মেহেদী হাসান, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: করোনা ভাইরাস মোকাবেলার পাশাপাশি খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার কৃষি খাতকে এগিয়ে নিতে বাড়ানো হচ্ছে সরকারি ব্যয়। আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে প্রায় ২৬ শতাংশ। এ খাতে এডিপি বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে প্রায় ৮ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। ফলে বরাদ্দ বাড়ছে ২৬ শতাংশ বা প্রায় ১ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা।

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে সংশোধিত এডিপিতে কৃষি খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৬ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ১ দশমিক ৪৯ ভাগ। এ অর্থের মাধ্যমে প্রায় ১৮৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কৃষি খাতের এ বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের মূল এডিপির তুলনায় প্রায় ৭৬৬ কোটি টাকা বেশি। মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৭ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। এ বরাদ্দে কৃষি খাতের সাথে কৃষি মন্ত্রণালয় ছাড়াও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং খাদ্য মন্ত্রণালয় অর্ন্তভূক্ত রয়েছে ।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ১৬ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরে এটি বাড়িয়ে ২১ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা করা হচ্ছে। সে হিসেবে চলতি অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ২ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা বা ২৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ। অন্যদিকে কৃষি খাতে বাড়ছে ১ হাজার ৭৫৯ টাকা বা ২৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ। দুটি খাতের মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সক্ষমতা অনুসারে এ বরাদ্দ পর্যাপ্ত বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বরাদ্দ বৃদ্ধি কৃষকরা কতিখানি উপকৃত হবেন জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও কৃষি অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. হুমায়ূন কবির এগ্রিকেয়ার২৪.কম কে বলেন, আগে বাংলাদেশকে কৃষি প্রধান দেশ বলা হলেও বর্তমানে তা প্রমানিত হয়েছে। এই বাজেট কৃষকদের জন্য ফলপ্রদ হবে বলে মনে করছি। করোনা মহামারিতে কৃষি খাতের সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে কাজ করলে বৃহৎ সাফল্য আসবে। ২০২০-২১ বাজেটে এ খাতে এডিপি বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে প্রায় ৮ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। ৩০ তারিখে এটি চুড়ান্ত হবে তবুও কৃষি খাতের এ বরাদ্দ কৃষকবান্ধব হবে আশা করা যায়। ফলে বরাদ্দ বাড়ছে ২৬ শতাংশ বা প্রায় ১ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা।

তিনি আরোও বলেন, এ বরাদ্দে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে জড়িত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বিষয়গুলো জড়িত রয়েছে। খাদ্য গুদামজাতকরণ, সংগ্রহ, কৃষকদের প্রণোদনা ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষি খাতে দূর্নীতি সক্ষমভাবে মোকাবেলা করে কৃষির সাথে সংযুক্তদেও যতবেশি আগ্রহী করা যাবে এই বাজেট ততবেশি ফলপ্রসু হবে। মোট আয়ের প্রায় ২৭ ভাগ মধ্যস্বত্বভোগীর পকেটে যায়। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে উভয়ের মধ্যে একটি সমতা আনতে পারলে কৃষকরা বেশি লাভবান হবেন।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কথা উল্লেখ করে এই কৃষি অর্থনীতিবিদ বলেন, দুদককে আরো বেশি কৃষি খাতের দিকে নজর দিতে হবে। চলমান বিভিন্ন কৃষি প্রজেক্টে দূর্নীতি রোধ করতে পারলে বরাদ্দের টাকা কৃষকের জন্য সুফল বয়ে আনবে।

প্রণোদনার টাকা কৃষকদের হাতে সরাসরি পোঁছানোর বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কে বি এম মাহবুবুর রহমান এগ্রিকেয়ার২৪.কম কে বলেন, কৃষিতে প্রণোদনা অনেক বেশি বাড়াতে হবে। কৃষকরা যাতে উৎপাদিত পণ্যের ন্যাজ্যদাম পান সে বিষয়টা নিশ্চিত করতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীরা সাধারণত এ সমস্যা সৃষ্টি করে। কৃষি প্রণোদনা দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই কোন মাধ্যম রাখা যাবে না। ব্যাংক থেকে কৃষকদের মোবাইলে টাকা সরাসরি টাকা পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে।

