মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: আগামী অর্থবছর থেকে কর দিতে হবে পোল্ট্রি ও মৎস্য খামারিদের। ফলে ৪০ হাজার কোটি টাকার পোল্ট্রি খাত নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে। দেশের মাংসের চাহিদার ৪০ শতাংশ এই খাত থেকে পূরণ হলেও কারো সুদৃষ্টি নেই বলেই অভিযোগ পোল্ট্রি ও মৎস্য সংশ্লিষ্টদের। মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে পোল্ট্রি ও মৎস্য খাতে কর নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২২-২৩ বাজেটে এমনটাই বলছেন তারা।

করোনা মহামারির শুরুর সাথে সাথে খামারিদের দুর্দিন শুরু হয়েছে। যা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়নি। এ দুটি খাতের উপর ক্রমাগত আঘাত খাতের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক দিকে নিয়ে গেছে বলে জানা গেছে। করোনাকালে সময় পোল্ট্রি খাতের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১২-১৫ শতাংশ। তা এখন অনেকটাই নিন্মগামী।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন কর্পোরেট খাত যখন কর ছাড় পাচ্ছেন, অন্যান্য নীতি সহায়তা এমনকি কর মওকুফের মতো সুবিধা পেয়েছেন সেসময় পোল্ট্রি ও মাছ চাষি উদ্যোক্তাদের ঘাড়ে অতিরিক্ত করের বোঝা চাপানো কোন দেশের নীতির মধ্যে পড়ে! খাদ্যের দাম ২৯ শতাংশের বেশি যেখানে বেড়ে উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ হয়ে যায় ঠিক সেই মুহূর্তে কর বাড়ানো খাত ধ্বংসের পাঁয়তারা হিসেবেই দেখছেন তারা।

পড়তে পারেন: ডিম-মুরগির দাম নির্ধারণ করে কারা, কেন ধরা খায় খামারিরা?

২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে পোল্ট্রি খাতের করমুক্ত আয়ের সীমা অর্ধেক হয়ে ১০ লাখ টাকায় নেমে আসছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, প্রথম ১০ লাখের পর দ্বিতীয় ১০ লাখ টাকা আয়ের ওপর ৫ শতাংশ কর দিতে হবে পোল্ট্রি খামার মালিকদের। আর ২০ লাখ টাকার বেশি বার্ষিক আয়ের ওপর কর দিতে হবে ১০ শতাংশ। ৩০ লাখ টাকার বেশি আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর দিতে হবে। বর্তমানে এ পরিমাণ আয়ের ওপর করের হার ১০ শতাংশ।

ট্যাক্সের আওতায় আসবে মাছ ও পোল্ট্রি হ্যাচারি। শুধু হ্যাচারিতেই থেমে থাকেনি এই করের বোঝা। মাছ চাষি ও পোল্ট্রি খামারিদের একক ট্যাক্স স্ল্যাবের আওতায় নিয়ে আসবে সরকার। বর্তমানে মাছ ও পোল্ট্রি হ্যাচারি এবং মাছ চাষের জন্য একই ধরনের করকাঠামো কার্যকর রয়েছে।

পড়তে পারেন: গো-খাদ্যের দাম বাড়ায় দিশেহারা রাজশাহীর খামারিরা

সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) করফাঁকির সুযোগ বন্ধ করে কর সংগ্রহ বাড়ানোর লক্ষ্যেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের (বিপিকেআরজেপি) সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মোহসিন এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, “ প্রতি কেজি মুরগির উৎপাদন খরচ বেড়ে ১২২ টাকা। কিন্তু বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে ১২০ টাকায়। ডিমের উৎপাদন খরচ সাড়ে ৭ টাকার উপরে পৌঁছে গেছে; বিক্রি করতে হচ্ছে ৮ টাকার কম। ১৮০০ টাকার ফিডের বস্তা এখন ৩১০০ টাকা। এই পরিস্থিতিতে তাদের ওপর আরও কর আরোপের যে পদক্ষেপ সরকার নিয়েছে, তা খুবই হতাশাজনক। এসময় সরকার কী করে বাড়তি কর আরোপ করে এটাই তো মাথায় ঢকে না?

