মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী: মোটা পলিথিন পেপারের উপর কাঁচা টমেটো ছড়িয়ে দিচ্ছে কয়েকজন। এরপর স্প্রে মেশিন দিয়ে টমেটোর উপর কুয়াশার মতো ছড়িয়ে দিচ্ছে ইথিফন-রাইপেন। এরপর রোদে শুকানোর পরপরই সবুজ টমেটো হয়ে উঠছে লাল টুকটুকে। গাছের টমেটো মাঠে ছড়িয়ে দিয়ে এই বিশেষ কৌশলে দেড় হাজার থেকে ১৬০০ টাকা মণ দরে টমেটো বিক্রি করছেন রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চাষিরা।

চাষিরা বলছেন, মাস খানেক আগেও টমেটো প্রতি মণ ২ হাজার থেকে ২২শ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে বাজারে চাহিদা কমতে থাকবে। একদিন আগে তুলতে পারলে লাভের অংক বেশি হয়। কাঁচা সবজির দাম সকাল-বিকেলে উঠানামা হয়। তাই কিছু অপরিপক্ক ফল থাকলেও তাতে রং চলে আসে ইথোফন প্রয়োগে।

সরেজমিনে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর পানিহার, ইটাহার, জগপুর, বিড়ইল, রাজাবাড়ীহাট এলাকায় দেখা যায় ইথোফোন দিয়ে টমেটো পাকানো হচ্ছে। একদিকে কাঁচা টমেটোর সারি অন্যদিকে রং ধরা পাকা টমেটোর সারি। প্রত্যেক সারিতে ক্যারেট নিয়ে বসেছেন শ্রমিকরা। এরপর ক্যারেট ভর্তি করে পাশেই থেমে থাকা ট্রাকে লোড হচ্ছে। এরপর দেশের বিভিন্ন জায়গায় ট্রাকযোগে পাঠাচ্ছে ব্যবসায়ীরা।

কথা হয় আব্দুল হামিদ নামের এক ব্যবসায়ীর সাথে। তিনি বলেন, বাজারে কাঁচা টমেটো খায় না। তাই পাকানোর ঔষধ ব্যবহার করি। শুধু আমি নই, এই এলাকায় যত চাষি আর ব্যবসায়ীরা আছে, সবাই এই পদ্ধতি ব্যবহার করি।

তিনি আরো জানান, প্রতিবছর শীত মৌসুমে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এখানকার টমেটো যায়। পাকানোর জন্য এবং লাল রং করার জন্য টমেটোতে ইথিফন ও অন্যান্য ছত্রাকনাশক জাতীয় রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হয়। বাজারে টমেটো পাকানোর জন্য হরমন কিনতে পাওয়া যায়। মেশিনের সাহায্যে এসব স্প্রে করা হয় টমেটোতে। এরপর একদিন রোদে শুকিয়ে খড়, পলিথিন দিয়ে সেগুলো ঢেকে রাখা হয়, যেটিকে বলে ‘জাগ’। ‘জাগ’ দিয়ে এভাবে দু-তিন দিন ঢেকে রাখার পরে আবার সেগুলো রোদে শুকানো হয়। তাহলেই লাল টুকটুকে হয়ে উঠে।

গোদাগাড়ী রাজাবাড়ী এলাকার কৃষক শান্ত রহমান এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, জমিতে টমেটো পাকানো খুব কষ্টকর। বাণিজ্যিকভাবে টমেটো বিক্রির জন্য একসাথে পাকানো জরুরি। জমি থেকে সব টমেটো কাঙ্খিতভাবে উত্তোলন সম্ভব নয়। আর জমিতে পাকা টমেটো বাজারজাত করতে গেলে গলে যাবে। এছাড়াও শীতের কারণে টমেটো পাকতে দেরি হয়। গাছে পাকা টমেটো পাখিতে খেয়ে ফেলে। কাজেই কাঁচা টমেটো পাকাতে হরমন জাতীয় কীটনাশক মেশাতে হয়। বিষ দিয়ে টমেটো পাকানো হয় একদিকে বেশি দাম পাওয়ার জন্য; অন্যদিকে বাজারজাতকরণের সুবিধার জন্য। স্বাভাবিকভাবে ১০ দিনেও পাকবে না টমেটো।

