড়ক দেখা দিতে পারে। তাই গবাদিপশুকে তড়কা, গলাফুলা, ওলান ফুলা রোগের জন্য প্রতিষেধক, প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চত করতে হবে।

পড়তে পারেন: বর্ষায় ছাদে সবজি বাগান, জানুন কৌশল

মৎস্যসম্পদ / মাছের যত্ন
বর্ষায় পুকুরে জন্মানো আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং পুকুরের পাড় ভালো করে বেঁধে দিতে হবে। পুকুরের মাছকে নিয়মিত পুষ্টিকর সম্পূরক খাবার সরবরাহ করতে হবে। এ সময় পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। তাছাড়া পুকুরে জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং রোগ সারাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে । এ সময় সরকারি ও বেসরকারি মাছের খামার থেকে জিওল মাছের পোনা সংগ্রহ করে পুকুরে ছাড়ার ব্যবস্থা নিতে পারেন।

সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আশ্বিন মাসে দেশজুড়ে ইঁদুর নিধন অভিযান শুরু হয়। আমন ধান রক্ষাসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষতির মাত্রা কমানোর জন্য এ অভিযান চলে। এককভাবে বা কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় ইঁদুর দমন করলে কোনো লাভ হবে না। ইঁদুর দমন কাজটি করতে হবে দেশের সব মানুষকে একসঙ্গে মিলে এবং ইঁদুর দমনের সব পদ্ধতি ব্যবহার করে।

ইঁদুর নিধনের ক্ষেত্রে যেসব পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায় সেগুলো হলো- পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও আধুনিক চাষাবাদ, গর্তে ধোঁয়া দেয়া, ফাঁদ পাতা, উপকারী প্রাণী যেমন- পেঁচা, গুইসাপ, বিড়াল দ্বারা ইঁদুর দমন, বিষটোপ এবং গ্যাস বড়ি ব্যবহার  করা। আসুন সবাই একসঙ্গে অতিচালাক আমাদের এ শত্রুটিকে দমন করি। সবার জন্য নিশ্চিত সফল কৃষি উৎপাদন কামনা করে এ মাসের কৃষি এখানেই শেষ করলাম। সবাই খুব ভালো থাকবেন। কৃষির সমৃদ্ধিতে আমরা সবাই গর্বিত অংশীদার।

আশ্বিন মাসে ফসল, প্রাণী ও মৎস্য চাষে সফলতা পেতে কয়ে কৌশল লিখেছেন কৃষি তথ্য সার্ভিসের সহকারী তথ্য অফিসার (শস্য উৎপাদন) কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