এগ্রিকেয়ার২৪.কম প্রাণি ডেস্ক: বিভিন্ন প্রকার জীবাণু দ্বারা গাভীর ওলান ফুলা বা প্রদাহ মরণঘাতি রোগে আক্রান্ত হতে পারে। দ্রুত উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে গরুর ওলান আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

দ্রুত চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। হাতুরে ডাক্তারের চিকিৎসার মারত্মক ক্ষতি হতে পারে। মনে রাখতে হবে, এ রোগটি জটিল প্রকৃতির বিধায় পশুচিকিৎসকের পরামর্শমত চিকিৎসা করানো উচিৎ।

এ রোগ একটি গাভীর যে কোনো সময় হতে পারে তবে বাছুর প্রসবের পরেই গাভী বেশি আক্রান্ত হয়।

রোগের কারণ: বিভিন্ন প্রকারের ব্যাকটেরিয়া, ফাংগাস, মাইকোপ্লাজমা ও ভাইরাস এ রোগ সৃষ্টি করে থাকে।

সংক্রমণ: যদি সেডের মেঝে দীর্ঘ সময় সেঁতসেতে ও ভিজা থাকে, ওলানের বাঁট দূষিত মেঝের, সংষ্পর্শে আসার মাধ্যমে অথবা দুধ দোহনকারীর হাত, দুধ দোহনের যন্ত্রের মাধ্যমে জীবাণু সরাসরি ওলানে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। ওলানে বা বাঁটে আঘাতজনিত ক্ষত, ক্ষুরারোগের ফলে সৃষ্ট ক্ষত বা দীর্ঘ সময় ওলানে দুধ জমা থাকলেও এ রোগ হতে পারে। বাঁটের মধ্যে কোনো শলা বা কাঠি প্রবেশ করালেও গাভী এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

লক্ষণসমূহ: ওলান ফুলে শক্ত ও গরম হয়। ওলানে ব্যথা হয়। দুধ কমে যায় এমনকি বন্ধও হয়ে যায়। দুধের রং পরিবর্তন, কখনও পুজের মত বা রক্ত মিশ্রিত হয়। কখনও কখনও দুধের পরিবর্তে টাটকা রক্ত বের হয়।

তীব্র রোগে ওলান হঠাৎ করে লাল, শক্ত ও ফুলে যাবে। হাত দ্বারা ষ্পর্শ করলে গরম অনুভূত হবে। ওলানে প্রচন্ড ব্যথা থাকে। গায়ে জ্বর থাকে। পানির মত দুধ, পুঁজ বা রক্তযুক্ত দুধ বের হয়। ওলানে পচন ধরতে পারে। দুধ কালো কাপড়ে ছাঁকলে জমাট বাঁধা দুধ দেখা যায়।

গাভীর খাদ্য গ্রহণে অরুচি দেখা দেয়। অনেক সময় আক্রান্ত ওলানে গ্যাংগ্রিন হয়ে খসে যায়। গাভীর মৃত্যুও হতে পারে। সেপটিসেমিয়া ও টক্সিমিয়ার কারণে গাভী মারা যায়।

সুপ্ত সংক্রমণের ক্ষেত্রে দুধে ও ওলানে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না, তবে দুধ উৎপাদন কমে যায়। দুধে ব্যাকটেরিয়া বিদ্যমান থাকে এবং দুধের উপাদান পরিবর্তিত হয়ে যায়।

পুরাতন ওলান প্রদাহের ক্ষেত্রে দুধ উৎপাদন কমে যায় ও ছানা বা জমাট বাঁধা দুধ দেখা যায়। ওলান ক্রমশ শক্ত হয়ে যায়। গাভীর খাদ্য গ্রহণ কমে যায়। ওলানের ২-১টি বাঁট চিরতরে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। দুধে চোখে পড়ার মত তেমন পরিবর্তন ঘটে না। দীর্ঘ দিন পর পর অথবা একটি নির্দিষ্ট সময়

পরপর ওলানে প্রদাহের লক্ষণ প্রকাশ পায়। দুধে শ্বেত কণিকা ও সোমাটিক কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। পুরাতন ওলান প্রদাহযুক্ত গাভী খামারের জন্য খুবই ক্ষতিকর কারণ ওই গাভী সুস্থ গাভীতে রোগ ছড়াতে সাহায্য করে।

চিকিৎসা: খুব দ্রুত রোগ সনাক্ত করে চিকিৎসা প্রদান করতে হবে। দেরি হলে এ রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে। অভিজ্ঞ প্রাণিচিকিৎসকের পরামর্শক্রমে যেসব চিকিৎসা ব্যবস্থা নিতে হবে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে:

