ইউসুফ আলী সুমন, মহাদেবপুর (নওগাঁ) প্রতিনিধি: আইনের তোয়াক্কা না করেই দেশের উত্তরাঞ্চলের খাদ্য ভান্ডার খ্যাত নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলায় তিন ফসলি কৃষিজমিতে গড়ে উঠেছে অবৈধ ইটভাটা। স্থানীয়রা বলছেন উত্তরাঞ্চলের এই খাদ্য ভান্ডার অবৈধ ইটভাটার থাবা থেকে বাঁচাতে হবে।

এসব ভাটার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও জেলা প্রশাসনের অনুমোদন নেই। বিগত বছরগুলোর মতো এবারও নিবন্ধনহীন ভাটাগুলো উৎপাদনে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে ইট তৈরির শেষ মহুর্তের প্রস্তুতি চলছে। ইটভাটা মালিকরা বলছেন, নিবন্ধন না থাকলেও তারা মূল্য সংযোজন কর, আয়কর দেন এবং ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করছেন। প্রশাসন বলছেন, যে কোনো অবৈধ কার্যক্রম বন্ধে তারা তৎপর। আর ইট উৎপাদন শুরুর আগেই অবৈধ ভাটাগুলো উচ্ছেদ করে কৃষিজমি রক্ষার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলা সদর, নাটশাল, খাজুর, লক্ষণপুর, বাগডোব, চেরাগপুর, কালুশহর, আজিপুর, হাট চকগৌরীসহ বিভিন্ন এলাকায় নামে-বেনামে গড়ে উঠেছে অন্তত ২০টি ইটভাটা। এদের কারও নেই লাইসেন্স; আইনও মানছেন না কেউ। কিন্তু রহস্যজনক কারণে ভাটা বন্ধে কোনোই উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। ফলে প্রশাসন ও নওগাঁ পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। উৎপাদন মৌসুমে এসব ইটভাটা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে প্রায় ৩০০ বিঘা ফসলি জমি ব্যবহার করে। এ পরিমাণ জমিতে প্রত্যেক মৌসুমে ছয় হাজার মণ ধান উৎপাদন হবে। যার বাজারমূল্য অর্ধকোটি টাকা।

ইট তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয় ফসলি জমির উপরিভাগের ঊর্বর মাটি (টপসয়েল)। এতে জমির ঊর্বরা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে এবং ফসল উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। আবার কয়েকটি ভাটায় নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অবাধে কাঠ পোড়ানো হয়। এর বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় ফসল, গাছ-গাছালি বিনষ্টের পাশাপাশি বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশ। সুস্থ পরিবেশের জন্য এসব ইটভাটা এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ (সংশোধিত-২০১৯) অনুযায়ী লাইসেন্স ছাড়া কোনো ইটভাটা চালানো যাবে না। এর ব্যত্যয় হলে কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এ ছাড়া ইটভাটা নির্মাণের আগে পরিবেশ অধিদপ্তর, বিএসটিআইসহ সরকারি কয়েকটি সংস্থার ছাড়পত্র নেয়া বাধ্যতামূলক। কাগজে-কলমে এমন নিয়ম থাকলেও তা মানতে নারাজ ইটভাটা মালিকরা। প্রশাসনের কঠোরতার অভাবকে পুঁজি করে অবৈধ ইটভাটা চলছে বছরের পর বছর। বেসরকারী এক হিসেব মতে, একটি ইটভাটা প্রতি মৌসুমে ৩০ লাখ ইট উৎপাদন করে থাকে। গড়ে এক ফুট গভীরতায় মাটি কাটা হলে একটি ভাটার জন্য বছরে মাটির প্রয়োজন হয় ১৫-১২ একর জমির। সেই হিসেব অনুযায়ী উপজেলার ২০টি ইটভাটার জন্য বছরে ৩০০ একর জমির মাটি কাটা হয়।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ইটভাটা পরিষ্কারের কাজ করছেন শ্রমিকরা, চলছে ইট তৈরির প্রস্তুতি। ফসলি জমিতে ইট শুকানোর চাতালও (খলা) তৈরি করা হচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও ভাটা চত্বরে মাটি স্তূপ করা হচ্ছে। আগামি ২০-২৫ দিনের মধ্যে আমন ধান কাটা-মাড়াই শুরু হবে। এর পরই শ্রমিকরা ফসলি জমির মাটি কেটে ট্রাক্টরে করে ভাটায় নিয়ে আসবেন। এই মাটি পুড়িয়ে তৈরি হবে ইট।

জানতে চাইলে উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি ইব্রাহিম সরকার জানান, সমিতির সদস্যদের লাসসেন্স নবায়ন নেই। মালিকদের আইন মেনে ইট বানাতে বলেছেন তিনি। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ অরুন চন্দ্র রায় জানান, মাটির উপরিভাগে যে গুরুত্বপূর্ণ জৈব পদার্থ থাকে তা নীচের মাটিতে থাকে না। জমির উপরিভাগের মাটি কাটা হলে কয়েক বছরেও প্রয়োজনীয় জৈব পদার্থের ঘাটতি পুরণ হবে না। এতে ফলস উৎপাদন কমে যাবে বলেও জানান তিনি।

নওগাঁ জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মকবুল হোসেন জানান, মহাদেবপুরের কোনো ইটভাটারই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও জেলা প্রশাসনের অনুমোদন নেই। তাদের হাতে বিচারিক ক্ষমতা না থানায় মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করতে পারেন না। প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে অবৈধ ভাটার বিরুদ্ধে তারা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এ ব্যাপারে মহাদেবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা পরিবেশ কমিটির সভাপতি মিজানুর রহমান মিলন জানান, অবৈধ ইটভাটা পরিচালনার সুযোগ নেই। মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করে তিনি প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

 

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