গৃহপালিত পশু বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এই রোগ জীবাণু ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, মাইকোপ্লাজমা ইত্যাদি অণুজীব ঘটিত। আবার পরজীবী কৃমি, প্রোটোজোয়া, উঁকুন, আঠালি ঘটিত হয়ে থাকে। এছাড়াও অপুষ্টি, বংশগত অস্বাভাবিকতা, বিপাকীয় সমস্যা এবং বিষাক্ত পদার্থের কারণে হতে পারে। ছাগলের ব্যাকটেরিয়াজনিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রোগ, এদের লক্ষণ, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের উপায় জেনে রাখা দরকার।আসুন জেনে নিই ছাগলের প্রাণঘাতী পিপিআর রোগের লক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসা। লেখাটি লিখেছেন কৃষিবিদ ডা. সুচয়ন চৌধুরী, ভেটেরিনারি সার্জন।

পিপিআর হচ্ছে ছাগলের একটি জীবনঘাতী রোগ। Peste des Petits Ruminants (PPR) নামক ভাইরাসের কারণে এ রোগ হয়। এ রোগ হলে অসুস্থ প্রাণীর জ্বর, মুখে ঘা, পাতলা পায়খানা, শ্বাসকষ্ট দেখা যায়। অনেক সময় অসুস্থ প্রাণীটি মারাও যেতে পারে। বিজ্ঞানীদের ভাষায়, এটি একটি মরবিলি ভাইরাস (Morbillivirus) যার ফ্যামিলি হলো প্যারমিক্সো ভাইরাস(Paramyxovirus)। এ রোগটি বিভিন্ন গবাদিপশু ও কিছু কিছু বন্যপ্রাণীতে হতে পারে। তবে এ রোগটি সচরাচর দেখা যায় ছাগল এবং ভেড়াতে। এ রোগটি প্রথম দেখা যায়, আইভরিকোস্টে ১৯৪২ সালে। তারা এ রোগকে কাটা (kata) বলত। ১৯৮৭ সালে আরব আমিরাতে চিড়িয়াখানার প্রাণী আক্রান্ত হয় । এটি প্রথম ছাগল ভেড়া ছাড়া অন্য প্রাণী আক্রান্ত হওয়ার রেকর্ড। ওই চিড়িয়াখানায় গজলা হরিণ (gazelle), বুনো ছাগল (রনবী), গেমস বকের (gemsbok) দেহে এ রোগ শনাক্ত করা হয়। ২০০৭ সালে চীনে সর্বপ্রথম এ রোগ রিপোর্ট করা হয়। ২০০৮ সালে মরোক্কোতে এ রোগ প্রথম শনাক্ত করা হয়।

কিভাবে এ রোগ ছড়ায়?
১. অসুস্থ প্রাণীর চোখ, নাক, মুখ থেকে নিঃসৃত তরল, পায়খানা ইত্যাদির মাধ্যমে এ রোগ ছড়াতে পারে।
২. যেসব প্রাণী অসুস্থ প্রাণীর সংস্পর্শে থাকে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সে রোগ সুস্থ প্রাণীকে আক্রান্ত করতে পারে।
৩. অসুস্থ প্রাণীর হাঁচি-কাশির মাধ্যমেও এ রোগ সুস্থ প্রাণীকে আক্রান্ত করতে পারে।
৪. পানি, খাদ্য পাত্র এবং অসুস্থ প্রাণীর ব্যবহৃত আসবাবপত্র দিয়েও এ রোগ ছড়াতে পারে।
৫. যে প্রাণীর শরীরে জীবাণু আছে কিন্তু এখনও রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়নি সেসব প্রাণীর মাধ্যমে রোগ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর হতে পারে।
৬. তবে আশার কথা হলো, দেহের বাইরে এ রোগের জীবাণু বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে না।

এ রোগের লক্ষণ কি কি?
১. সাধারণ পিপিআর রোগের জীবাণু শরীরে প্রবেশের ৩-৬ দিনের মধ্যে এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
২. শরীরের তাপমাত্র হঠাৎ করে অনেক বেড়ে যেতে পারে। এ তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি থেকে ১০৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে।
৩. ছাগলের নাক, মুখ, চোখ দিয়ে প্রথমে পাতলা তরল পদার্থ বের হয়। পরবর্তীতে তা ঘন ও হলুদ বর্ণ ধারণ করে। ধীরে ধীরে তা আরও শুকিয়ে নাকের ছিদ্র বন্ধ করে দিতে পারে । ফলে প্রাণীটির শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
৪. অসুস্থ পশুটির চোখও এ রোগের আক্রান্ত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে, ছাগলের চোখের পাতা ফুলে যেতে পারে। অনেক সময় ঘন দানাদার পদার্থ নিঃসৃত হয়ে চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
৫. রোগের এক পর্যায়ে মুখ ফুলে যেতে পারে। মুখের ভেতরে নরম টিস্যুগুলো আক্রান্ত হতে পারে। দাঁতের গোড়ার মাংস পেশিতে ঘা হতে পারে। তাছাড়া দাঁতের মাঝখানে ফাঁকে ফাঁকে, মুখের ভেতরে তালুতে, ঠোঁটে, জিহ্বায় ক্ষত তৈরি হতে পারে।
৬. অনেক সময় অসুস্থ প্রাণীটির মধ্যে মারাত্মক রকমের ডাইরিয়া দেখা দিতে পারে। ডাইরিয়ার ফলে প্রচুর পরিমাণ তরল শরীর থেকে বের হয়ে যায়। ফলে প্রাণীটি প্রচ- রকমের পানি শূন্যতায় ভোগেন। এ পানি শূন্যতার কারণেও প্রাণীটি মারা যেতে পারে।
৭. অসুস্থ প্রাণীটির ওজন হ্রাস পায়। ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে থেকে প্রাণীটি।
৮. পিপিআর আক্রান্ত ছাগলে, অসুস্থ হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।
৯. অসুস্থ হওয়ার পাঁচ থেকে দশ দিনের মধ্যে প্রাণীটি মারা যেতে পারে।
১০. আক্রান্ত ছাগলটি যদি গর্ভবতী হয়, তাহলে গর্ভপাতের সম্ভবনা থাকে।
১১. অল্প বয়স্ক পশুগুলো এ রোগে অধিক আক্রান্ত হয়।
১২. ভেড়ার চেয়ে ছাগলের মধ্যে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়।

