নিজস্ব প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: ১৯৮৩ সাল থেকে সরকারি উদ্যোগে দেশে ইঁদুর নিধন অভিযান শুরু হয়। কিন্তু কার্যকরভাবে ইঁদুর নিধন করা সম্ভব না হওয়ায় মোট উৎপাদনের একটি উল্লেখ্যযোগ্য অংশ ইঁদুরের পেটে চলে যাচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে রংপুরে চোঙা ফাঁদে বছরে ১২ লাখ ইঁদুর নিধন করা সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর।

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, রংপুরের পীরগাছা উপজেলার পারুল, ইটাকুমারী, অন্নদানগর, ছাওলা, তাম্বুলপুর ও কান্দিসহ বিভিন্ন এলাকায় মারা হচ্ছে ইঁদুর।পাকা-কাঁচা ধান গাছগুলো কেটে ফেলেছে ইঁদুর। ধান গাছগুলো হলুদ বর্ণ ধারণ করে মরে যাচ্ছে।

স্থানীয় কৃষকরা ইঁদুর নিধনে জিংক পাউডার, গ্যাস ট্যাবলেটসহ বিভিন্ন বিষ ব্যবহার করে তেমন সুফল পাচ্ছেন না। ফলে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে বাঁশের সাহায্যে চোঙ্গা ফাঁদ তৈরি করে সুফল পেয়েছেন। রাতে ধান খেতে এ চোঙা ফাঁদ পেতে ইঁদুর নিধনের চেষ্টা করছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দাবি,  এবার আমন মৌসুমে রংপুর কৃষি অঞ্চলের পাঁচ জেলায় ১১ লাখ ৮৭ হাজার ৬৭৬টি ইঁদুর নিধন করা হয়েছে। আমন মৌসুমে রংপুরেই ৭ লাখ ২৮ হাজার ২৮২টি ইঁদুর নিধন করা হয়েছে। এই অঞ্চলের পাঁচ জেলার মধ্যে রংপুর জেলায় সবচেয়ে বেশি ইঁদুর নিধন হয়েছে। এছাড়া গাইবান্ধা জেলায় ১ লাখ ৮ হাজার ২৯০, কুড়িগ্রামে ৯৮ হাজার ৭৮টি, লালমনিরহাটে ৭৬ হাজার ১৫৬টি এবং নীলফামারীতে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৬৬০টি ইঁদুর নিধন করা হয়েছে।

এবার করোনা মহামারির কারণে ইঁদুর নিধন কার্যক্রমে ছাত্র-ছাত্রীরা অংশ নেননি। তবে কৃষি বিভাগের ১ হাজার ৬০ জনের পাশাপাশি পাঁচ জেলার ১ লাখ ৯৫ হাজার ১৩৬ জন কৃষক ইঁদুর নিধন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। ‘জাতীয় সম্পদ রক্ষার্থে, ইঁদুর মারি একসাথে’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এখনও ইঁদুর নিধন কার্যক্রম চলছে।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, চলতি মৌসুমে রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় প্রায় ৬ লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রত্যেক বছর আমন মৌসুমে উৎপাদিত ফসলের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ইঁদুরের পেটে চলে যায়। শুধু আমন মৌসুমে মোট উৎপাদনের ছয় শতাংশ ইঁদুরের খাবারে পরিণত হয়। এভাবে প্রতি মৌসুমে গমের মোট উৎপাদনের ১০ শতাংশ, আলুর ৬ শতাংশ, শাক-সবজির ৫ শতাংশ, নারিকেলের ১০ শতাংশ ও আনারসের ১০ শতাংশ ফলন খেয়ে ফেলে ইঁদুর।

হাজার হাজার মেট্রিক টন ফসল খেয়ে দাঁপিয়ে বেড়ানো ইঁদুরের কারণেই কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকরা। সময়মতো আমন ধানে ভরছে না কৃষকের গোলা। ইঁদুরের উৎপাতে অতিষ্ঠ সবাই। তবে দিন দিন রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও গাইবান্ধা জেলায় ইঁদুর নিধনে সচেতনতা বাড়ছে। গেল কয়েক বছর এ অঞ্চলে আমনের খেতে বাঁশ দিয়ে তৈরি ‘চোঙা ফাঁদ’ পদ্ধতি কৃষকদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে।

উপজেলার অন্নদানগর ইউনিয়নের জগজীবন গ্রামের কৃষক নুর হোসেন বলেন, আগে গ্রামের কৃষকরা ইঁদুরের যন্ত্রণায় অসহায় হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এখন আমরা নানাভাবে কৃষি বিভাগের পরামর্শে ফসল রক্ষার চেষ্টা করছি। এ বছর চোঙা ফাঁদ ব্যবহার করায় ইঁদুরের উপদ্রব অনেক কমেছে।

তাম্বুলপুর ইউনিয়নের প্রতিপাল বগুড়াপাড়া গ্রামের কৃষক আমজাদ হোসেন বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে চোঙা ফাঁদ ব্যবহার করছি। আমন ধানের খেতে প্রতিদিন অন্তত ১০-১৫টি ইঁদুর মারা পড়ছে। চোঙ্গা ফাঁদ পদ্ধতিতে খরচ কম। গ্রামের অন্য কৃষকরাও এটি ব্যবহার করছে।

গত সোমবার (২৫ অক্টোবর) রংপুরে ইঁদুর নিধন অভিযানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়। ওই অনুষ্ঠানে ইঁদুর নিধনের প্রয়োজনীয়তা, কলাকৌশল নিয়ে আলোচনা করা হয়। পরে গত বছর ইঁদুর নিধনে অবদান রাখায় পাঁচজন কৃষক, তিনজন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাসহ একটি উপজেলাকে পুরস্কার দেওয়া হয়।

ওই অনুষ্ঠানে বলা হয়, গত বছর দেশে প্রায় ১ কোটি ১৯ লাখ ৮৪ হাজার ইঁদুর নিধন করা হয়েছে। এর ফলে ইঁদুরের হাত থেকে ৮৯ হাজার ৮৭৬ টন ফসল রক্ষা করা হয়েছে। যার বাজার মূল্য প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা। প্রতি বছর ইঁদুর প্রায় ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকার ফসল নষ্ট করে। গত বছর প্রায় ১ কোটি ১৯ লাখ ৮৪ হাজার ইঁদুর নিধন করা হয়েছে।

ইঁদুর একটি চতুর ও নিরব ধ্বংসকারী স্তন্যপায়ী প্রাণী। ইঁদুর প্রাণীটি ছোট হলেও ক্ষতির ব্যাপকতা অনেক। এরা যেকোনো খাদ্য খেয়ে বাঁচতে পারে। যেকোনো পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে। অল্প বয়সে বাচ্চা দিতে পারে। ১ হাজার ৭০০টি ইঁদুরজাতীয় প্রজাতির মধ্যে বাংলাদেশে ২২টির অধিক ক্ষতিকারক ইঁদুরজাতীয় প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত ইঁদুর উৎপাদিত ফসলকে নষ্ট করছে। ক্রমবর্ধমান হারে খাদ্যের প্রয়োজনে দেশে বর্তমানে এক ফসলের পরিবর্তে বহুবিধ ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে। এর ফলে ইঁদুর মাঠেই খাদ্য পাচ্ছে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