ফসল ডেস্ক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: পাকা কাউ ফলের রসালো কোয়াগুলো বের করে নিয়ে মরিচের গুঁড়া ও লবণ দিয়ে ভর্তা করে খেতে খুব ভালো লাগে। ফল হিসেবে সরাসরি খাওয়া ছাড়াও জ্যাম-জেলি তৈরি করা হয়। চাহিদাও রয়েছে বেশ। তাই চাষ করতে পারেন অপ্রচলিত কাউ ফল।

ফল গোলাকার, অনেকটা টেবিল টেনিস বলের মতো। কাঁচা অবস্থায় সবুজ এ ফল পাকলে হলুদ বা কমলা বর্ণ ধারণ করে। ফল গ্লোবাকার বা গোল। ফলের ভিতরে চার-পাঁচটি দানা থাকে। ফল পাকার পর এই দানা চুষে খেতে হয়। বীজযুক্ত এসব দানা রসালো ও টক। কাউ খেলে দাঁতে হলদেটে কষ লেগে যায়। পাকা ফল ইঁদুর ও পাখি খায়। মাটিতে যে বীজ পড়ে সেটাও ইঁদুর খেয়ে ফেলে। স্বাভাবিক পরিবেশে সেসব বীজ থেকেই চারা মে থেকে জুন মাসে গজায়। গাছের বাকল থেকে হলদে আঠা বের হয়। ফলের খোসা চামড়ার মতো পুরু। পাকা ফলের শাঁস বা কোয়া খাওয়া হয়।

ফল সম্পর্কে বিস্তারিত:

চট্টগ্রামে কাউফলকে ডাকা হয় কাউ ও কাউগোলা নামে, পিরোজপুর ও বরিশালে কাউ, কাউয়া। কাউফল দীর্ঘ বৃক্ষ প্রকৃতির চিরসবুজ গাছ। কাউ ফল পাকার পর এর কোয়াগুলোতে বীজযুক্ত দানার সাথে মুখরোচক রসালো ভক্ষ্যণীয় অংশ থাকে,যা চুষে খেতে হয়। কাউফল পর্ণমােচী বৃক্ষ, প্রায় ৩-১৬ মিটার উঁচু, মুকুট ডিম্বাকৃতি, বাকলের বাহির ধূসরাভ বাদামী, অভ্যন্তর লাল, মসৃণ, হলুদ গ যুক্ত, শাখা অসংখ্য, খাটো, ঝুলন্ত। পত্র সরল, ৫-১৮ x ২.৫-৭.০ সেমি, প্রতিমুখ, প্রশস্ত উপবৃত্তাকার-ভল্লাকার, ঝিল্লিময়, সূক্ষাগ্র থেকে দীর্ঘাগ্র, মূলীয় অংশ কীলকাকার, গাঢ় সবুজ ও চকচকে, শুষ্কবস্থায় বিবর্ণ, পার্শ্বীয় শিরা ১২-১৬ জোড়া, সরু, অস্পষ্ট, প্রান্তে মিলিত, বৃন্ত ৮-১৩ মিমি লম্বা।

পড়তে পারেন: কাজু, কফি, ড্রাগনসহ অপ্রচলিত ফসলের উৎপাদন-প্রক্রিয়াজাতে মিলবে সব সহযোগিতা

কাউফলের পুষ্প ছােট, চতুরাংশক, | ভিন্নবাসী, ছােট ছােট গুচ্ছে জন্মে, অক্ষীয় বা শীর্ষীয় । পুংপুষ্প ১ সেমি ব্যাস বিশিষ্ট, হলুদ থেকে লালাভ-হলুদ, ৩-৫টি পুষ্প বিশিষ্ট, অক্ষীয় বা শীর্ষীয় গুচ্ছে সন্নিবিষ্ট, দৃঢ় । বৃত্যংশ ৪ টি, ৪-৬ মিমি লম্বা, প্রশস্ত ডিম্বাকার, অসম, রসালাে, হলুদ। পাপড়ি ৪টি, ৮-১০ মিমি লম্বা, দীর্ঘায়ত, হলুদ, বেগুনি লাল বা লাল আভাযুক্ত।

পুংকেশর অসংখ্য, পুংদন্ড খাটো, পরাগধানী দীর্ঘায়ত, ৪ কোষী, লম্বালম্বী বিদারী, হ্রাসপ্রাপ্ত গর্ভকেশর অনুপস্থিত। স্ত্রীপুষ্প ২-৫ টি, শীর্ষীয় গুচ্ছে সন্নিবিষ্ট, পুংপুষ্প অপেক্ষা বৃহত্তর, আড়াআড়ি ১.৫ সেমি, হলুদ, বৃন্ত খাটো। গর্ভাশয় গােলাকার, ৬-৮ খন্ডিত, খাঁজ যুক্ত, বন্ধ্যা পুংকেশর গর্ভাশয়ের চতুর্দিকে বলয় সৃষ্টি করে, গর্ভদন্ড খাঁজযুক্ত, গর্ভমুন্ড দন্ড বিহীন, চ্যাপ্টা গভীর ভাবে ৬-৮ খন্ডিত।

ফল বেরি, গােলাকার বা নাসপাতি আকার, আড়াআড়ি ৫ সেমি, হলুদ বা লাল অনেক সময় ছােটকমলার মতাে, ৬-৮ খাঁজযুক্ত, সামান্য চাপা বা উপরের অংশ চ্যাপ্টা, হলুদ, পরিপক্ক অবস্থায় লাল, অভ্যন্তর রসালাে, ফলত্বক পাতলা। বীজ প্রতিফলে ৪-৮ টি, ১.৩-২.০ সেমি লম্বা, দীর্ঘায়ত, বীজোপাঙ্গ কোমল। ফুল ও ফল ধারণ ঘটে ফেব্রুয়ারি-আগস্ট মাসে।

পড়তে পারেন: ভাদ্র মাসে মাঠের ফসল, মাছ ও গরু ছাগলের যত্ন

আবাসস্থল ও চাষাবাদ:
সমুদ্র পৃষ্ট থেকে ১২০০ মিটার উচ্চতায় চিরহরিৎ, অর্ধচিরহরিৎ এবং উষ্ণমন্ডলীয় অরণ্য, কখনও জলাশয়ের তীরবর্তী অঞ্চল। বীজ দ্বারা বংশ বিস্তার হয়।স্যাঁতস্যাঁতে জংগলে কাউগাছ ভালো হয়। জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে। কিছুটা লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। মে থেকে জুলাই মাসে চারা রোপণ করা যায়। চারা থেকে চারার দুরত্ব দিতে হবে ৭ মিটার। তেমন কোনো সার দিতে হয় না। তবে প্রতি বছর গাছ প্রতি ১৫ থেকে ২০ কেজি গোবর সার, ১ কেজি ইউরিয়া, ৫০০ গ্রাম টিএসপি, এবং ৫০০ গ্রাম এমপি সার দিলে ভাল হয়।

বিস্তৃতি ও আদিনিবাস:
চট্টগ্রামে কাউফলকে ডাকা হয় কাউগোলা, পিরোজপুর ও বরিশালে কাউ, কাউয়া। এদেশে একদা প্রচুর কাউগাছ ছিলো, তবে এখন বেশি দেখা যায়না, তাই কাউফলও বেশ বিরল এখন। ভারত (বিহার, পশ্চিম বঈ আসাম, নাগাল্যান্ড মেঘালয়, ত্রিপুরা, উরিষ্যা এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ), চীন, মায়ানমার ও থাইল্যান্ডে বিস্তৃত। বাংলাদেশের সর্বত্র জন্মে।

অর্থনৈতিক ব্যবহার ও গুরুত্ব:
ফল ও রজন জাতীয় গাঁদের জন্য এই গাছটি গুরুত্বপূর্ণ। রজন হলুদ বার্নিশের কাজের ব্যবহৃত হয়। ফল আহার্য। কাষ্ঠ বিনাশ শীল তাই জ্বালানিরূপে ব্যবহৃত। থাইল্যান্ডে কাউফলের কচি পাতা বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী তৈরি এবং রান্নায় ব্যবহৃত হয়।

জাতিতাত্বিক ব্যবহার:
মায়ানমারে এই গাছের রজন ভেষজ ঔষধ রূপে ব্যবহার করা হয় (Caius, 1998)। বাকল দ্বারা বৌদ্ধ গন্ন্যাসীদের কাপড় রং করা হয় (Benthall, 1933)। ফল আমাশয়ে উপকারী। আসামে পাতা সবজিরূপে আহার্য (Singh, 1993)। বাংলাদেশের ফরিদপুর ও মাদারিপুর জেলায় অপরিপক্ক ফল থেকে চাটনি তৈরি হয়। চট্টগ্রামে পাকা ফল কাও গােলা নামে বাজারে বিক্রী হয় (Das, 1987)।

ভেষজগুণ:
কাউ গাছের ছাল খিচুনি রোগের জন্য এবং ফল আমাশয় ও মাথা ব্যথার জন্য ভেষজ চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। পাতার নির্যাস সর্দি ও চুলের খুশকি দূর করতে ব্যবহার হয়।

পুষ্টিগুণ:
এই ফলে আছে প্রচুর ভিটামিন সি যা ত্বকের জন্য অত্যধিক উপকারী। আরো আছে কপার, ফাইবার, ম্যাঙ্গানিজ ও ম্যাগনেশিয়াম যা শরীরের হাড় মুজবত রাখতে সাহায্য করে। এতে আছে খনিজ ও পটাসিয়াম যা হৃদস্পন্দনে সাহায্য করে, এবং রক্তচাপ, স্ট্রোক ও হার্ট রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা করে।

অন্যান্য তথ্য:
বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৭ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) কাউ ফল প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, প্রজাতিটির সংকটের কারণ আবাসস্থল ধ্বংস, অবৈধরূপে গাছ কর্তন ও অরণ্য পরিস্কার। বাংলাদেশে কাউ ফল সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি।

বর্তমানে বাংলাদেশে এদের সংরক্ষণ বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে এটি আশংকামুক্ত (LC). প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে যে এই প্রজাতিটি শীঘ্র সংরক্ষণের প্রয়োজন নেই।

চাষ করতে পারেন অপ্রচলিত কাউ ফল লিখেছেন বি এম রিজিয়া খাতুন (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ৭ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ২২৪-২২৫।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