পোল্ট্রি ফিড অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, ফিড তৈরির কাঁচামালের দাম ৬৫ শতাংশ বেড়েছে। ফলে ক্রমপর্যায়ে ২৯ শতাংশ বেড়েছে খাদ্যের দাম।

জানতে চাইলে নারিশ কোম্পানির ডেপুটি ম্যানেজার ডা. আব্দুর রহমান এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, “খাদ্যের দাম বাড়তেই আছে। বর্তমানে নারিশের একবস্তা খাদ্যের দাম ৩১’শ ৬৭ টাকা। প্রতিকেজি খাদ্যের দাম পড়ে ৬৩ টাকা ৩৪ পয়সা। গত কয়েক মাসে ৭-৮ বার বেড়েছে খাদ্যের দাম। কমবে বলে মনে হয়না। খাদ্যের কাঁচামাল বাইরে থেকে আমদানি করতে হয় ফলে খরচ বেড়ে যাওয়ায় দাম বাড়ছে। আমাদের কিছু করার নাই।”

রাজশাহীতে ৭০ শতাংশ খামার বন্ধের কারণ জানতে চাইলে রাজশাহী পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, রাজশাহীতে ৭০ শতাংশের বেশি পোল্ট্রি খামার বন্ধ হয়েছে। বাড়তি দামে খাদ্য, ভ্যাকসিন, খামারের কর্মচারীর বেতন, সেই অনুযায়ী ডিম ও মাংসের দাম না থাকায় সবমিলিয়ে নাজেহাল খামারিরা। বর্তমানে খুচরা বাজারে প্রতিপিস লাল ডিম ৯ টাকা বিক্রি হলেও খামারিদের পকেটে ঢুকছে মাত্র ১ টাকা। খামারি পর্যায়ে ৮ টাকার বেশি দাম পান না তারা। এতোকিছুর পর আবার কর আরোপ করে কিভাবে? সরকারের কাছে এসব বুদ্ধি পাঠায় কারা? যাইহোক কর কর্মকর্তাদের এই বিষয়টা কিছুতেই মাথায় ঢুকাতে পারছি না।

করের প্রভাব সাধারণ ভোক্তার উপর কতটা পড়বে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পোল্ট্রি খাদ্যের মূল উপাদান সয়াবিন। যা বাইরের দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। সয়াবিন আমদানির উপর ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রক শুল্ক আরোপের ফলে প্রতি কেজি মুরগির উৎপাদন খরচ ৫ টাকা করে বেড়ে যাবে। এই সুযোগে খাত সংশ্লিষ্ট দালালরা মুরগি ও ডিমের দাম বাড়িয়ে ফায়দা লুটবে কিন্তু খামারিদের কপালে শুভঙ্করের ফাঁকি হয়েই থাকবে।

সারাদেশে কার্প জাতীয় মাছ উৎপাদনের শীর্ষে রাজশাহী। রাজশাহী জেলা মৎস্য খামারি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও মাছচাষি সোহরাব হোসেন এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, “এই খাতের অধিকাংশ মানুষ অল্প শিক্ষিত, বাজেট আমরা বুঝিনা। সরকারের ঘাটতি পূরণের ধান্ধা অনুযায়ী দাম বাড়ছে। তাছাড়া দফায় দফায় মাছের ফিডের দাম বাড়ানোর পর আবার কর আরোপ করা হয়। সরকার বুঝে গেছে কোথায় কাদের ঘাড়ে এই বোঝা চাপানো যায়। তাই গরীব মানুষের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে। মাসের মধ্যে দু-বার খাদ্যের দামের সাথে মাছ রপ্তানির সুযোগ করে দিক। সেটার দিকে নজর নেই কৃষকের পকেটের দিকে নজর সরকারের। কিছু বলার নাই। গরীবের আল্লাহ।”

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