রোগ হয়ে গেলে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন?
১. অসুস্থ প্রাণীকে আলাদা করে চিকিৎসা করাতে হবে। ২. অসুস্থ প্রাণীর নাক, মুখ, চোখ দিয়ে নিসৃত তরল যাতে অন্য প্রাণীর শরীরে না লাগে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৩. ছাগলের থাকার ঘর জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।

চিকিৎসা
১. পিপিআর রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। তবে ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে ২য় পর্যায়ের ব্যাকটেরিয়ার এবং পরজীবী সংক্রমণ রোধ করে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা যায়।
২. শ্বাসতন্ত্রের ২য় পর্যায়ের সংক্রমণ রোধে অক্সিটেট্রাসাক্লিন ও ক্লোর টেট্রাসাইক্লিন খুব কার্যকর।
৩. গবেষণায় দেখা গেছে, ফুড থেরাপি এবং জীবাণুরোধী ওষুধ যেমন- ইনরোফ্লোক্সাসিন, সেফটিফোর নির্দিষ্ট ডোজে ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
৪. ৫% বরো-গ্লিসারিন দিয়ে মুখ ধুয়ে দিলে মুখের ক্ষত অনেক ভালো হয়ে যায়।
৫. তবে চোখের চারপাশে, নাক, মুখ পরিষ্কার কাপড় এবং কটন টিউব দিয়ে পরিষ্কার করে দিতে হবে দিনে ২-৩ বার করে।
৬. অসুস্থ ছাগলকে যত দ্রুত সম্ভব আলাদা করে ফেলতে হবে।
৭. অতি দ্রুত নিকটস্থ প্রাণিসম্পদ দপ্তরে যোগাযোগ করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
৮. অসুস্থ প্রাণীটি মারা গেলে অবশ্য ভালোভাবে পুঁতে ফেলতে হবে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

প্রতিরোধ
১. পিপিআর রোগের প্রতিরোধের সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হলো ছাগল এবং ভেড়াকে নিয়মিত টিকা প্রদান করা।
এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরে সরকারিভাবে পিপিআর রোগের টিকা সরবরাহ করা হয়। আগ্রহী খামারিরা ওই দপ্তর থেকে পিপিআর টিকা সংগ্রহ করতে পারেন।

২. টিকা প্রদান পদ্ধতি
ক. উৎপাদন কেন্দ্র বা সরবরাহ কেন্দ্র থেকে কুল ভ্যান/ফ্লাক্সে পর্যাপ্ত বরফ দিয়ে টিকা বহন করতে হবে।
খ. ডিসপোসেবল সিরিঞ্জ দিয়ে টিকা প্রদান করতে হবে এবং সব রকম জীবাণুমুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে।
গ. টিকা দেয়ার পূর্বে ১০০ মিলি ডাইলুয়েন্টের বোতল কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা+৪ ডিগ্রি থেকে+৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রেখে ব্যবহার করতে হবে।
ঘ. ডাইলুয়েন্ট মিশ্রিত টিকা ১-২ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবহার করতে হবে।
ঙ. টিকা প্রয়োগের মাত্রা প্রতি ছাগল বা ভেড়ার জন্য ১ মিলি. মাত্রা চামড়ার নিচে প্রয়োগ করতে হবে।
চ. বাচ্চার বয়স ৪ মাস হলেই এ টিকা প্রয়োগ করা যায়। ২ মাস বয়সের বাচ্চাকেও এ টিকা দেয়া যায়।
ছ. ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ১ বছর পর পুনরায় (বুস্টার) টিকা প্রয়োগ করতে হবে।
জ. প্রসবের ১৫ দিন আগে গর্ভবতী ছাগল/ভেড়াকে এ টিকা প্রয়োগ করা যাবে না।
ঝ. পুষ্টিহীন প্রাণিকে এ টিকা প্রয়োগ না করাই উত্তম।
ঞ. টিকা প্রয়োগের ১৫ দিন আগে কৃমিনাশক খাওয়ানো গেলে টিকার কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।
ট. খামারে নতুন ছাগল/ভেড়া আনলে ১০ দিন পর টিকা প্রয়োগ করতে হবে।
ঠ. আক্রান্ত ছাগল/ভেড়াকে এ টিকা প্রয়োগ করা যাবে না।
ড. ব্যবহৃত টিকার বোতল বা অবশিষ্ট টিকা যথাযথভাবে নষ্ট করে ফেলতে হবে।

ছাগলের প্রাণঘাতী পিপিআর রোগের লক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসা শিরোনামে লেখাটি লিখেছেন কৃষিবিদ ডা. সুচয়ন চৌধুরী, ভেটেরিনারি সার্জন, উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর, রাঙ্গামাটি সদর, রাঙ্গামাটি।ছাগলের প্রাণঘাতী পিপিআর রোগের লক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসা কৃষি তথ্য সার্ভিস থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।