১। মাত্রানুযায়ী উন্নত মানের এন্টিবায়োটিক ইনজেকশন দিতে হবে (৪-৫ দিন)। ২। উন্নত মানের প্রদাহনাশক বা স্টেরয়েড জাতীয় ইনজেকশন দিতে হবে। ৩। উন্নত মানের টিট ইনফিউশন আক্রান্ত বাঁটে প্রয়োগ করতে হবে। (২৪ ঘন্টা পরপর ৩-৪ দিন)। ৪। উন্নত মানের জীবাণুনাশক মাত্রা মত পানিতে মিশিয়ে দিনে ২-৩ বার ওলান ধুয়ে দিতে হবে।

ওলান প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ: চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধের জন্য কাজ করতে হবে। একটি ডেইরী ফার্মে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা নিলে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

১। বাঁটের স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করতে হবে। বাসস্থান উন্নত ও স্বাস্থ্যসম্মত হতে হবে। জীবাণুমুক্ত দুধ দোহন ব্যবস্থা অনুসরণ করতে হবে। ওলান ও বাঁটের স্বাস্থ্য রক্ষাসহ যে কোনো রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

২। খুব দ্রুত এ রোগ সনাক্ত করতে হবে এবং দ্রুত উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে হবে। অসুস্থ গাভীকে আলাদা জায়গায় রাখতে হবে।

৩। শুষ্ক ও গর্ভবতী গাভীকে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ ও সেবা দিতে হবে। গাভীর ক্ষেত্রে (বকনা বাদে) দুধ দোহনের শেষ দিনে বাঁট বন্ধ করে দিতে হবে।

৪। বার বার এ রোগে আক্রান্ত হওয়া গাভী, যে গুলিকে সম্পূর্ণ ভালো করা সম্ভব হচ্ছে না সে গুলিকে ছাঁটাই করতে হবে। এ জাতীয় অসুস্থ গাভী রোগের উৎস হিসাবে কাজ করে। ফলে খামারের সুস্থ গাভীতে এ রোগ ছড়ায়। সফলভাবে এ রোগ নিয়ন্ত্রণের এটাই একমাত্র পন্থা।

৫। দুধ দোহনের যন্ত্র দৈনিক পরীক্ষা করতে হবে ও খামারের ওলান প্রদাহ রোগের চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে।

একটি দুগ্ধ খামারে ওলান প্রদাহ রোগ প্রতিরোধে যেসব স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে হবে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ১। গাভীকে কাঁচা ঘাসসহ পুষ্টিকর সুষম খাদ্য দিতে হবে। ২। সেডের মেঝে পরিষ্কার করে ২-৩ দিন পরপর জীবাণুনাশক প্রয়োগ করতে হবে। মেঝেতে কোনো প্রকার গর্ত রাখা যাবে না।

৩। বিজ্ঞান সম্মতভাবে গাভীর সেড/ঘর তৈরি করতে হবে। ৪। দুধ দোহনের আগে ওলান ধুয়ে নিতে হবে এবং প্রতিটি গাভী দোহনের আগে দোহনকারীর হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। অসুস্থ গাভীকে সবার শেষে দোহন করতে হবে। ৫। দোহনকারীর শরীর ও হাত পরিষ্কার রাখতে হবে। হাতের নখ অবশ্যই ছোট রাখতে হবে।

৬। দুধ দোহনের পর ওলান ধুয়ে তারপর জীবাণুনাশক ওষুধে বাঁট চুবাতে হবে। ৭। দুধ দোহনের পর গাভীর পেছনের অংশ ধুয়ে দিতে হবে।

৮। দোহনের পর কাঁচা ঘাস খেতে দিতে হবে যাতে করে গাভী ১-২ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে। তাহলে বাঁটারে দুধনালী সঙ্কুচিত হয়ে যাবে। এর ফলে জীবাণু প্রবেশের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। ৯। গাভীকে দৈনিক ১-২ ঘন্টা ব্যায়াম করাতে হবে। ১০। কিছু দিন পরপর দুধ পরীক্ষা করে এ রোগ ধরা পড়লে সাথে সাথে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। ১১। বাঁটের ভেতর শক্ত কাঠি বা টিট সাইফোন প্রবেশ না করানই উচিত। সূত্র: কৃষি তথ্য সার্ভিস, বিশেষজ্ঞ মত ও অভিজ্ঞ খামারি।