প্রণোদনা সঠিকভাবে কাজে লাগানোর বিষয়ে তিনি আরোও বলেন, কৃষকদের ফসল রোপনের সময়ে সরাসরি টাকা প্রদান করতে হবে। তাদের উৎপাদিত পণ্য বেশিদিন রাখতে পারেন না। টাকার অভাবে, গুদামজাতকরণের অভাবে অল্পদামে বিক্রি করেন। গুদামজাতকরণ এবং ফসলের দাম সঠিকভাবে কৃষকের হাতে পোঁছানোর ব্যাপারে সরকারকে আরোও নিশ্চিত করতে হবে বলেও জানান তিনি।

অপরদিকে, স্বাস্থ্য খাতে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরএডিপি) স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জনসংখ্যা ও পরিবার কল্যাণ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ১০ হাজার ১০৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। ৭৮টি প্রকল্প বাস্তবায়নে এ অর্থ ব্যয় হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের এডিপিতে এ খাতে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে ১৩ হাজার ৩৩ কোটি টাকা। ফলে সংশোধিত এডিপির তুলনায় বরাদ্দ বাড়ছে ২ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা। তবে মূল এডিপির তুলনায় কিছুটা বরাদ্দ কমছে। চলতি অর্থবছরের মূল এডিপিতে এ খাতের ৬২ প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ ছিল ১৩ হাজার ৫৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। সেই তুলনায় বরাদ্দ কমছে ২২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।

উল্লেখ্য, বাজেট প্রসঙ্গে গতকাল পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এবং কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, স্বাস্থ্য এবং কৃষি খাতে বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির তুলনায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি বাড়ানো হয়েছে। তাদের প্রয়োজনীয়তা সক্ষমতা, দূরদর্শিতা ও চাওয়ার সক্ষমতা বিবেচনা করেই এ অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আমাদের বিবেচনায় এ বরাদ্দ সর্বোচ্চ। তবে এ বরাদ্দই শেষ নয়। কৃষি ও স্বাস্থ্য খাতে ওয়ার্কেবল, পসিবল প্রকল্প নিয়ে এলে তা দ্রুত অনুমোদন দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় আরো নতুন নতুন প্রকল্প নেয়া হতে পারে। সেই সুযোগ রাখা হয়েছে।

কৃষিমন্ত্রী বলেন, এ খাতের সব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে সাফল্য আনার একটি বড় দায়িত্ব আমার কাঁধে রয়েছে। আমি এ খাতের সবাইকে নিয়েই এ দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছি। করোনাকালে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। এজন্য উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণন ও অন্য বিষয়গুলোকে সমন্বিতভাবে মোকাবেলা করা হচ্ছে। গত কয়েক সপ্তাহে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, বিশেষজ্ঞ ও অন্যদের নিয়ে প্রতিনিয়ত বৈঠক করছি।

তিনি আরোও বলেন, সমস্যাগুলোর সমাধান করা হচ্ছে। সামনের দিনে কৃষি, মৎস্য বা প্রাণিসম্পদকে এগিয়ে নিতে হলে বাণিজ্যিকীকরণ, প্রযুক্তি ও যান্ত্রিকীকরণ করা ছাড়া সম্ভব নয়। চলতি বোরো মৌসুমে যন্ত্রের কারণে সঠিক সময়ে ধান কাটা সম্ভব হয়েছে। সেটি কৃষকের কাছে আরো বেশি পৌঁছানো প্রয়োজন। এছাড়া অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। সেই বিবেচনায় আমরা প্রকল্পের সুপারিশ করেছি। বরাদ্দকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া হবে।