এ কীটনাশক ব্যবহারে সমস্যা হবে কিনা জানতে কথা হয় কৃষি তথ্য সার্ভিসের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক কেজেএম আব্দুল আওয়ালের সাথে। তিনি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, ইথিফন কোম্পানিগুলো হরমন হিসেবে বিক্রি করে। মূলত এটি একটি অর্গানোফসফরিক গ্রুপের কীটনাশক। অতিরিক্ত পরিমাণ ব্যবহারে বিপাকীয় সমস্যা, পেটের পীড়া কিংবা স্বাস্থ্যঝুঁকি হতে পারে। তবে, কৃষকরা যে পরিমাণে ব্যবহার করেন তাতে কোন সমস্যা হবে না। রাজশাহীর গোদাগড়ীতে যে হরমোন ছিটানো হয় তাতে টমেটো পরীক্ষা করে দেখেছে কৃষি বিভাগ। তাতে শূন্য দশমিক ৯ পিপিএম মাত্রা হরমোন পাওয়া গেছে। আর এই হরমোনের সহনীয় মাত্রা হচ্ছে ২ পিপিএম। ফলে এখানকার টমেটো খেলে কোন সমস্যা হবে না।

গোদাগাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় টমেটো কেনাবেচাকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর ২০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। চলতি মৌসুমে ৩ হাজার ১৫ হেক্টর জমিতে টমেটো চাষ হয়েছে। গত বছর গোদাগাড়ীতে ২ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে টমেটো চাষ হয়েছিল। জেলার গোদাগাড়ীতে সব চেয়ে বেশি টমেটো চাষ হয়। আর রাজশাহী জেলাজুড়ে ৩৬ জাতের টমেটো চাষ হয়। এর মধ্যে তিন জাতের টমেটো বেশি চাষ হয়।

টমেটো চাষিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গোদাগাড়ীতে আউশ ধান কেটে নেওয়ার পর টমেটো চাষ শুরু হয়। এটা মূলত শীত ও বর্ষাকালীন টমেটো। যার সবগুলো হাইব্রিড। অন্য যেকোনো ফসলের তুলনায় টমেটো চাষ লাভজনক। এক বিঘায় ৬০-৭০ মণ টমেটো উৎপাদন হয়। আর প্রতি মণ ১ হাজার টাকা করে হলেও ৬০-৭০ হাজার টাকা বিক্রি করা যায়। যা ধান কিংবা অন্য ফসলে সম্ভব না।

কীটনাশক বা হরমোন ব্যবহারের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা আমাদের দায়িত্ব। ঢাকার পার্টিরা মূলত এসে নিয়ে চলে যায়। পাকানোর জন্য যা করার দরকার আমাদের করতে হয়। না পাকলে বা কালার না হলে তো আর বেচা যাবে না। তাই আমাদের এটা করতে হয়। শরীরের জন্য কোন ক্ষতির কারণ নাই।

চাষি সাখাওয়াত হোসেন এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে জানান, বিঘায় সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা খরচ হতে পারে। দেড় বিঘা জমিতে টমেটো চাষ করেছেন। গাছে টমেটো আসার আগ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। মোটামুটি টাকা আয় করতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

ঢাকার ব্যবসায়ী হামিদ মোল্লা বলেন, আমি অনেকের মতো কালার টমেটো কিনি না। বারশো টাকা মণ কাঁচা কিনে নিই। তারপর পরিমাণমতো করে আলাদা আলাদা করে কীটনাশক দিই। তারপর বিক্রি করি। এতে মণে লাভ ৩ থেকে ৪০০ টাকা বেশি হয়। অনেক চাষি কাঁচা তুলে সেভাবেই বিক্রি করে দেন।

গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মরিয়ম আহমেদ এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, হরমোন দিয়ে টমেটো পাকানো হচ্ছে। এতে ক্ষতিকারক কিছু থাকে না, তারপরও কম মাত্রায় থাকতে পারে। এই হরমোন (ইথোফোন) কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে পরীক্ষা করা হয়েছে মাত্রা ২ পিপিএম যা থেকে মানুষের কোন ক্ষতি হবে না। মূলত বেশি দাম পাওয়ার জন্য কাঁচা টমেটো বিক্রি করছেন চাষিরা। আগাম আহরণ করার ফলে টমেটোটা কম পুষ্ট হয়। রোদে জাগ দেওয়ার কারণে কিছুটা পুষ্টি হারায়। তাছাড়া অন্যকিছু নেই।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