এমন যদি হতো, প্রগাঢ়

আফরোজা চৌধুরী, গবেষক কৃষি অর্থনীতিবিদ, ব্রি, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: এমন যদি হতো… প্রগাঢ় হতো কৃষকের হাসি শিরোনামের লেখাটিতে কৃষকের দোরগোড়ায় কীভাবে ধানের ন্যায্য দাম পৌঁছানো সম্ভব তার একটি দিক নির্দেশনাসহ নানা তথ্য রয়েছে।

জীবনযাত্রার মান হোক বা মুদ্রার মূল্যায়ন; ধানের দাম যুগে যুগে পরিমাপের একটি গ্রহনযোগ্য স্কেল। শায়েস্তা খাঁ’র আমল থেকে আজ অব্দি রাষ্ট্রনীতি ও রাষ্ট্রনায়কের দেশ চালনার সদিচ্ছা আমরা মেপে দেখি বাজারে ধান চালের দামকে ঘিরে।

বিশ্বের ধনাঢ্য দেশগুলোর মত আমাদের অর্থনীতি মরণাস্ত্র বা তেল বাণিজ্য ভিত্তিক নয়, অত্যধিক জনসংখ্যার পেট চালিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে আমাদের আনাগোনা এখনও গ্রামীণ প্রবাদ: যার গোলায় নাই ধান, তার আবার কথার টান পর্যন্তই।

কারণ কেবল এক মওসুমে বাংলাদেশে বিশ্বের প্রধানতম রাজনৈতিক পণ্য ধানের উৎপাদন বন্ধ থাকলে পৃথিবীর কোন দেশ (টাকার বিনিময়েও) আমাদের খাদ্য যোগান দিতে আসবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির শীর্ষে থাকা বাংলাদেশের খাদ্য-স্বয়ংসর্ম্পূণতা অর্জন বিস্ময়ের এক উপাখ্যান।

তবু এ সেক্টরের সাথে জড়িত প্রত্যেকের মধ্যে প্রতিনিয়ত শঙ্কা কাজ করে। একদিকে কৃষক পর্যায়ে ফলন, খরচ, লাভজনকতা নিয়ে শঙ্কা, অন্যদিকে আপামর জনসাধারণের মধ্যে থাকে দাম ও মান নিয়ে শঙ্কা।

ন্যায্য দামের নিশ্চিত গ্যারান্টি না দিতে পারায় যেটুকু প্রাপ্তি তা সোনালি উদ্ভাস এনে দেয় কেবল মাঠকে, না কৃষক না ভোক্তা এর সুফল পকেটে পুরতে পারছেন।

দাম না পাওয়ায় নিরুৎসাহিত হয়ে ধান চাষে বিমুখ হয়ে পড়ছে কৃষক সমাজ, যা ভবিষ্যতে দেশের খাদ্য স্বয়ংসর্ম্পূণতা ও কূটনৈতিক অবস্থানকে হুমকির মুখে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ এ খাতটির শেষ রক্ষায় করণীয় কী?

একই শীষ থেকে উদ্ভব হলেও বাজার রূপ বিবেচনায় ধান ও চাল দুটি আলাদা পণ্য এবং অভিন্ন মূল্যনীতি দিয়ে এ দুটির বাজারকে বশে রাখা দুষ্কর।

এমন যদি হতো, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক তার ফলানো ধান নিজ ইউনিয়ন পরিষদে পৌছে দিতেই ডিজিটাল ডেটাবেজ আগের সব বাকি-বকেয়া বিয়োগ করে পাওনার হিসাব করে দিচ্ছে।

সাথে সাথে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে ধানের দামের প্রথম কিস্তির টাকা তুলতে পারছে কৃষক। এমন যদি হতো, প্রতিটি উপজেলায় কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তার পাশাপাশি ’কৃষি বিপণন কর্মকর্তা’র পদসৃষ্টি করা হয়েছে যে তার দলবল সমেত মাঠের সাথে বাজারের সমন্বয় সাধনের কাজটি করছেন ধানসহ সব কৃষিপণ্যের জন্য।

