পঞ্চগড় প্রতিনিধি, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: হাঁস-মুরগী বিক্রি আর ধার-দেনা করে নিজেই চার বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করেছেন পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার দন্ডপাল ইউনিয়নের প্রধানাবাদ এলাকার সুন্দরী বেগম (৫৫)।

স্বামী অসুস্থ থাকায় নিজেকেই সব দায়িত্ব নিতে হয়েছে। প্রতিদিন নিজেই ধান ক্ষেত দেখতে যেতেন। ধানের সবুজ পাতা বাতাসে দুলতে দেখে সব কষ্টই ভুলে যেতেন তিনি।

কিন্তু গত ২০ এপ্রিল ধান ক্ষেত দেখতে এসে আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন নি সুন্দরী বেগম। ধান ক্ষেতের পাশে গড়ে ওঠা ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় ঝলসে গেছে চার চার বিঘা জমির বোরো ধান।

শুধু সুন্দরী বেগমেরই নয় ওই ইউনিয়নের দুইটি ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় প্রধানাবাদ, সন্নাসীডাঙ্গা, মৌমারী, মাটিয়ারপাড়া, লোহাগাড়া, বেংহাড়ি, সাদ্দামের মোড় এলাকার শতাধিক কৃষকের প্রায় দুইশ একর জমির বোরো ধান ঝলসে গেছে।

প্রত্যন্ত ওই এলাকার বেশিরভাগ কৃষকই বর্গচাষী হওয়া ধান ক্ষেতের এমন পরিনতিতে মাথায় হাত পড়েছে তাদের। ধানের শীষ বের হওয়া সময় বোরো ক্ষেত ঝলসে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা।

খাবার ধান কিংবা মহাজনের ঋণ শোধ করবেন কিভাবে ভেবে পাচ্ছেন না তারা। এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা প্রতিবাদ জানিয়ে ওই ইটভাটা মালিকদের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করলেও কোন ক্ষতিপূরণ মিলছে না তাদের।

তাই নিরুপায় দরিদ্র এই কৃষকরা স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাসহ জনপ্রতিনিধিরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করলেও এখনো কোন কৃষককেই ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি।

জানা যায়, দেবীগঞ্জ উপজেলার শুধুমাত্র দন্ডপাল ইউনিয়নেই গত এক দশকে অবৈধভাবে বাড়ির আশ-পাশে ও ফসলি জমিতে ১৬ টি ইটভাটা গড়ে ওঠেছে। এসব ইট ভাটার কারণে প্রতিনয়তই নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ওই এলাকার সাধারণ মানুষ।

গত ২০ এপ্রিল দন্ডপাল ইউনিয়নের প্রধানাবাদ এলাকার আনোয়ার হোসেনের এডিএ ইট ভাটা এবং এর সপ্তাহ খানেক আগে একই ইউনিয়নের লোহাগাড়া এলাকার মনোরঞ্জন বাবুর ডিডিবি ইট ভাটার কালো ধোঁয়ায় প্রায় দুইশ একর জমির জমির বোরো ধান ঝসলে গেছে।

প্রধানাবাদ এলাকার সুন্দরী বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী অসুস্থ্য। আমি ধার-দেনা করে অনেক কষ্টে ৪ বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করেছি। আমার সম্পূর্ণ ধানক্ষেত ভাটার ধোঁয়ায় ঝসলে গেছে। আমি এখন কিভাবে ঋণ শোধ করবো। ক্ষেতের দিকে তাকালেই আমার কান্না পায়।’

ওই এলাকার কৃষক বিদ্যুৎ চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমাদের জমির চারপাশে ইটভাটা। ভাটার মালিকরা লাখ লাখ টাকা লাভ করতেছে। আমরা নিষেধ করা সত্যেও কালো ধোয়া বন্ধ করেনি তারা। আমরা গরিব মানুষ। বর্গা নিয়ে অল্প আবাদ করেছি। পুড়ে লাল হয়ে গেছে আমাদের ক্ষেতের ধান গাছ। আমরা শান্তনা চাই না। আমরা আমাদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ চাই।’

এডিএ ইটভাটার ম্যানেজার শহীদ নেওয়াজ সেতু বলেন, ‘এটি একটি দুর্ঘটনা। আমাদের মালিক চাষিদের কাছে সময় নিয়েছেন। এর মধ্যে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষেতে ওষুধ স্প্রে করে দিচ্ছি। তাতে কাজ না হলে মালিকপক্ষ চাষিদের ক্ষতিপূরণ দিবেন।’

দন্ডপাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামেদুল ইসলাম বলেন, ‘ওই দুইটি ইটভাটার মালিক ও কৃষক উভয় পক্ষকে নিয়ে বসেছিলাম। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে ভাটার মালিকরা কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ মতো কৃষকের ক্ষেতে ওষুধ স্প্রে করে দিবে। তাতে কাজ না হলে তারা প্রত্যেক কৃষককে ক্ষতিপূরণ দিবে।’

দেবীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘দীঘদিন ইটভাটায় ইট উৎপাদনের পর যখন ভাটার আগুন নেভানো হয় তখন সেখান থেকে একটি ক্ষতিকর ফ্লোরিন গ্যাস নির্গত হয়। কালো ধোঁয়ার সাথে ওই গ্যাসটি ফসলের ক্ষতি করে।

প্রধানাবাদ এলাকার ক্ষতিকর বোরো ক্ষেতগুলো আমি নিজে পরিদর্শন করেছি। ভাটা বন্ধের পর যে ধানগুলোর ক্ষতি হয়েছে সেগুলো রিকোভারির জন্য কৃষকদের বিভিন্ন ওষুধ স্প্রে করার পরমর্শ দিয়েছি। আশা করছি ইটভাটার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ওই ফসলগুলো পূর্বাবস্থায় ফিরে আসবে।’

জেলা কৃষি সম্পসার অধিদপ্তরের উপ পরিচালক শামছুল হক বলেন, ‘বিষয়টি জানার পর দেবীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে সেখানে পাঠিয়েছি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ভাটা মালিকদের নিয়ে একটি আলোচনা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ বোরো ধান ক্ষেত টিকিয়ে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। এবং কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য ভাটা মালিকদের বলা হয়েছে।’

প্রসঙ্গত, চলতি মৌসূমে পঞ্চগড় জেলায় ৩৭ হাজার ৪৬০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছে। এর মধ্যে শুধুমাত্র দেবীগঞ্জ উপজেলায় বোরো চাষ হয়েছে ১১ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে।