গরু ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ অন্যান্য গবাদিপশু-পাখির নানান রকমের রোগবালাই হয়ে থাকে। গবাদিপশু পাখির রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে শঙ্কায় থাকেন খামারিরা। এসব লক্ষণ জানা থাকলে সহজ ভাবে রোগ চিহ্নিত ও চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারবেন। আসুন জেনে নিই গরুর প্রাণঘাতী কয়েকটি রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা।

তড়কা রোগ (উবামড়কি/গলি/ধড়কা/ তীরাজ্বর):

কারণ :
গ্রাম পজেটিভ ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে হয়। বর্ষাকালের স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে এ রোগ বেশি হয়। গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়ার এ রোগ হয়।
লক্ষণ :
-দেহের লোম খাড়া হয়।
-দেহের তাপমাত্রা ১০৬-১০৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়।
-দেহে কাঁপুনি ওঠে, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত ও গভীর হয়।
-নাক, মুখ ও মলদ্বার দিয়ে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
-পাতলা ও কালো পায়খানা হয়।
-ঘাড়ের পিছনে চামড়ার নিচে তরল পদার্থ জমে ফুলে ওঠে
-ক্ষুধামন্দা, পেট ফাঁপা ও পেটের ব্যথা হয়।
-লক্ষণ প্রকাশের ১-৩ দিনের মধ্যে পশু ঢলে পড়ে এবং মারা যায়।
-মৃত্যুর সাথে সাথে পেটফুলে এবং রক্ত জমাট বাঁধে না।
প্রতিরোধ :
-প্রথম ৬ মাস বয়সে পশুকে টিকা দিতে হবে। পরে প্রতি বছর বয়সে একবার করে টিকা দিতে হবে
-সুস্খ পশুকে পৃথক রাখতে হবে।
-পশুর মল, রক্ত ও মৃতদেহ মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে
-পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জীবাণুমুক্ত শুকনা স্খানে লালন-পালন করতে হবে।
চিকিৎসা :
-পেনিসিলিন/বাইপেন ভেট/জেনাসিন ভেট/এম্পিসিন ভেট ইনজেকশন দেয়া যেতে পারে। এ ছাড়াও স্ট্রেপটোমাইসিন/এন্টিহিস্টাভেট ইনজেকশন দেয়া যেতে পারে।

খুরারোগ (বাতা, জ্বারা, তাপা, এসো, খুরাপাকা):
কারণ :
পিকরনা নামক ভাইরাস দ্বারা এ রোগ হয়। জোড়া খুরবিশিষ্ট পশু যেমনন্ধ গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া ইত্যাদিতে এ রোগ হয়। বর্ষার স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে এ রোগ বেশি হয়।
লক্ষণ :
-মুখে, জিহ্বায় ও খুরে ফোস্কা পড়ে
-ফোস্কা ফেটে ঘা হয়।
-নাক ও মুখ দিয়ে লালা ঝরে।
-পশু খুঁড়িয়ে হাঁটে
-পশু শক্ত কিছু খেতে পারে না।
-ওলানের বাঁটে ক্ষত ও দুর্গìধ হয় এবং কষ ঝরে
-ক্রমে পায়ের খুর খসে পড়ে।
-পশু দুর্বল হয়ে পড়ে।
-দেহের তাপমাত্রা বাড়ে
-গাভীর দুধ কমে যায়।
প্রতিরোধ :
তড়কা রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্খা অবলম্বন করতে হবে।
চিকিৎসা :
-হালকা গরম পানির সাথে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট মিশিয়ে ক্ষতস্খানে দৈনিক ২-৩ বার ধুয়ে দিতে হবে।
-সোহাগা (বোরাক্স) বা বরিক পাউডার মধু বা গ্লিসারিনের সাথে মিশিয়ে ক্ষতস্খানে লাগাতে হবে।
-পশুকে এন্টিবায়োটিক ইনজেকশন (প্রোনেপেন/এসপিভেট/ ডায়াডেট/ সুমিডভেট/জেনসিনভেট) দিতে হবে।
-জ্বর কমানোর জন্য ডিক্লোডেট খাওয়াতে হবে।
-নারকেল তেল ও তারপিন তেল ৪:১ অনুপাতে মিশিয়ে ক্ষতে লাগাতে হবে।
-পশুকে নরম খাদ্য খাওয়াতে হবে।
সাবধানতান্ধ :
-কাদামাটি বা পানিতে পশুকে রাখা যাবে না।
-খোসকা পাতা দিয়ে ক্ষতস্খান ঘষা যাবে না।

বাদলা রোগ (কালো, জহরত, সুজওরা, কৃষজঙ্গ রোগ):
কারণ :
গ্রাম পজেটিভ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা হয়। গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়ার ৬ মাস থেকে দু’বছর বয়সে এ রোগ বেশি হয়। দেহের ক্ষত ও মলের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়।
লক্ষণ :
-পশুর দেহের মাংসপেশি ফুলে যায় এবং গায়ের চামড়া খসখসে হয়।
-ফোলা স্খানে গরম অনুভূত হয় এবং হাত দিলে চটচট শব্দ হয়।
-ফোলা স্খানে পচন ধরে এবং পশু মারাও যেতে পারে
-দেহের তাপমাত্রা ১০৫-১০৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট বাড়ে।
-কখনো পশুর পেট ফাঁপে এবং পশু খোঁড়াতে থাকে।
-খাওয়া ও জাবর কাটা বìধ হয় এবং হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।
-দেহের পশম খাড়া হয়। পশু নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
-আক্রান্ত স্খানে কাটলে গাঢ় লাল দুর্গìধযুক্ত ফেনা বের হয়।
প্রতিরোধ :
তড়কা রোগের পদ্ধতিতে রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
চিকিৎসা :
-পশুর শিরা বা ত্বকের নিচে প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১ হাজার ইউনিট পেনিসিলিন ইনজেকশন দিতে হবে।
অথবা ৩-৫ মিলিগ্রাম টেট্রাসাইক্লিন ইনজেকশন দিতে হবে। অথবা বাইপেনভেট/এমপিসিনভেট/ এন্টিহিস্টাভেট ইনজেকশন
দেয়া যেতেপারে।

ওলান ফোলা/প্রদাহ রোগ (ওলান পাকা, ঠুনকো ইত্যাদি):
কারণ :
ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হয়ে এ রোগ হয়। অস্বাস্খ্যকর স্যাঁতসেঁতে বাসস্খান এবং ময়লা হাতে দুধ দোহানো, ওলানে আঘাত প্রভৃতি কারণে রোগজীবাণু সংক্রমিত হয়।
লক্ষণ :
-ওলান লাল হয়ে ফুলে যায়।
-ওলান শক্ত ও গরম হয় এবং ওলানে ব্যথা হয়।
-দুধ ছানার মতো ছাকা ছাকা হয়।
-দুধের সাথে রক্ত বের হতে পারে।
-ওলান ও বাঁট নষ্ট হয়ে গাভীর দুধ বìধ হয়ে যায়।
-দুধ উৎপাদন বìধ হয়।
প্রতিরোধ :
-পশু শুকনো ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন স্খানে লালন-পালন করতে হবে।
-ওলান সর্বদা পরিষ্কার রাখতে হবে।
-হাত জীবাণুনাশক দিয়ে ধুয়ে দুধ দোহন করতে হবে।
-ওলান গরম হলে ঠাণ্ডা বা ঠাণ্ডা হলে গরম সেক দিতে হবে।

চিকিৎসা :
-আক্রান্ত পশুকে জেনাসিনভেট/ এমপিসিন ভেট/ ক্লোফেনাক ভেট/ এন্টিহিস্টাভেট ইনজেকশন দিতে হবে।
-সরিষার তেল ও কর্পূর তেল মিশিয়ে ওলানে মালিশ করা যেতে পারে।

ডায়রিয়া/পাতলা পায়খানা/উদরাময় রোগ:
কারণ :
ব্যাকটেরিয়া ও প্রোটোজোয়া জাতীয় জীবাণু দ্বারা হয়। বর্ষার সময় দূষিত খড়, পচা লতাপাতা, পচা পানি, পচা খাদ্য খেয়ে এ রোগ হয়।
লক্ষণ :
-ঘন ঘন পাতলা পায়খানা হয়।
-মুখ দিয়ে লালা ঝরে।
-মলের সাথে রক্ত বের হয়।
-পেটের ডান দিকে চাপ দিলে পশু ব্যথা পায়।
প্রতিরোধ :
-পরিষ্কার টাটকা খাদ্য খাওয়াতে হবে।
-বাচ্চা জন্মের পরই ২% আয়োডিন দিয়ে নাভি মুছে দিতে হবে।
-জন্মের পর ২ ঘন্টার মধ্যে কলস্ট্রাম সিরাপ খাওয়াতে হবে।
-জীবাণুমুক্ত বিশুদ্ধ পানি খাওয়াতে হবে।
চিকিৎসা :
-স্যালাইন খাওয়াতে হবে।
-সালফা প্লাস ট্যাবলেট খাওয়াতে হবে।
-কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে।

নিউমোনিয়া:
কারণ :
বিভিন্ন জীবাণুর (ব্যাকটেরিয়া, রিকেটশিয়া, ভাইরাস) সাথে এলার্জেন, আঘাত, ক্লান্তি, ঠাণ্ডা লাগা, বৃষ্টিতে ভেজা, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, আর্দ্র আবহাওয়া ইত্যাদি কারণে এ রোগ হয়।
লক্ষণ :
-আক্রান্ত পশুতে প্রথমে অল্প জ্বর ও কাশি এবং পরে ঘনঘন কাশি দেয়।
-নাক ও মুখ দিয়ে সাদা সর্দি বের হয়।
-দ্রুত ও গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস, কাশি ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।
-শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় শব্দ হয়।

প্রতিরোধ :
-বৃষ্টি, ঠাণ্ডা, আর্দ্র ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে পশু রাখা যাবে না। শুকনো ও গরম স্খানে রাখতে হবে।

চিকিৎসা :
পশুকে জেনাসিনভেট/ ওটেট্রাভেট/ কোট্রিমভেট ইনজেকশন দিতে হবে। যেকোনো ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ পশুর মধ্যে দেখলে উপজেলা পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।

গরুর প্রাণঘাতী কয়েকটি রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা শিরোনামে সংবাদের তথ্য কৃষি ইনফো থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।