এমন যদি হতো, দেশজ  উৎপাদনের একটি বড় অংশ (অন্তত ত্রিশ শতাংশ) পাবলিক প্রোকিওরমেন্টের আওতায় চলে এসেছে, যেখানে ভেজা ধান অত্যাধুনিক প্রযুক্তির স্বয়ংক্রিয় মেশিনে শুকিয়ে গুদামজাত করা হচ্ছে।

এমন যদি হতো, পিপিপি’র আওতায় দেশব্যাপী গড়ে উঠেছে ধানের বাই-প্রোডাক্ট থেকে পাওয়া ব্র্যান ওয়েল, জ্বালানি, মোম, ফিস এন্ড পোলট্রি ফিড ও সিমেন্ট শিল্পের মত নানা ধরনের এন্টারপ্রেনিওরশিপ যার লভ্যাংশ কৃষকের অ্যাকাউন্টে ঢুকে যাচ্ছে দামের শেষ কিস্তি হিসেবে।

এমন যদি হতো, আমদানি শুল্কের ওঠা নামা নিয়ন্ত্রণ করছে একটি সার্কিট ব্রেকার। সরকারি মজুদ কমে গেলে, মোটা চালের দাম অল্প আয়ের মানুষের নাগালের ওপরে বা কৃষকের লাভজনক মূল্যের নিচে নেমে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শুল্ক বেড়ে-কমে যাচ্ছে।

এমন যদি হতো, ট্রাকের পাশাপাশি শহরে-বন্দরে, গ্রাম-গ্রামান্তরে কম দামে চাল বিক্রির ও.এম.এস সুপারশপ রয়েছে যেখানে গিয়ে স্বছন্দে চাল কিনতে পারছেন মধ্যবিত্ত ও চাকুরে শ্রেণির সামাজিক মর্যাদাবানরা।

আরও পড়ুন: যুগ যুগ ধরে অবহেলিত কৃষকের হয়ে খুব কম মানুষই কথা বলেছে

এমন যদি হতো, বর্ডার পুশ-ইন, চাল কেটে ভিন্ন নামে বিক্রি, পরিবহনে চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে সকল অনিয়ম চলে এসেছে কঠোর নজরদারির ভেতর।

এমন যদি হতো, ধান চালের জন্য পৃথক একটি ’ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ কমিশন’ রয়েছে যেখানে সরেজমিন মাঠ ও বাজার পর্যবেক্ষণ ইউনিটের পাশাপাশি রয়েছে ভ্রাম্যমান আদালত এবং আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করার ক্ষমতা।

সঠিক সময়ে সঠিক নীতি গ্রহন ও তার কঠোর বাস্তবায়নে যদি একই ছাদের নিচে সার্বক্ষণিক কাজ করতেন তড়িৎকর্মা নীতিনির্ধারক, আমদানি-রপ্তানি বিশারদ, এগ্রোমেটরোলজিস্ট, দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, ম্যাজিস্ট্রেট ও স্পেশাল পুলিশ।

আশা করতে দোষ কী! এক থালা ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের আবেদনের কাছে যেভাবে প্রতিনিয়ত ম্লান হয়ে যায় আমাদের ডায়েট প্ল্যানের ক্যালরির হিসাব কিংবা বেহাল মহাসড়কে ধানের চারা যেভাবে হয়ে যায় প্রতিবাদের ভাষা, ঠিক তেমনিভাবে ধানের দামের পরিভাষায় উন্নয়নের কাহন রচিত হোক, পদ্মাসেতুর স্প্যানের চেয়েও প্রগাঢ় হোক কৃষকের হাসি।

এমন যদি হতো… প্রগাঢ় হতো কৃষকের হাসি এর লেখক আফরোজা চৌধুরী, গবেষক ও কৃষি অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট।